৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮
‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে’
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সারা বছর অনেক তো লেখালেখি হলো। আগের লেখাতে বছরটাকে বিষে বিষে বিষক্ষয়ের বছর বলে লিখেছিলাম। অনেকগুলো ঘটনা পরপর ঘটে যাবার পর এখন মনে হচ্ছে হয়তো একুশে সত্যিই নতুন কিছু দিশা মিলেছে। অন্তত মেলার ইঙ্গিত দিয়েছে। একবার নাহয় ফিরে দেখা যাক ২০২১-কে।
।। এক ।।
২০২০-র ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ কৃষকদের ডাকা ভারত বনধ দিয়ে বছর শেষ হয়েছিলো। নতুন বছরের জানুয়ারি মাসটা ছিল কৃষক আন্দোলনের মাস। দেশ উত্তাল। উত্তাল গাজিপুর, টিকরি, সিঙ্ঘু। উত্তাল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ। তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে চলছে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান বিক্ষোভ। যে আন্দোলন সম্পর্কে তৎকালীন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ জানিয়েছিলেন - “ ‘টুকরে টুকরে গ্যাং’ দেশে কৃষক আন্দোলন থেকে সুবিধা নিচ্ছে। দেশ ভাঙার এই কারিগরদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” কেন্দ্রীয় সরকারের উপভোক্তা বিষয়ক দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী রাওসাহেব দানভে বলেছিলেন, ‘‘দেশে এখন কৃষকদের যে আন্দোলন হচ্ছে তা আদৌ কৃষক আন্দোলন নয়। এর পেছনে চীন এবং পাকিস্তানের হাত আছে। এর আগে মুসলিমরা এই জিনিস প্রথম শুরু করেছিল। তারা বলেছিল, এনআরসি আসছে, সিএএ আসছে, মুসলিমদের ছয় মাসের মধ্যে দেশ ছাড়তে হবে। একজনও মুসলিমকে দেশ ছাড়তে হয়েছে কী? এখন কৃষকরা একই সুরে কথা বলছে। এটা আসলে অন্য দেশের চক্রান্ত।’’
তখন আন্দোলনের বয়স প্রায় দু’মাস। ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কৃষকরা ডাক দেয় ট্র্যাক্টর প্যারেডের। দলে দলে কৃষক ট্র্যাক্টর নিয়ে ঢুকে পড়েন দিল্লিতে। এদিনই এই প্যারেডকে নিয়ে দিল্লির কিছু অঞ্চলে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকটা সেই শাহিনবাগ পর্বের শেষদিকের ঘটনার মতো। ২৬ জানুয়ারি সবথেকে নজর কেড়েছিল লালকেল্লার ঘটনা। আইটি সেলের প্রচার অনুসারে লালকেল্লা থেকে জাতীয় পতাকা নামিয়ে কৃষকরা নাকি খালিস্তানি পতাকা তুলে দিয়েছে। যদিও সেরকম কিছুই যে ঘটেনি তা ঘটনার ভিডিয়ো ফুটেজ থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। খালিস্তানি পতাকা বলে যা প্রচার করা হয়েছিল তা ছিল শিখদের ধর্মীয় পতাকা। যদিও সবথেকে বেশি সন্দেহ দানা বেঁধেছিল যে ব্যক্তি ওই পতাকা লাগিয়েছিলেন তাঁকে নিয়ে। লালকেল্লার ঘটনায় মূল যে অভিযুক্ত তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ’র ছবি ভাইরাল হয়ে গেছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এই প্রসঙ্গে এক ট্যুইট বার্তায় বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ দীপ সাধুর দু’টি ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন- ‘‘মোদি এবং শাহের সাথে দীপ সিধু। উনিই আজ লালকেল্লাগামী উত্তেজিত জনতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এবং লালকেল্লায় গিয়ে শিখদের ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করেছেন।’’ পরের একটি ট্যুইটে এই ঘটনার ভিডিয়ো পোস্ট করে তিনি লেখেন, ‘‘কৃষক আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করে বিজেপি কী ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা করছে?’’
এই প্রসঙ্গে আরও অনেক কথাই লেখা যেত। প্রশাসনের কৃষক আন্দোলন ভাঙার চেষ্টার কথা লেখা যেত। আন্দোলনের চাপে ভীত হয়ে আন্দোলনস্থলের বিদ্যুৎ সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, জল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবার কথা লেখা যেত। কৃষকদের আন্দোলন ভাঙতে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, পেরেক, গজাল, তারের ফেন্সিং লাগানোর কথা লেখা যেত। সরকারের রক্তচক্ষু উড়িয়ে জেলায় জেলায়, রাজ্যে রাজ্যে কৃষকদের মহাপঞ্চায়েতের কথা লেখা যেত। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকাদের ট্যুইট যুদ্ধের কথা লেখা যেত। তার বিরোধিতায় রাতারাতি অক্ষয় কুমার থেকে শচীন তেন্ডুলকরের ঘুম ভাঙার কথা লেখা যেত। কিন্তু এত কথা ২০২১ জমিয়ে দিয়েছে, ধিকি ধিকি বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে শুরু থেকেই তার সবটুকু লিখে ফেলার মতো ক্যানভাস কই?
।। দুই ।।
তখন সবে ‘বসন্ত এসে গেছে’। দিনক্ষণ ঘোষণা না হলেও রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেছে। আর নতুন মরশুম শুরুর আগেই ‘খেলা হবে’র ময়দানে তখন দলবদলের উঠতি হাওয়া। সারা দেশে বিকাশ সম্পূর্ণ হওয়া এবং আচ্ছে দিন এসে যাবার পর তখন ডেস্টিনেশন বাংলা।
সোনার বাংলা গড়ার প্রতিশ্রুতি। সেই সোনার বাংলা - যেখানে বিদ্যাসাগর সহজপাঠ লেখেন, গোরুর দুধে সোনা খুঁজে পাওয়া যায়। এতদিন যাঁদের দিকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ ‘তোলাবাজ’ বলে আঙুল তোলা হতো, দলবদলের পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে হঠাৎ দেবদূতে পরিণত হওয়া সেইসব ‘সফেদ’ নেতা-নেত্রীরাই কর্তা মন্ত্রী হবেন। ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গিয়ে নবরূপে সোনার বাঙলা দেখতে দেখতে সাধ মিটবে বাঙালির।
সাধারণ মানুষ কিছুটা কনফিউসড হয়ে পড়েছিল ঠিক কথা। যদিও দলবদল যে খুব ভালো জিনিস তা নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিলনা দলবদলুদের। একঘেয়েমি কাটাতে মাঝে মাঝে দলবদল শরীর ও পকেট - দু’য়ের পক্ষেই ভালো। মানুষের জন্য আরও বেশি কাজ করার সুযোগ পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে এক মহান উদ্দেশ্য নিয়েই জনগণের সেবার্থে দলবদল করা বা করানো হয়। শুধু যে কাকু বা দাদাকে লাল বা নীল দেখে রাতে মানুষ ঘুমোতে যায় সকালে যখন সেই কাকু বা দাদা গেরুয়া বা সবুজে রূপান্তরিত হয়ে নবরূপে আবির্ভূত হন তখন ঘুমের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগে। মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেয় দলবদল, দলে থেকে কাজ করতে পারছি না বলে দলবদল, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই সরকার থাকলে কাজ করতে সুবিধে হবে বলে দলবদল-এর নানা ধাপ ও পদ্ধতি আছে। সেই ফুলসূত্র অবলম্বন করেই এফুল থেকে ওফুল। সে এক বিষম ‘অফুল’ ব্যাপার।
শুধু একটাই কথা। যে যে জনপ্রতিনিধি বা নেতারপাল বলেছিলেন যে ‘মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছেয় দলবদল’ ‘তাঁদের’ এই কথা বলার অর্থ - তিনি এতদিন মানুষের জন্য কাজ করেননি। এতদিন কেন সেকথা বলেননি, কেন মানুষের জন্য কাজ করেননি সে প্রশ্ন তাঁকে পাল্টা করা যেতেই পারতো। যদিও সেই প্রশ্ন দু’চারটে বেআক্কেলে বামপন্থী ছাড়া আর কেউই করেনি। সকলেই চোখ বন্ধ করে আর কানে তুলো দিয়ে বলে গেছে চলতে থাকুক চলতে থাকুক চলতে থাকুক।
অবশ্য ফেব্রুয়ারিতে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। শব্দভাণ্ডারে নতুন শব্দ যোগ করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ‘আন্দোলনজীবী’। ৮ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত তিন কৃষি আইন, কৃষক আন্দোলন, সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদসূচক প্রস্তাব রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন- ‘‘আমরা শ্রমজীবী শব্দটা শুনেছি। কিন্তু এখন একটা নতুন প্রবণতা এসেছে ‘আন্দোলনজীবী’। এই আন্দোলনজীবীদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশকে বাঁচাতে হবে। এই আন্দোলনজীবীদের চিহ্নিত করতে হবে। কারণ এঁরাই দেশের অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। এই আন্দোলনজীবীরাই দেশের ‘পরজীবী’। এই ‘পরজীবী’দের তুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।” (আবাপ ডিজিটাল, ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১)
।। তিন ।।
ভোটের ভরা বাজার। ততদিনে জেড প্লাস ক্যাটাগরির ৫৫জন নিরাপত্তা রক্ষীর নিরাপত্তা বলয়ে থাকা মুখ্যমন্ত্রীকে ধাক্কা মেরে কেউ বা কারা পা ভেঙে দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বাঁ পায়ে চোট লাগা সত্ত্বেও কীভাবে যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো এক ডান পায়ের ছবি মুখ্যমন্ত্রীর পায়ের ছবি বলে ভাইরাল হয়ে যায়। অন্যদিকে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নদীর এপার থেকে ওপারে সকাল বিকেল নেতা নেত্রীরা পৌঁছে যাচ্ছেন মানুষের জন্য কাজ করবেন বলে। সকালে পাকা আমের মত টুপ টুপ করে খসে পড়া। ফড়ে, দালালদের হাত ঘুরে ঝাঁকা ভরতি হয়ে বিকেলে বাজারে বিক্রি হওয়া - ক্রমশ চোখ সয়ে গেছিল। একদিকে সাপের হিসহিসানি, এক ছোবলেই ছবি করে দেবার প্রছন্ন নায়কোচিত হুমকি, বাপ মা ধরে টানাটানি-অন্যদিকে গোরু ছাগল আলু পটলের দেদার বিকিকিনি।
সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন - রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থী ঝোঁকের বিপদ এখানেই। যা করা হয় তা আপাতদৃষ্টিতে অপরিকল্পিত বলে মনে হলেও পুরোটাই পরিকল্পিত। সাধারণ মানুষকে তাঁদের দাবি দাওয়া লড়াই সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দিতে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করা যাতে মানুষ রাজনীতিকে ঘেন্না করতে শুরু করে। এ খেলার একটাই উদ্দেশ্য - মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করে তোলা। তাই রাজনৈতিক ময়দানে অ-রাজনীতির মানুষের ভিড় বাড়ানো।
এসব বাজে কথা আপাতত থাক। এবছরের মার্চ মাসেই কেন্দ্রীয় সরকারের নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইন প্রসঙ্গে এডিটরস গিল্ড প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিল- ‘‘তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রক আইন, ২০২০ অনুসারে কোনোরকম আইনি নির্দেশিকা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার দেশে যে কোনও সময়, যে কোনও জায়গার খবর ব্লক করে দিতে, মুছে দিতে বা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই আইনের বিভিন্ন ধারা অনুসারে অকারণেই ডিজিটাল মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সরকার। এই ধরনের নির্দেশিকা জারির আগে কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনোরকম আলোচনাই করছে না। এই মর্মে কেন্দ্রের একটি বিষয়ের উপর অবশ্যই খেয়াল রাখা উচিত যে, সোশ্যাল মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ করে ভারতের সংবিধানের মিডিয়া স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। যা দেশের গণতন্ত্রকে একপেশে করে দিচ্ছে।’’
।। চার ।।
রাজ্যে ভোট চলছে। ‘অবাধ ও শান্তিপূর্ণ’ নির্বাচনে ১০ এপ্রিল লাশ হয়ে গেছে আমারই রাজ্যের পাঁচ জন। শীতলকুচি কেন্দ্রের ১২৬ নম্বর বুথে। জোড়পাটকি অঞ্চলের বেলতলি গ্রামের এই বুথে এক গণ্ডগোলকে কেন্দ্র করে নাকি সিআইএসএফ বাহিনী গুলি চালায় এবং ৪ জনের মৃত্যু হয়। তাঁরা হলেন - নূর আলম, হাবিবুর মিয়াঁ, সামিউল মিয়াঁ এবং মণিরুল মিয়াঁ। এদেরও সকলের বয়স ২২ থেকে ২৫-এর মধ্যে। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ওইদিনই শীতলকুচির পাঠানটুলি এলাকার ২৬৫ নম্বর বুথের সামনে তৃণমূল-বিজেপি’র সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয় আনন্দ বর্মণের। যে ঘটনা নিয়ে বেমালুম ভুয়ো ছবি পোস্ট করে দেন শুভেন্দু অধিকারী সহ একাধিক বিজেপি নেতা। দেশের আইন অনুসারে কোনো নাগরিক যদি ভুয়ো ছবি বা তথ্য দেন তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অবশ্য সাধারণ নাগরিক আর অসাধারণ নেতা নেত্রী - সবার জন্য আইন একরকম হতেই হবে একথা কোথায় লেখা আছে?
এই সময়েই হরিদ্বারে চলছিল মহাকুম্ভ মেলা। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশে করোনাবিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলেছে একাধিক ‘শাহি স্নান’। বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তীরথ সিং রাওয়াত জানিয়েছিলেন - ‘‘মানুষের স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ বটে। কিন্তু ধর্মকে কোনোভাবেই অবহেলা করতে পারবো না।” তিনি আরও জানান, কুম্ভ মেলা ও তবলিগি জামাতকে কোনোভাবেই এক করা যায় না। পরিস্থিতি। ১৪ এপ্রিল সকালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান জানায় শেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে সংক্রমিত হয়েছেন ১,৮৪,৩৭২জন। হুহু করে বাড়ছে সংক্রমণ। ২০ এপ্রিল রাত ৮.১৫-তে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯ মিনিটের ভাষণে ভয়ঙ্কর করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের দায় এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া বিশেষ কিছু সেখানে ছিল না।
করোনা নাকি প্রায় জয় করে ফেলেছিল ভারত! থালা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, ভাবিজি পাঁপড় খেয়ে, গায়ে গোবর মেখে, রামদেবের করোনিল খেয়েই নাকি করোনা দূর হয়ে যাবে! প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পারিষদবর্গ থেকে শুরু করে আট আনা, চার আনা, দশ পয়সা, পাঁচ পয়সাদের দাবি ছিল সেরকমই। গত বছর করোনাকে সামনে ঢাল রেখে একের পর এক ‘বৈপ্লবিক’ পদক্ষেপ নিয়ে দেশকে ‘আত্মনির্ভর’ করার পথে এগিয়ে দেয় দেশের সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ, শ্রম আইনের বারোটা বাজিয়ে দেওয়া, বিতর্কিত কৃষি আইনের প্রবর্তন, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা তছনছ করে দেওয়া, বিমা ক্ষেত্রে বিদেশিদের জন্য দরজা হাট করে খুলে দেওয়া, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, পেট্রোল ডিজেলের দাম সেঞ্চুরির দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া, শিক্ষা-স্বাস্থ্য লাটে তুলে দেওয়া, পি এম কেয়ারস ফান্ডে বিপুল পরিমাণে টাকা জমা পড়া (যার কোনো হিসেব সরকার দেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে) - সবই হয় একতরফাভাবে। সংসদে বিরোধীদের মতামতের তোয়াক্কা না করেই।
যদিও করোনাকে তাড়ানো যায়নি। বরং আরও শক্তি সঞ্চয় করে বিপুল বেগে ফিরে আসে। ২২ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার সকালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে শেষ ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমিত হন ৩ লক্ষের বেশি মানুষ। শেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। রাজ্যে রাজ্যে অক্সিজেনের আকাল। দেশের বহু হাসপাতাল অক্সিজেন শূন্য। অক্সিজেনের অভাবে মানুষের মৃত্যুও ঘটেছে একাধিক জায়গায়। ঘটা করে টিকাকরণ উৎসবের কথা ঘোষণা করলেও অধিকাংশ রাজ্যে পর্যাপ্ত টিকার হদিশ ছিলোনা। আর প্রধানমন্ত্রীর ১৯ মিনিটের ভাষণে এসব নিয়ে ছিলনা একটা শব্দও।
২৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ছিলো ৩ লক্ষ ৭৯ হাজার ২৫৭জন। ভারতে এবং বিশ্বে করোনাকালে এটাই ছিলো সর্বাধিক দৈনিক সংক্রমণ। শেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছিলো ৩ হাজার ৬৪৫জনের। এর আগে কয়েকদিন ধরে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে একাধিক গণচিতার ছবি ছাপা হয়েছে। সে ছবি কারোর কাছেই স্বস্তিদায়ক নয়। সাধারণ মানুষের মনে সে ছবি অস্বস্তি জাগিয়েছে আরও বড়ো বিপর্যয়ের আশঙ্কায়। আর সরকারের কাছে সে ছবি অস্বস্তির গদি বাঁচানোর তাড়নায়। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে সরব হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদমাধ্যম। এটাকে কি আন্তর্জাতিক লজ্জা বলা যেত?
।। পাঁচ ।।
স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৩ বছরে এই প্রথম বিধানসভায় কোনো বাম, কংগ্রেস প্রতিনিধি নেই। হিন্দু, মুসলিম, ফ্যাসিস্ট শক্তি, বিজেমূল, কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, করোনা, লেসার এভিল, মিডিয়া বাইনারির জগাখিচুড়িতে গত ১০ বছর বারবার প্রতিবাদে সরব হওয়া বামেরা বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের বিচারে শূন্য। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় দ্য হিন্দুতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন - ‘‘সিপিএম-কংগ্রেস ভোট স্যুইং করে তৃণমূলকে জিতিয়ে দিয়েছে। নাহলে বিজেপি-ই সরকার গড়তো।’’ ২০১৯ এ মিডিয়া প্রচার করেছিল ‘বামের ভোট রামে গেছে’ বলেই বিজেপি জিতেছে। আর ২০২১-এর প্রচার ‘জোটের ভোট জোড়াফুলে গেছে বলেই তৃণমূলের জয়’। ‘দূরবিন দিয়ে দেখতে পাওয়া যায় না’ যাদের, তাদের এতটাই ক্ষমতা যে তারা নিজেদের শূন্য করে একবার বিজেপি-কে জিতিয়ে দিচ্ছে, একবার তৃণমূলকে। বামেদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করার পরিকল্পিত এই প্রচারের পেছনে কত কোটি টাকার গোপন লেনদেন - তার জবাব গোদি মিডিয়া কোনোদিনই দেবেনা। তবে অপারেশন হয়েছে মসৃণভাবেই। দোদুল্যমান, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে দেওয়ার খেলা সফল।
এর পাশাপাশি দেশে তখন গঙ্গা যমুনা জুড়ে মৃতদেহ ভাসছে। বালির চরে থরে থরে দেহ পুঁতে দেবার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। সাধারণ মানুষ, কিছু মিডিয়ার দাবি - সব দেহই নাকি করোনা সংক্রমণে মৃতদের। শ্মশানে দীর্ঘ লাইন, কাঠের অভাব, পোড়ানোর খরচ সামলাতে না পেরে অনেকেই কম খরচে কাজ সারছেন। সরকার যখন ভরসা দিতে পারেনি তখন ‘মা গঙ্গাই ভরসা’। ১৩ মে সকালে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে শেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৬২ হাজার ৭২৭ জন। শেষ ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছিল ৪ হাজার ১২০ জনের। ৮ মে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ল্যানসেট জার্নালের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে বলা হয় - ‘করোনা আবহে সংক্রমণ ঠেকানোর থেকে সমালোচনামূলক ট্যুইট মুছতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার’। ‘করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
।। ছয় ।।
সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমির (CMIE) প্রধান মহেশ ব্যাস জানিয়েছেন - দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় ১ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং গত বছরের মহামারীর শুরুর সময়ের তুলনায় প্রায় ৯৭ শতাংশ বাড়িতে রোজগার কমেছে। না এই বিষয়ে কারোর কোনো বক্তব্য ছিল না। জিডিপি হ্রাস নিয়েও নয়। বক্তব্য ছিল অন্য বিষয়ে।
উত্তর প্রদেশ, বিহারের গঙ্গায় ভেসে আসা সন্দেহভাজন করোনার দেহ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন গুজরাতি কবি পারুল খাখর। কবিতার নাম ‘শব বাহিনী গঙ্গা’। গুজরাট সাহিত্য আকাডেমির প্রকাশনা ‘শব্দশ্রুতি’-র জুন সংস্করণের সম্পাদকীয়তে এই কবিতা নিয়ে জোরদার সমালোচনা করা হয়। কবি এই কবিতার মাধ্যমে নৈরাজ্য ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে দাবি করা হয় সম্পাদকীয়তে। যে বা যাঁরা এই কবিতাটি নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁদের ‘লিটারারি নকশাল’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে। আরও বলা হয়েছে, কবিতাটিতে কেন্দ্র বিরোধী মতাদর্শ প্রদর্শন করা হয়েছে। যে শব্দ কবিতাতে ব্যবহার করা হয়েছে, তা কেন্দ্র বিরোধীদের দ্বারা অপব্যবহার করে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কবিতার মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত হতে পারে। যাদের উদ্দেশ্য ভারতের জন্য কিছু করা নয়, বরং অন্যকিছু তারাই এমনটা করতে পারে। মূলত বামপন্থী, যাদের কেউ তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না, তারাই এমনটা করে থাকেন। এই ধরনের মানুষরাই দেশে চট করে হইচই তৈরি করে নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরি করে। নিজেদের খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই এইসব মানুষ সাহিত্যকে হাতিয়ার করে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে।
।। সাত ।।
নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মাদ্রাজ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল ডিজিটাল নিউজ পাবলিশার্স অ্যাসোসিয়েশন। আবেদনকারীদের পক্ষে বর্ষীয়ান আইনজীবী পি এস রমন জানান, এই আইনের দুটি ধারা মূলত ডিজিটাল নিউজ প্ল্যাটফর্মের জন্য অসুবিধা সৃষ্টি করছে। ১৬নং ধারাটি কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সচিবকে সহজেই ডিজিটাল ইনফরমেশন প্ল্যাটফর্মকে ব্লক করে দেওয়ার অধিকার দেয়। ভারতের নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এই নতুন তথ্যপ্রযুক্তি আইন রাষ্ট্রসংঘ-এর মানবাধিকারের নিয়ম মেনে তৈরি হয়নি বলে মনে করছে রাষ্ট্রসংঘ। রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কমিশন অফিসের তরফে প্রকাশিত রিপোর্টে এমনটাই উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে মহামারী ও কৃষক আন্দোলনের সময়ে এই নতুন নিয়মগুলো প্রণয়ন করা হয়েছে সরকারের নিজের উদ্দেশ্যে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি তথ্য আদানপ্রদান ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বাধীনতাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার সকলের সমানভাবে আছে।
এই সময়েই দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমান্তের গাজিপুরে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় বিজেপি কর্মীরা। পাল্টা আক্রমণে যান কৃষকরাও। কৃষকদের অভিযোগ, বিজেপি কর্মীরা তাঁদের আন্দোলনস্থলে ঢুকে মঞ্চের কাছে গিয়ে স্লোগান দিতে দিতে জিনিসপত্র ভাঙচুর করা শুরু করে। ৫ জুলাই এনআইএ-র হাতে গত ৯ মাস আটক থাকা আদিবাসী অধিকার রক্ষা কর্মী, মানবাধিকার কর্মী ৮৪ বছর বয়স্ক স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু হয়। যে মৃত্যুকে অনেকেই বলেছেন ‘ঠান্ডা মাথার খুন’। বলতে এবং শুনতে খারাপ লাগলেও এই মৃত্যুও একটা বড়ো অংশের মানুষের কাছেই কোনো বিপদসংকেত বলে মনে হয়নি।
তবে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা বোধহয় আদানিকে নিয়ে। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ৬টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণ করা হবে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদানি গ্রুপ এয়ারপোর্ট ক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং ৬টি এয়ারপোর্ট পায়। ২০২০-র ২৮ জুলাই তারিখে জিভিকে গ্রুপের একাধিক অফিসে ইডি তল্লাশি চালায় দুর্নীতির অভিযোগে। এরপর ২০২০ সালের জুলাই মাসে জিভিকে গ্রুপ আদানি গ্রুপের কাছে তাদের মুম্বাই এয়ারপোর্টের অংশের শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ২০২১ সালের জুলাই মাসে আদানি গোষ্ঠী মুম্বাই এয়ারপোর্ট অধিগ্রহণ করে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে ক্রোনোলজি মেনে কাকতালীয় কিছু খুঁজে পেলে আমার কিছু করার নেই।
এই বছরেরই ৮ জুলাই হইচই শুরু হয়ে যায় পেগাসাস নিয়ে। যেদিন ডিজিট্যাল মিডিয়া ‘দ্য ওয়্যার’ ইজরায়েলি এক সংস্থার তৈরি করা নজরদারি অ্যাপ নিয়ে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশেও এই সংক্রান্ত একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। যার মধ্যে রয়টার্স, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা, লা মঁদ সহ পৃথিবীর ১৬টা বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম আছে। জানা গেছিল, পেগাসাস এক সামরিক গ্রেডের স্পাইওয়্যার, যা এক লাইসেন্সপ্রাপ্ত ইজরায়েলি সংস্থা যে কোনো দেশের সরকারকে সন্ত্রাসবাদী ও অপরাধীদের সন্ধানের জন্য বিক্রি করে। এই স্পাইওয়্যার ব্যবহার করেই সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, ব্যবসায়ী এবং নিহত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির ঘনিষ্ঠ দুই মহিলা সহ ৩৭ জনের স্মার্টফোন সফলভাবে হ্যাক ব্যবহার করা হয়েছিল। এই দাবি করেছে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। ভারতের ক্ষেত্রে দ্য ওয়্যারের রিপোর্ট অনুসারে, দেশের প্রায় ৪০ জন সাংবাদিক, একাধিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী, ব্যবসায়ী সহ ৩০০-র বেশি মোবাইল নাম্বার হ্যাক করেছে পেগাসাস স্পাইওয়্যার। যেখানে দেশের ৩ প্রধান বিরোধী দলনেতা, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি, ৪০ জনের বেশি সাংবাদিক, নিরাপত্তা কর্মী, ব্যবসায়ী, বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী এবং বেশ কিছু সরকারি আধিকারিক ছিলেন।
লোকসভায় ২৫ জুলাই কেন্দ্রীয় কর্পোরেট প্রতিমন্ত্রী ইন্দরজিত সিং জানিয়েছেন, ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত ভারতে ১৬,৫২৭টি কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে। এমসিএ পোর্টালের তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে ৪ লক্ষ ৩৭৫টি কোম্পানি লাভের মধ্যে চলছিল, আর লোকসানে চলছিল ৪ লক্ষ ২ হাজার ৪৩১টি কোম্পানি। এইসব বন্ধ হওয়া কোম্পানির শ্রমিকরা কোথায় গেলেন বামপন্থীরা ছাড়া সে প্রশ্ন কেউ তোলেনি!
।। আট ।।
২ আগস্ট রাষ্ট্রায়ত্ত সাধারণ বিমা বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে বিল পাশ হয় লোকসভায়। বিরোধীদের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করেই বিল পাশ হয়। এতদিন নিয়ম ছিল বিমা সংস্থাগুলোয় সরকারের অংশীদারি থাকবে ৫১ শতাংশ। কিন্তু সেই নিয়ম তুলে নেওয়া হয় নতুন এই বিলে। বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে ৪ আগস্ট চারটি সাধারণ বিমা সংস্থায় ধর্মঘট করেন কর্মীরা। এই সময়েই কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রকের ডিপার্টমেন্ট অফ ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট সচিব সম্প্রতি ট্যুইট করে জানান, বেসরকারিকরণ আবার সঠিক পথে ফিরছে। এবছরে বিক্রি করা হবে এয়ার ইন্ডিয়া ও ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। এবারের তালিকায় রয়েছে আরও ৩৫ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। নিলামে তোলার কাজ এই বছরই শেষ হবে। মোট ১৭১টি রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক সংস্থা বিক্রি করা হবে।
নাজিবুল্লা সরকারের পতনের গন্ধে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি লস এঞ্জেলস টাইমসে আর্টিকেল লিখেছিলেন আশরাফ ঘানি-‘আফগানিস্তানের পতন এখন সময়ের অপেক্ষা।’ ২০২১-এর ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবান। বর্তমান প্রেসিডেন্ট সেই আশরাফ ঘানির প্রাসাদে বসেই আলোচনা হয় তালিবানিদের সঙ্গে। এরপর নিরাপদে, বিনা বাধায় প্রায় ১৬৯ মিলিয়ন ইউ এস ডলার সঙ্গে নিয়ে সবার আগে দেশ ছেড়ে পালান ১৯৮৯ সালে উল্লসিত, বর্তমান ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আশরাফ। পরবর্তী সময়ে কাবুল বিমানবন্দরে শয়ে শয়ে মানুষের দৌড়, মানুষের বিমান বন্দরে ঢুকতে চাওয়ার আর্তি, সুস্থভাবে বাঁচতে চেয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে চাওয়া মানুষের উড়ন্ত বিমান থেকে খসে পড়া, দেশের পতাকা নিয়ে মিছিল করা সাধারণ আফগান নাগরিকদের ওপর তালিবানি বাহিনীর গুলিচালনা, বিউটি পার্লারের সামনে মহিলাদের ছবি সাদা রঙ দিয়ে ঢেকে দেওয়া, কালাশনিকভ নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় তালিবানি বাহিনীর টহলদারি - এসব সামান্য কিছু উদাহরণ মাত্র।
।। নয় ।।
জ্যঁ দ্রেজে, ঋত্বিকা খেরা, বিপুল পাইকারা, নিরালি বাখলার মতো বিশিষ্টরা ‘লকড আউট: ইমারজেন্সি রিপোর্ট অফ স্কুল এডুকেশন’ নামে এক রিপোর্ট তৈরি করেন। দেশের ১৫টি রাজ্যে সমীক্ষা চালিয়ে ৩২ পাতার এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়। রিপোর্ট জানিয়েছিল, গ্রামাঞ্চলের ২৮ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৪৭ শতাংশ ছাত্র ছাত্রী লকডাউনের সময় পড়াশোনা করতে পেরেছে। অর্থাৎ গ্রামাঞ্চলে ৭২ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলের ৫৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গত দেড় বছর ধরে পড়াশোনার বাইরে। ওই রিপোর্টই জানায়, মোট ৪৮ শতাংশের বেশি ছাত্রছাত্রী অক্ষর ভুলে গেছে। শহরাঞ্চলের ৭৬ শতাংশ এবং গ্রামাঞ্চলের ৭৫ শতাংশ অভিভাবক মনে করছেন এই সময় সন্তানদের পড়ার অভ্যাস পুরোপুরি চলে গেছে। শহর এবং গ্রামের ৯০ এবং ৯৭ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন অবিলম্বে স্কুল খুলে দেওয়া উচিত। বহু ছাত্রছাত্রীই অনলাইন শিক্ষার জন্য উপযুক্ত সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে পারেনি। অনলাইনে ক্লাস করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আর্থিক অনটন, স্মার্টফোন না থাকা, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকার দরুণ পড়াশোনা ব্যাহত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় অধিকাংশেরই ভালো স্মার্টফোন নেই। আদিবাসী ও দলিত পড়ুয়াদের অবস্থা আরও শোচনীয়। পড়ুয়াদের পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে লকডাউনে। অনলাইনে পড়াশোনার বিরুদ্ধেও মত পোষণ করেছেন তারা। এসব কথা বরং থাক।
।। দশ ।।
এ বছরের নৃশংসতম ঘটনা অবশ্যই লখিমপুর খেরির। ৩ অক্টোবর লখিমপুর খেরিতে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত কৃষকদের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে পিষে মেরে ফেলা হয় ৪ জন কৃষককে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তরের প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনির ছেলে আশিস মিশ্র টেনি নাকি সেই গাড়িতে ছিলেন। দেশজুড়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ হয়। যদিও কৃষকদের দাবি সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে মন্ত্রীসভা থেকে সরানো হয়নি।
এই সময়েই ১৫ অক্টোবর কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড এবং ওয়েলথহাঙ্গারলাইফ যৌথভাবে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক ২০২১ রিপোর্ট প্রকাশ করে। যে রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৭.২ স্কোর নিয়ে “ভয়াবহ” তালিকাতে ভারত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১০৭ দেশের মধ্যে ভারতের মধ্যে অবস্থান ৯৪। গত বছর ১১৭টি দেশের মধ্যে ১০২ নম্বরে এবং ২০১৮ সালে ১১৯টি দেশের মধ্যে ১০৩ নম্বরে ছিল ভারত। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। প্রায় ৩৭.৪ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার, অর্থাৎ বয়স অনুপাতে এদের দৈর্ঘ্য এবং ওজন কম। এই কারণেই বহু শিশুর মৃত্যু হচ্ছে দেশে, যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক।
।। এগারো ।।
হঠাৎ করে পদ্মশ্রী পাবার পরেই কঙ্গনা রানাওয়াত-এর মনে হয় ৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল ‘ভিক্ষা’। ঘটা করে শহর কলকাতার বুকে পালিত হয় নাথুরাম গডসের জন্মদিন। সম্ভবত কলকাতা শহরের বুকে এই প্রথম। উত্তরপ্রদেশের কানহা গোশালায় লাউডস্পিকারে গোরুদের ভজন শোনানোর ব্যবস্থা এই সময়েই। গোরুদের জন্য উত্তর প্রদেশের আট জেলায় ব্যবস্থা করা হয় অ্যাম্বুলেন্সেরও। প্রায় ৫১৫টি অ্যাম্বুলেন্স রাস্তায় নামার জন্য তৈরি। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ভূপালে ইন্ডিয়ান ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ‘শক্তি-২০২১’ কনভেনশনে গিয়ে জানান, গোরু, গোবর এবং গোমূত্র একজন ব্যক্তির পাশাপাশি দেশের আর্থিক বৃদ্ধি ঘটাতে পারে। যদি আমরা চাই তাহলে নিজেরাই গোরু, গোবর এবং গোমূত্রের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতির উন্নতি করতে পারি।
৯ নভেম্বর এক বিবৃতিতে মেটা (ফেসবুকের মাদার কোম্পানি) জানায়, ২০২১ সালের প্রথমার্ধে ভারত থেকে ‘মেটা’কে ৪৫,২৭৫ জন ব্যবহারকারী সম্পর্কিত তথ্য (Data) সরবরাহ করতে বলা হয়েছিল। এর আগের জুলাই-ডিসেম্বর ২০২০ সময়কালে, ভারত সরকারের মোট অনুরোধ ছিল ৪০,৩০০টি। এছাড়াও ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ফেসবুককে আরও ৬৮,৪৮৫ জন ব্যবহারকারীর তথ্য সরবরাহ করার অনুরোধ করা হয়। নজরদারি কি শুধু পেগাসাসই করে?
এই সময়েই ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলনের চাপে করপোরেটমুখী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ১৯ নভেম্বর ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সংযুক্ত কৃষক মোর্চা জানিয়ে দেয়, সংসদে কৃষি আইন প্রত্যাহার এবং অন্যান্য ছয় দফা দাবির যতক্ষণ না গ্রহণযোগ্য মীমাংসা হচ্ছে, আন্দোলন চালিয়ে যাবে কৃষকরা। ২৯ নভেম্বর সংসদে বিল এনে করপোরেটমুখী তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্র।
।। বারো ।।
৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিত প্রতিশ্রুতি পাবার পর আন্দোলন থেকে সরে আসার কথা ঘোষণা করে সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্ব। অবসান হয় ৭০২ জন কৃষকের প্রাণের বিনিময়ে ৩৭৮ দিনের দাঁত চাপা লড়াইয়ের। কৃষকদের দৃঢ়তার সামনে বিপাকে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার।
ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের বিরোধিতা সহ একাধিক দাবিতে এই ডিসেম্বরেই হয়ে গেছে দুদিনের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট। যে ধর্মঘটের পর আপাতত বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা হলেও সাময়িক পিছু হটেছে কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাজেটে কেন্দ্র দু’টি ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের কথা ঘোষণা করলেও বিলগ্নিকরণের বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মন্ত্রীসভার কমিটিকে। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে মূল প্রশ্ন ছিল, ব্যাঙ্কের মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে? অর্থ মন্ত্রক উত্তর দেয়নি। শোনা যাচ্ছে আগামী বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত।
আর এই ভরা শীতের বাজারেই ভোট লুঠ, সন্ত্রাসের মধ্যেও কলকাতা পুরসভা নির্বাচনে দক্ষিণপন্থীদের হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে বামফ্রন্টের ভোট বেড়েছে অনেকটাই। প্রায় ১১.৮৯ শতাংশের কাছাকাছি। লুট করা, ছিনিয়ে নেওয়া ভোট নয়। মানুষের ভোট। কলকাতা পুরসভার ১২৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছে ২টি আসনে। ৫টি আসনে খুবই কম ব্যবধানে পরাজয় আর ৬৫ আসনে দ্বিতীয় স্থান। যে ফলাফল অবশ্যই অন্য দিশার ইঙ্গিত।
বছর শেষের বার্তা
‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’। যতটা দাপটের সঙ্গে আইটি সেলের এই প্রচারে ঘটনাবহুল ২০২১ শুরু হয়েছিল, বছর শেষের সপ্তাহ বলছে - সে প্রচার অনেকটাই স্তিমিত। দেশের মানুষের আশা ভরসা জলাঞ্জলি দিয়ে পি আর ইভেন্টে অভ্যস্ত তথাকথিত ‘জাতীয়তাবাদ’-এর গিমিক তোলা ভক্তের দলের মুখে চুনকালি দিয়ে বছর শেষে নতুন ইতিহাস লিখেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। সরকারের চোখে চোখ রেখে একবছরের বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে ‘সবকুছ মুমকিন নেহি হ্যায়’। খামখেয়ালিপনা আর পছন্দের বন্ধুদের পকেট ভরার দিন শেষ। এত সহজে পার পাওয়া যাবেনা। ঢোঁক গিলতেই হবে। পিছু হটতেই হবে। সাধারণ মানুষ বার বার বিভ্রান্ত হবেন না। দিনের শেষে কথা বলবে মেহনতি মানুষই। জয় ছিনিয়ে আনবে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য।