E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮

জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য

কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার

সন্দীপ দে


দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন আপসহীন সেনানী, অসমে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং রাজ্যে সিপিআই(এম)’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার-এর জন্মশতবর্ষ এবছর বিভিন্ন কার্যসূচির মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সভা-সমাবেশ-আলোচনাচক্র ইত্যাদি বিভিন্ন কার্যসূচির মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, অসমের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও রাজ্যে‍‌ সিপিআই(এম) প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে তাঁর নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার পাশাপাশি রাজ্যে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলায় তাঁর বিশেষ অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেইসঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করে রাজ্যে বামপন্থী ও গণআন্দোলনের বিকাশে তাঁর সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার বার্তা উচ্চারিত হয়েছে।

জন্ম-শিক্ষাজীবন-স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ

কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের জন্ম ১৯২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বজালি জেলার নিত্যানন্দ সংলগ্ন মরিপুর গ্রামে। তাঁর বাবা ঘনশ্যাম তালুকদার ছিলেন বিপুল ভূ-সম্পত্তিসম্পন্ন একজন বিত্তবান ব্যক্তি। মা সন্ধ্যারানি তালুকদার ছিলেন একজন স্নেহশীলা এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্না মহিলা। তালুকদার দম্পত্তির সাতজন সন্তানের মধ্যে নন্দেশ্বর ছিলেন চতুর্থ।

নন্দেশ্বর তালুকদারের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিত্যানন্দ এমছ ই স্কুলে। সেখানে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁর ইঞ্জিনিয়ার কাকা দাসরাম তালুকদার তাঁকে নিয়ে আসেন কর্মস্থল সদিয়াতে। সেখানে মধ্য শিক্ষা গ্রহণের পর কাকার বদলির সূত্রে ধুবড়িতে এসে নবম শ্রেণিতে ভরতি হন। এখানে পড়ার সময়েই নন্দেশ্বর দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৩৮ সালে এখানেই তিনি জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা শুনে উদ্বুদ্ধ হন। ধুবড়ি হাই স্কুলের ছাত্র উত্তম দাস সেই সময় নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনের অসম শাখা-অসম ছাত্র সম্মিলনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ধুবড়ি শাখা গঠনের জন্য নন্দেশ্বর তালুকদার সহ অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারপর দু’দিনের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে ব্যারিস্টার শরৎ বসু (মুখ্য অতিথি), ছাত্র ফেডারেশনের নেতা বিশ্বনাথ মুখার্জি, সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক গৌরীশংকর ভট্টাচার্য, প্রফুল্ল গোস্বামী, পবিত্র রায় প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনের মাধ্যমেই নন্দেশ্বর তালুকদার ছাত্র ফেডারেশন গড়ে তোলায় আগ্রহী হন।

ধুবড়িতে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তিনি কাকার বদলির সূত্রে গুয়াহাটিতে এসে কটন কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এখানে পড়ার সময়েই তিনি কমিউনিস্ট আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন নামক একটি গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। প্রসঙ্গত, ১৯৩৯ সালে ধুবড়ি হাই স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়েই তিনি ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রগ্রেসিভ ইউনিয়ন দ্বারা পরিচালিত লাইব্রে‍রিতে বিভিন্ন সময়ে আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অমিয় দাশগুপ্ত, সোমনাথ লাহিড়ী, ভূপেন্দ্র লাল মুখার্জির মতো কমিউনিস্ট নেতারা এসে বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা করেছেন। ১৯৪১ সালে নন্দেশ্বর তালুকদার প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং কটন কলেজেই আইএসসি-তে ভরতি হন।

স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণআন্দোলনে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ১৯৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে এই যুদ্ধের সমর্থনে ব্রিটিশ সরকার কটন কলেজে একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনীর আয়োজন করে। এই প্রদর্শনীর বিরোধিতা করে ৬ ডিসেম্বর অসম প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশন এবং অসম ছাত্র সম্মেলন এক সুবিশাল মিছিল সংগঠিত করে। এই মিছিলের ওপর ডিসি হামফ্রে সাহেবের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে লাঠি চালায়। পুলিশের এই আক্রমণে কটন কলেজের ছাত্র একতা সভার সম্পাদক নারায়ণ দাস সহ বেশ কয়েকজন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হন এবং নন্দেশ্বর তালুকদারকে একুশ দিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়। এই দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অসম জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে।

অসমে কমিউনিস্ট গ্রুপ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৩৮-৩৯ সালে। তখন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কমিউ‍‌নিস্ট পার্টির কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন ছিল না। গুয়াহাটিতে ১৯৪২ সালে প্রগ্রেসিভ ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িতরাই জোট বেঁধে কমিউনিস্ট গ্রুপ গঠন করেন। গৌরীশংকর ভট্টাচার্য, লোহিত লহকর, ধীরেশ্বর কলিতা, মাধব ডেকা, ভূধর বরুয়া, শিব সেন, মিনারাম শইকীয়া এবং নন্দেশ্বর তালুকদার এই কমিউনিস্ট গ্রুপ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।

কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার কটন কলেজে বিজ্ঞান শাখায় পড়ার সময়ে বিনা কারণে গ্রেপ্তার হন এবং ১৪দিন গুয়াহাটি জেলে থাকার পর মুক্তি পান। এরপর স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত থাকার জন্য বিভিন্ন সময়ে তাঁকে কারান্তরালে থাকতে হয়েছে।

কমিউনিস্ট পার্টি গঠন

১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে অসমের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে গোলাঘাটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আহ্বায়ক ছিলেন কমরেড যদু শইকীয়া। সভায় সভাপতিত্ব করেন কমরেড প্রাণেশ বিশ্বাস। এই সভা থেকেই সিপিআই-র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা সাংগঠনিক জেলা কমিটি গড়ে ওঠে। এই সভায় সর্বভারতীয় কমিটির পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কমরেড বিশ্বনাথ মুখার্জি। সুরমা উপত্যকার কমিউনিস্ট নেতা কমরেড বীরেশ মিশ্রও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। যদু শইকীয়াকে সম্পাদক এবং ধীরেন দত্ত, দধি মহন্ত, প্রাণেশ বিশ্বাস, কীর্তি বরদলৈ, ফণী বরা, চিদানন্দ শইকীয়া এবং নন্দেশ্বর তালুকদারকে সদস্য হিসেবে নিয়ে সিপিআই’র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা সাংগঠনিক কমিটি তৈরি হয়। গোলাঘাটের সভা থেকে গঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক জেলা কমিটির মাধ্যমে অসমে কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গ‍‌ড়ে তোলার সূচনা হয়।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৪৩ সালের ২৩ মে থেকে ১ জুন বোম্বাই (এখন মুম্বাই)-এ অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেসেই পার্টির অসম রাজ্য কমিটি গঠিত হয়। পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত রাজ্য কমিটির সদস্যরা ছিলেন বীরেশ মিশ্র, গৌরীশংকর ভট্টাচার্য, জ্যোতির্ময় নন্দী, চিত্তরঞ্জন দাস এবং বিষ্ণু বরা। সম্পাদক হন বীরেশ মিশ্র। রাজ্য কমিটি গঠিত হবার পর পার্টির কেন্দ্র গোলাঘাট থেকে গুয়াহাটিতে স্থানান্তরিত হয়। নবগঠিত রাজ্য কমিটি রাজ্যে গণসংগঠন গড়ার উদ্যোগ নেয়।

এদিকে ১৯৪২ সালে আইএসসি দ্বিতীয় বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর থেকেই কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে জড়িত হয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে জমিদার শাসিত অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলায় কৃষক সংগঠন এবং কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কমরেড প্রাণেশ বিশ্বাস এবং কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারকে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার কলেজ শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে পার্টির কাজে আত্মনিয়োগ করে সর্বক্ষণের কর্মীর জীবন শুরু করেন। প্রাণেশ বিশ্বাস, মণি ভৌমিক এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট কর্মীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি বর্তমানের ধুবড়ি, কোকরাঝাড়, বঙ্গাইগাঁও, ‍‌চিরাং, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জেলায় কৃষকদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে মনোনিবেশ করেন। কোকরাঝাড় শহর সংলগ্ন বড়ো জনজাতির চাষিদের পাশাপাশি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও সংগঠন গড়ে তোলেন। সেই সময়ে মানকাচর থেকে গারোবাধা পর্যন্ত হাজংদের মধ্যে কৃষকসভা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

কৃষক আন্দোলন

কৃষক সংগঠনের কাজে নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়ার সুবাদে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার ১৯৪৫ সালে নগাঁওয়ে ঠেকেরাগুড়িতে অনুষ্ঠিত কৃষকসভার প্রথম সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। এই বছরেই তিনি পূর্ববঙ্গের মৈমনসিংহ জেলার নেত্রকোনায় নিখিল ভারত কৃষক সভার সম্মেলনে প্রতি‍‌‍‌নিধি হি‍‌সেবে যোগদান করেন। নেত্রকোনা সম্মেলন পরবর্তীকা‍‌লে কৃষক আন্দোলনে জোয়ার সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘তেভাগা’ আন্দোলন। অবিভক্ত বাংলা ছাড়াও অসমের গোয়ালপাড়া এবং কাছার-শ্রীহট্টে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। আধিয়ার চাষিদের ফসলের তিনভাগের দু’ভাগ দেবার দাবিতে সংগঠিত তেভাগা আন্দোলন গোয়ালপাড়া জেলার মানকাচর থানার অন্তর্গত পুষ্করিণী পাড়া-পুঠিমারি প্রভৃতি অঞ্চল এবং সমীপবর্তী গারো পাহাড় অঞ্চলে গড়ে ওঠে। নেত্রকোনা সম্মেলনে অংশ নেওয়া কিশোরীমোহন সরকার, পবন সরকার প্রমুখের সঙ্গে নন্দেশ্বর তালুকদারও এই আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়ে‍‌ছিলেন। আন্দোলনের প্রভাবে জমির মালিকরা কৃষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই আন্দোলনের প্রভাবেই এই সমস্ত অঞ্চলে কৃষকসভার পাশাপাশি ছাত্র ফেডারেশনও গড়ে উঠেছিল। কোকরাঝাড় থানার অন্তর্গত ব্যাপক অঞ্চলেও কৃষকসভার সংগঠন বিস্তৃতি লাভ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের।

এই সময়কালেই বর্তমানে ধুবড়ি জেলার অন্তর্গত বগরিবাড়ি সীমান্ত অঞ্চল বাঁশবাড়ি, টিপকাই, মঙ্গলজোরা প্রভৃতি এলাকাসমন্বিত পর্বতজোরা অঞ্চলে একটি স্মরণীয় কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়। জনজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলটির মূল অধিবাসী ছিলেন বড়ো এবং কিছু সংখ্যক রাভা। বগরিবাড়ি জমিদারের মালিকানাধীন এই বনাঞ্চলের প্রজারা বনানীর রক্ষণাবেক্ষণ করতেন, বিনিময়ে কাঠ, বাঁশ, খড় ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারতেন। শাল, তিতাচাপা গাছ কেটে বিক্রি করলে বিক্রয়মূল্যের ছয়ভাগের একভাগ জমিদারকে দিতে হতো। কিন্তু অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ১৯৪৪ সালে এই নীতি পরিবর্তন করে ঠিকাদারকে কাঠের কুপ দেবার নীতি চালু করা হয়। এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কৃষকরা কৃষক সভার পতাকাতলে সমবেত হন, এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শৈলেন্দ্র ব্রহ্ম, দেবেন্দ্র ব্রহ্ম, ভূপেন বসুমাতারী, দালেন ব্রহ্ম প্রমুখ কৃষকরা। শুরুতে এই আন্দোলনের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন প্রাণেশ বিশ্বাস, রবীন বসুমাতারী প্রমুখ। কৃষকরা হাতে কুঠার নিয়ে কাজকর্ম করত, সেজন্য এই আন্দোলন কুঠারি আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তী সময়কালে নন্দেশ্বর তালুকদারও এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৫-৪৬ এই দু’বছর ধরে চলা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে অবশেষে কৃষকরা নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে সক্ষম হন। এই আন্দোলনের প্রভাবে অন্যান্য অঞ্চলেও কৃষক সংগঠন গড়ে তোলায় সহায়ক হয়েছিল।

তৎকালীন গোয়ালপাড়া জেলা এবং সংলগ্ন গারো পাহাড়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব এবং সংগঠনের প্রসার সহ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রিটিশ সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাই তারা দমন-পীড়নের নীতি গ্রহণ করে। তারই অঙ্গ হিসেবে ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পুষ্করিণীপাড়া অভিমুখে যাবার সময়ে পুলিশ গারোবাধায় নন্দেশ্বর তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে। আসাম মেইনটেনান্স অব পাবলিক অর্ডার আইন (এএমপিওএ)-এ গ্রেপ্তার করে তাঁকে তুরার কারাগারে রাখে। প্রায় সাড়ে সাতমাস কারারুদ্ধ থাকার পর ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ দেশের স্বাধীনতার ঠিক আগে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু মুক্তি দিলেও তাঁকে গোয়ালপাড়া এবং গারো পাহাড় জেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে লড়াই-আন্দোলন

দেশ স্বাধীন হবার পরেও কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী অংশের জীবন-জীবিকার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নন্দেশ্বর তালুকদারও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে কৃষক আন্দোলন তীব্র করার প্রচেষ্টা চালান। ১৯৪৭ সালে টিপকাইতে কৃষক সভার দ্বিতীয় রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জনজাতি অধ্যুষিত এই অঞ্চলে সম্মেলন আকর্ষণীয় ও সফলভাবে অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে নন্দেশ্বর তালুকদার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৪৮ সালের শুরুতে গুয়াহাটির আমবাড়িতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অসমের বিভিন্ন স্থানে কৃষক আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। অন্ধ্রপ্রদেশের তেলেঙ্গানা, অবিভক্ত বাংলার তেভাগা সহ ত্রিপুরায় গণমুক্তি পরিষদের নেতৃত্বে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম কৃষকদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে এবং অসমের কৃষকরা এই সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে অনুপ্রাণিত হন। এই সময়ে অসমের কৃষক আন্দোলনের মধ্যে কামরূপ জেলার জনজাতি অধ্যুষিত বেলতলা মৌজার কয়েকটি গ্রামের কৃষক আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজ্যজুড়ে তার প্রভাব বিস্তার করে। গুয়াহাটির আশপাশে সংগঠিত এই আন্দোলন বেলতলা কৃষক আন্দোলন হিসেবে জনপ্রিয় হয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, বেলতলা কৃষক আন্দোলনে কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিক ও শিল্পী-সংগ্রামী বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে। এই আন্দোলনের সূত্রপাত করে আরসিপিআই এবং ট্রাইবেল লিগ। পরবর্তী সময়ে এই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে সিপিআই এবং কৃষক সভা। কৃষক সভার দাবি ছিল উৎপাদিত ধানের তিনভাগের একভাগ। কিন্তু এই আন্দোলনকে দমন করতে স্বাধীন ভারতে অসম সরকার জমির মালিকের স্বার্থে পুলিশবাহিনী পাঠায় এবং নির্বিচারে কৃষক সভার নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার হন এই আন্দোলনের প্রথম সারির নেতা প্রাণেশ বিশ্বাস। তার আগে গ্রেপ্তার করা হয় ট্রাইবেল লিগ নেতা দেবেন খাকলারিকে এবং কারাগারে অসুস্থ হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় তাঁর মৃত্যু হয়। এই অবস্থায় পার্টির রাজ্য কেন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী নন্দেশ্বর তালুকদার ধুবড়ি থেকে এসে বেলতলা কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি ‘কুল খুরা’ নামে জনপ্রিয় কৃষকনেতা কুল বসুমাতারী সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আন্দোলন জারি রাখেন। কিছুদিন পর তিনিও গ্রেপ্তার হন। শেষপর্যন্ত ১৯৫১ সালে দেশের উচ্চ ন্যায়ালয়ের নির্দেশে নন্দেশ্বর তালুকদার সহ অন্যান্য বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, এই সময়ে তাঁদের গুয়াহাটি, নগাঁও জেলে রাখা হয়েছিল। গুয়াহাটি কারাগারে বন্দিদের প্রতি জেল কর্তৃপক্ষের অমানবিক আচরণ ও ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে দু’বার অনশন আন্দোলন করেন তাঁরা। জেলে থাকার সময়ে তাঁরা মে দিবস পালন ও বিতর্কসভা ইত্যাদি করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিহার জেল থেকে মুক্তি পান নন্দেশ্বর তালুকদার। এরপর তিনি গুয়াহাটিতে থেকে পার্টির কাজে মনোনিবেশ করেন এবং তাঁকে পার্টির কামরূপ জেলা কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এই সময়েই (১৯৫২) স্বাধীন ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের পাশাপা‍‌শি অসমে বিধানসভা নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি গুয়াহাটি কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। পার্টির প্রার্থী কমরেড গৌরীশংকর ভট্টাচার্য জেল থেকে মনোনয়ন দাখিল করেন এবং অসম বিধানসভায় প্রথম কমিউনিস্ট বিধায়ক হি‍‌সেবে নির্বাচিত হন। এই জয়ের কৃতিত্ব বহুলাংশেই ছিল প্রচারের দায়িত্বে থাকা কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের। তাঁর নেতৃত্বেই গুয়াহাটির নিকটবর্তী বকো অঞ্চলে জমির পাট্টাহীন কৃষকদের মধ্যে কৃষকসভা গড়ে ওঠে। কৃষকদের জমির পাট্টার দাবিতে কৃষক সভার ডাকে তাঁরই নেতৃত্বে বকো থেকে গুয়াহাটি দীর্ঘ ৭০ কিলোমিটার ব্যাপী কৃষকদের এক সুবিশাল পদযাত্রা হয়েছিল - যা অসমে কৃষক আন্দোলনে এক নজির সৃষ্টি করেছিল।

১৯৫৫-৫৬ সালে তিনি গুয়াহাটি পৌরসভায় প্রথম কমিউনিস্ট সদস্য হি‍‌সেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬৩ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি শিক্ষয়িত্রী নিরুপমা চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

মতাদর্শগত বিতর্ক - সিপিআই(এম) গঠন

পার্টির অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মতাদর্শগত বিতর্কের পরিণতিতে ১৯৬৪ সা‍‌লে পার্টির জাতীয় পরিষদের ৩২ জন সদস্য সিপিআই থেকে বেরিয়ে এসে সিপিআই(এম) গঠনের উদ্যোগ নেন এবং কলকাতায় অনুষ্ঠিত পার্টির সপ্তম কংগ্রেসে সিপিআই(এম) গঠিত হয়। অসমে সিপিআই(এম) গঠনে নেতৃত্বে ছিলেন কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, গোপেন রায়, সুরেন হাজারিকা, উমা শর্মা এবং নন্দেশ্বর তালুকদার। কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন এবং গুয়াহাটিতে একটি ভাড়া বাড়িতে কার্যালয় তৈরি করে পার্টির সাংগঠনিক কাজকর্ম শুরু হয়। সেই সময়ে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় পার্টির সংগঠন বিস্তার এবং বিভিন্ন গণসংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনন্য ভূমিকা পালন করেন নন্দেশ্বর তালুকদার।

১৯৬৮ সালে পাঠশালায় (বর্তমানে বজালি জেলার সদর) অনুষ্ঠিত কৃষক সভার রাজ্য সম্মেলনে নন্দেশ্বর তালুকদার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক-কর্মচারী ও রেল শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও একাত্ম ছিলেন এবং সেখানে পার্টি সংগঠন গড়ে তুলতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন। মূলত তাঁর উৎসাহেই কমরেড অমল ঘোষ দস্তিদার রাঙাপাড়ায় স্কুল শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক হন এবং রাজ্যে শ্রমিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি এবং ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গড়ার ক্ষেত্রেও কমরেড তালুকদার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষকরে তাঁর উদ্যোগ ও উৎসাহেই নগাঁও-তে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনের মধ্যদিয়ে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন গড়ে ওঠে। এই সম্মেলনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিমান বসু। ভারতীয় গণনাট্য সংঘ-র সাথেও তাঁর সম্পর্ক ছিল নিবিড়। প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশেও তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক প্রগতিশীল পত্রিকা ‘নতুন পৃথিবী’ প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ১৯৭০-র দশকেও কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারকে কয়েকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যেতে হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে অসমে বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সিপিআই(এম) এবং পার্টির অন্যান্য গণসংগঠন। এমনই একটি কঠিন পরিস্থিতিতে দলের রাজনীতি, কৌশল নির্ধারণ, সংগঠনের ওপরে দিন-রাত হওয়া আক্রমণ মোকাবিলার ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের ব‍‌লিষ্ঠ ভূমিকা গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

১৯৮২ সালে গুয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্মেলনে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি এ‍‌ই দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি অসমে জনতা পার্টির সরকারের সময়ে গঠিত কারাগার সংস্কার আয়োগের সদস্য হিসেবে এবং ১৯৯৬ সালে অগপ জোট সরকারের আমলে জাতীয় সংহতি পরিষদ-এর উপ-সভাপতি হিসেবে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।

এভাবেই সমাজ জীবন, রাজনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্মরণীয় অবদান রেখে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদার ২০০৩ সালের ২৭ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর জীবনাবসানের মধ্যদিয়ে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজের নিপীড়িত-শোষিত-পশ্চাৎপদ অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের পক্ষে আপসহীনভাবে লড়াই করা, নীতি-আদর্শে অবিচল, সর্বজন শ্রদ্ধেয় কমিউনিস্ট নেতার সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা সমাপ্ত হয়। অসমে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠন ও বিকাশের ক্ষেত্রে কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য এবং কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই প্রতিবেদকের অত্যন্ত গর্ব ও শ্লাঘার বিষয়, আশির দশকের গোড়ায় অসমে ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে পার্টির পরিবৃত্তে প্রবেশের মুহূর্তে তাঁর মতো একজন আদর্শনিষ্ঠ নেতার সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর হাতেই পার্টি সদস্যপদ অর্জনের সুযোগ হয়েছিল। অসমের কমিউনিস্ট আন্দোলন ও গণ-আন্দোলনের ইতিহাসে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের নাম উজ্জ্বল থাকবে বহুকাল।

জন্মশতবর্ষে কমরেড নন্দেশ্বর তালুকদারের স্মৃতির প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা ও সংগ্রামী অভিবাদন।


তথ্য সহায়তাঃ
● ‘অসমত কমিউনিস্ট আন্দোলনর বিকাশিত নন্দেশ্বর তালুকদারর অবদান’, প্রবন্ধ, হেমেন দাস।
● নন্দেশ্বর তালুকদার, শতবার্ষিকীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
● কৃতজ্ঞতাঃ সুপ্রকাশ তালুকদার।