৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮
কমরেড রাজদেও গোয়ালার জীবনাবসান
জীবনাবসান হলো প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা রাজদেও গোয়ালার। বামপন্থী আন্দোলন তথা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র রাজ্য কমিটির প্রাক্তন সদস্য, বেলগাছিয়া পশ্চিম বিধানসভা কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের প্রাক্তন সর্বভারতীয় নেতা কমরেড রাজদেও গোয়ালা একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৩০ ডিসেম্বর রাত ২টো নাগাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর জন্ম ২৯ নভেম্বর ১৯২৯। তাঁর স্ত্রী ও দুই পুত্র বর্তমান। তাঁর মরদেহ সিপিআই(এম) কলকাতা জেলার দপ্তরে এবং সিআইটিইউ রাজ্য দপ্তরে আনা হলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান নেতৃবৃন্দ। এরপর নিমতলা শ্মশানে তাঁর মৃতদেহ দাহ করা হয়।
সৌম্যজিৎ রজকের সংযোজনঃ
সামনে শোয়ানো মরদেহ। লাল পতাকায় মোড়া। ফুলে ফুলে উপচে পড়েছে। একে একে মাল্যদান করছেন পার্টি ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতারা, কর্মীরা, শ্রমিকেরা। নাম ধরে ডাকা হলে তাঁর বুকে ফুল ঢেলে দিতে গিয়ে, এ কী? মরদেহ কোথায়? একটি স্বচ্ছ আয়না যেন মাটিতে শোয়ানো। অবিকল সেই মুখ-চোখ, শুধু নাকের কোটরে গোঁজা তুলো। মানুষের মরদেহ নয়, যেন একটি আয়না শোয়ানো। যার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে, মাথা নত করে তাকালে স্পষ্ট প্রতিফলিত, দেখতে পাচ্ছি, ইতিহাসকেই। আস্ত ইতিহাস।
সে আয়নায় দেখি, একটি বছর উনিশ-কুড়ির যুবককে। কদিন আগেই তাঁর চোখের সামনে স্বাধীন হলো দেশ। চোখের সামনে টুকরো হলো দেশ। যত সাধ ছিল স্বাধীনতার, চোখের সামনে সে দেখছে, সেসব মিথ্যে কথার মতো উবে যাচ্ছে আকাশে। স্বাধীন দেশেও খিদেয় মরছে মানুষ, বেঁচে থাকছে আশ্রয়হীন। এমনই সময় বন্ধুদের মুখে মুখে একটি স্লোগান এসে পৌঁছয় তার কানে। ‘‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত ভুলো মত’’! বহু হাত ঘুরে এসে পৌঁছয় পান্নালাল দাশগুপ্তের লেখা একটা পুস্তিকা; ‘‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আজই নয় কেন’’ শীর্ষক। বেলগাছিয়া, বেহালা, বাগবাজার, বসিরহাট আর অসমে ছড়ানো ছেটানো সামান্য সাংগঠনিক শক্তি নিয়েই পান্নালালবাবুর নেতৃত্বে আরসিপিআই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ছক কষছে। তাতে ভিড়ে যায় যুবকটি। তারপর হামলে পড়ে। বিস্ফোরণে বেলগাছিয়া ব্রিজ উড়িয়ে, এয়ারপোর্টে একটি বিমানে আগুন লাগিয়ে, থানায় হানা দিয়ে, জেশপ কারখানার জ্বলন্ত ফারনেসে ম্যানেজমেন্টের তিনজন সাহেবকে জ্যান্ত ছুঁড়ে ফেলে ক্ষমতা দখলের অভিযান। এবং অনিবার্য কার্যকারণ বশতই তাতে ব্যর্থ হওয়া।
আয়নায় দেখি, সে যুবক পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার সাথীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পুলিশ হানা দিচ্ছে বাড়িতে। বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোতে, যেখানে সে ছিল সামান্য অ্যাপ্রেন্টিস। বহুবার গ্রেপ্তারি এড়িয়েও শেষাবধি গ্রেপ্তার হয়ে যাচ্ছে সে। তাকে ও তার ১২-১৩ জন সাথীকে চালান করা হচ্ছে প্রেসিডেন্সি জেলে। সেটা ১৯৪৯ সাল, এই শুরু, এবার থেকে জেলখানায় প্রায় লাগাতার যাওয়া আসা লেগে থেকেছে রাজদেও গোয়ালার।
রাজদেও গোয়ালা। বেলগাছিয়ার একটি দড়িকলের শিশুশ্রমিক। তারপর একটি চায়ের দোকানে কাপ-প্লেট ধোয়ার কাজ। ট্রামের শ্রমিক। ব্যর্থ বিপ্লবী অভ্যুত্থানের অপরাধে জেলে ঢোকা। ভেতরে তখন কাকাবাবু, অবনী লাহিড়ী, জলি কউল, রেণু চক্রবর্তী, মনিকুন্তলা সেনেরা। তাঁদের সাথে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, জেলের ভেতরেও রীতিমতো লড়াই সেনাবাহিনীর সাথে, ’৫৬ দিনের অনশন শেষে মুক্তি। ১৯৫১ সালে। কয়েক মাস পরে ফের গ্রেপ্তার। ‘৫২-তে যখন বেরোলেন জেল থেকে তখন কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কাজ করা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই চোখে।
কাকাবাবুর নির্দেশেই কাশীপুর-বেলগাছিয়া চত্বরে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ শুরু। কলকাতা তখন শিল্পনগরী। কাশীপুর-বেলগাছিয়াজুড়ে কারখানার পর কারখানা। গ্লাস ফ্যাক্টরি, অ্যাঞ্জেলো ব্রাদার্স, উষা অটোমোবাইল, ডিব্বাকল, ব্যাটারি কারখানা... একের পর এক কারখানায় ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন রাজদেও গোয়ালা। ইউনিয়নের জন্য ইউনিয়ন নয়, শ্রমিকদের সংগ্রামের জন্য ইউনিয়ন। ১৯৫৩-তে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ প্রাপ্তি। ক্রমে অবিভক্ত পার্টির জেলা পরিষদের সদস্য এবং সম্পাদকমণ্ডলীরও।
১৯৫২-র খাদ্য আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ‘৫৩-র ট্রামভাড়া বৃদ্ধি বিরোধী সংগ্রামের দিনে ১৪৪ ভেঙে সভা করার জন্য বেলগাছিয়া থেকে সটান চালান হয়ে গেছেন জেলে। এরকম বারেবারে ঘটতে থেকেছে।
১৯৬২-র ২১ নভেম্বর চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে চীন যখন একতরফাভাবে সরে এল, তারপরে শুরু হয়েছে পার্টির বাছাবাছা নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা। মধ্যরাতেই। বাছাবাছা মানে যাঁরা শোধনবাদের পক্ষে ছিলেন না, তাদের। পুলিশের এই হামলার জন্য বিপ্লবীরা আগে থেকে প্রস্তুত ছিলেন না, তাও নয়। পূর্বপ্রস্তুতি মোতাবেক বেশ কয়েকজনের মতো আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলেন তিনিও। আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালেই রাজা মণীন্দ্র রোড থেকে আচমকা গ্রেপ্তার হন একদিন। ১৩ মাস জেল খেটে ছাড়া পান যেদিন, বাড়ি ফেরেননি। জরুরি অবস্থার মধ্যে প্রথম ধর্মঘট তখন করছেন জয়া ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন। জেল থেকে জয়া কারখানার গেটে, শ্রমিকদের মাঝে পৌঁছে গেছিলেন। ধর্মঘটী শ্রমিকদের আপনজন, শ্রমিকের যুদ্ধক্ষেত্রই যার ঘরবাড়ি। রাজদেও গোয়ালা তেমনই।
পার্টির মতাদর্শগত লড়াইতে কলকাতা জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি সদস্যদের বিপ্লবী লাইনের পক্ষে অবিচল নেতৃত্ব দেওয়ার প্রশ্নে কিংবা ত্যাগরাজ হলে পার্টির সপ্তম কংগ্রেসের আয়োজনে অক্লান্ত ছিলেন তিনি। সিআইটিইউ গঠনের জন্য গোয়ার কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন। ৭০ সালে কলকাতায় সিআইটিইউ-র প্রথম সম্মেলনের আয়োজনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুরুর দিন থেকে সিআইটিইউ-র সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। কলকাতা ও রাজ্যের অন্যতম মুখ্য সেনাপতি তো বটেনই!
সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে শুধু মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনাই নয়, শারীরিক হামলা প্রতিরোধেও তাঁর বিশেষ ভূমিকা ছিল। কারাবরণ, আন্ডারগ্রাউন্ড এসব অবশ্য বন্ধ হয়নি। দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ারও পরে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা। কোনো হামলাই পার্টির যে নেতাদের হতাশায় মুড়ে ফেলতে পারেনি, জেদে-হিম্মতে যারা ছিলেন অবিচল, যাঁরা লালপতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখার প্রতিটি বাঁকমোড়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন - রাজদেও গোয়ালা তাঁদেরই একজন।
২৯ ডিসেম্বর তাঁর মরদেহে মালা দিতে গিয়ে দেখি, আঁধার পুড়ে গেছে আগুনে। আগুনখেকো সে ইতিহাসের সামনে নতজানু আমরা আজকের জটিল পরিস্থিতিতে লড়াইয়ের হিম্মত সংগ্রহ করব। করতেই হবে।
প্রসঙ্গত রাজদেও গোয়ালা পার্টির কলকাতা জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। ট্রাম শ্রমিকদের সংগ্রামের নেতা ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি (১৯৭৮) লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেছেন।