৫৭ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ৩১ জুলাই ২০২০ / ১৫ শ্রাবণ ১৪২৭
মমতা ব্যানার্জির ২১ জুলাইয়ে ভাষণ
মিথ্যা কথার ফুলঝুরিঃ দুর্নীতিবাজদের আশ্বাস
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ২১ জুলাই করোনার ভয়াবহ সংক্রমণের আবহে তৃণমূল নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বাৎসরিক শহিদ দিবসে দলের তলানিতে যাওয়া মনোবল চাঙা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। এদিন তাঁর ভার্চুয়াল বক্তব্যে একদিকে যেমন ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট হয়েছে, তেমনি সীমাহীন দুর্নীতি, লুঠ, অপশাসনে সাধারণ মানুষের তীব্র ক্ষোভের পরিণতিতে দল ভাঙা রুখতে দেড় ঘণ্টার ভাষণে কর্মীদের আশ্বস্ত করার যথসাধ্য চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু দল ও প্রশাসনের নানা স্তরে যে ব্যাপক দুর্নীতি, লুটের কারবার মাত্রা ছাড়িয়েছে, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য শোনা গেল না। উল্টে চুরি, দুর্নীতি, লুঠের কারবারে অভ্যস্ত নেতা-কর্মীদের অভয় দিয়ে বলেছেন, ‘ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। ভয় পাবেন না। হাম হ্যায় না।’
এদিন দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী দলের ভাঙন ঠেকাতে যেভাবে মরিয়া চেষ্টা করেছেন ও দলের তরী ডোবার আশঙ্কায় নেতা-কর্মীদের ক্রমান্বয়ে অন্য দলে চলে যাওয়া রুখতে গিয়ে যে হারে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি ও অবিশ্বাস্য তথ্যের অবতারণা করেছেন, তা বিশ্বস্ত অনুগামী-সমর্থকদেরও বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। অন্যদিকে রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে নেত্রী দলের নেতা-মাতব্বরদের দুর্নীতি-চুরিকে আড়াল করে উল্টে তা বৈধতা দিতে মত্ত থেকেছেন। সাম্প্রতিককালের রেশন নিয়ে সীমাহীন দুর্নীতিকে আড়াল করতে গিয়ে তিনি অবলীলায় বলেছেন, রেশন নিয়ে নাকি মাত্র দু’তিনটে জায়গায় গোলমাল হয়েছে! তিনি দলের নেতা-কর্মীর বিভিন্ন দুষ্কর্ম, চুরি ইত্যাদিকে ঢাকা দিতে এবং ছোটো করে দেখাতে গিয়ে প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘‘কয়েকটা লোক দুষ্টুমি করলে মানুষ কেন কষ্ট পাবে? তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’
এছাড়া আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় মমতা ব্যানার্জি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দলের কর্মীদের এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন যে, তৃণমূলই জিতবে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের ভোটে কোনোভাবেই জেতার সম্ভাবনা নেই। তাই দলের সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতী, তোলাবাজদের দলে ধরে রাখার চেষ্টায় অবাধ চুরি, দুর্নীতিকে যেমন আড়াল করতে চেয়েছেন, তেমনি লাগামহীন মিথ্যাচার করেছেন। যে কোনো উপায়ে দলের অনুগামীদের মনোবল বাড়াতে গিয়ে যথেচ্ছ মনগড়া তথ্য দিয়ে রাজ্যে নৈরাজ্য, অপশাসনকেই স্থায়ী রূপ দিতে চেয়েছেন। এভাবেই সীমাহীন মিথ্যাচার, অসত্য তথ্যের অবতারণা করে দলের তথাকথিত শহিদ দিবস পালন করেছেন।
কিন্তু লক্ষণীয় ঘটনা হলো, নামে শহিদ দিবস পালন অনুষ্ঠান হলেও এদিনের কর্মসূচি আদতে দলের ভাঙন ঠেকাতে এবং নিজেদের শাসন ক্ষমতাকে ধরে রাখার মরিয়া অপচেষ্টায় চুরি-দুর্নীতিকে আড়াল করে উল্টে তাকে বৈধতা দেবার কর্মসূচিতেই রূপান্তরিত হয়েছে। একই সঙ্গে এদিনের কর্মসূচি লাগামহীন মিথ্যাচার ও আজগুবি তথ্যের উপস্থাপনায় একটি হাস্যকর কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে।
২১ জুলাইয়ের বক্তৃতায় তিনি মনগড়া তথ্য হাজির করতে গিয়ে বলেছেন, রাজ্যের ১০ কোটি মানুষকে নাকি বিনামূল্যে রেশন দিচ্ছেন! কিন্তু বাস্তবে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যাই হচ্ছে প্রায় ১০ কোটি। রাজ্যে অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষের রেশন কার্ড নেই। অথবা তাঁরা রেশন নেন না। সেই হিসেবে যদি ১০ কোটি মানুষের জন্য রেশন ব্যবস্থা থাকে, তাহলে দুই থেকে আড়াই কোটি মানুষের রেশন কোথায় যায়?
তিনি ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে হাঁকডাক করে ঘোষণা করেছিলেন ভোটে জিতলে নাকি আজীবন বিনামূল্যে রেশন দেবেন। কিন্তু তারপরই রাজ্যের খাদ্য দপ্তর আগস্ট মাস থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দেবার নির্দেশ দিয়েছে। জানা গেছে, আগস্ট মাস থেকে আরকেএসওয়াই-২ কার্ড যাঁদের রয়েছে তাঁদের বিনামূল্যে ৫ কেজি চাল দেবার পরিবর্তে ১ কেজি চাল ও ১ কেজি গম দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য দপ্তর। এভাবে এই বিপর্যয়ের সময়ে রাজ্য সরকার রেশনে খাদ্যদ্রব্যের বরাদ্দ কমিয়ে দিল। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয় মমতা ব্যানার্জির ভাষণের বাস্তবতা কতটা।
এছাড়াও তিনি আজগুবি তথ্য দিয়ে বলেছেন, রাজ্যে ২.৩৮ কোটি সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীর জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন! কিন্তু ঘটনা হলো রাজ্যে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যাই হচ্ছে আড়াই কোটি। তার মধ্যে ২.৩৮ কোটিই কি ছাত্রছাত্রী? এদিকে ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষের জন্য অর্থমন্ত্রীর বাজেট বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ ‘‘এখনও পর্যন্ত সাড়ে আট বছরে ২.০৩ কোটি সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দেওয়া হয়েছে।’’ কাজেই কোন্ তথ্যটা সঠিক তা নিয়ে সংশয় জাগা স্বাভাবিক।
মমতা ব্যানার্জি তাঁর বেপরোয়া মিথ্যা ভাষণে উল্লেখ করেছেন, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে নাকি ৫৫ হাজার তৃণমূল কর্মী খুন হয়েছে! তাঁর এই মিথ্যা ভাষণকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বাম পরিষদীয় দলনেতা বলেছেন, এই ৫৫ হাজারের নামের তালিকা প্রকাশ করুন।
তিনি ‘কর্মসংস্থান ঢেলে সাজানোর’ কথা বলেছেন। তাঁর আক্ষেপ কোভিড পরিস্থিতির জন্য নাকি তা করা গেল না। কিন্তু রাজ্যে বর্তমান কর্মসংস্থানের কী হাল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনো নতুন কলকারখানা হয়নি, বরং বন্ধ হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হওয়ায় মামলা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। অন্যান্য দু-একটি ক্ষেত্রে যতটুকু নিয়োগ হয়েছে, তাতে শাসকদলের নেতা-মাতব্বরদের কাটমানি খাবার ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে রাজ্য। সর্বত্র চাকুরি মিলেছে শাসকদল ঘনিষ্ঠদেরই। বলাই বাহুল্য, সেসব জায়গায় আদৌ যোগ্যতার বিচার করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের গদি বাঁচাতে নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী নয় বছর সরকার চালানোর পর কর্মসংস্থান ঢেলে সাজানোর বুলি আওড়েছেন!
২১ জুলাই মমতা ব্যানার্জি রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে মিথ্যা ভাষণে আগামী বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে নিজেকে বিজেপি বিরোধী হিসেবে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। এই মিথ্যা ভাষণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম এবং বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী।
মহম্মদ সেলিম বলেছেন, মমতা ব্যানার্জির কল্যাণে রাজ্যটাকে আমরা বিজেপি’র হাতে চলে যেতে দেব না। কেন্দ্রে মোদী আর রাজ্যে দিদির লুটের বিরুদ্ধে সব বামপন্থী-ধর্মনিরপেক্ষ-গণতান্ত্রিক মানুষকে একজোট করে লড়াই করতে হবে। তিনি বলেছেন, তৃণমূলের নেতারা লাইন দিয়ে বিজেপি-তে যাচ্ছেন। তৃণমূলের সাধারণ কর্মী, সমর্থক যাঁরা অতীতে ভুল করে তৃণমূলকে সমর্থন করেছিলেন, তাঁদেরকে বলবো লাল ঝান্ডার লড়াইতে আসুন, রাজ্যটাকে বাঁচাই।
মহম্মদ সেলিম বলেছেন, জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূল মিথ্যাচার করছে। মুখ্যমন্ত্রী ২১ জুলাই নিয়ে মিথ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন, সেই মিথ ভাঙছে। করোনা মহামারীকালে মানুষের অসহায় অবস্থা, স্বাস্থ্য কাঠামো ভেঙে পড়েছে। তখন মুখ্যমন্ত্রী আবার মিথ্যাচার করলেন।
বিজেপি বিরোধিতায় মুখ্যমন্ত্রীর ভণ্ডামিকে ফাঁস করে দিয়ে মহম্মদ সেলিম বলেছেন, আজ তিনি বলছেন বিজেপি ‘অবিশ্বাস্য’ পার্টি। দু’দশকের বেশি সময় ধরে বিজেপি-কে বিশ্বাস করেছিলেন কেন! আরএসএস’র সাহায্যে সিপিআই(এম)-কে বাংলা ছাড়া করবেন বলে প্রজেক্ট নিয়েছিলেন। কোন্ অবস্থায় ২১ জুলাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল? বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সারা দেশে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কলকাতায় ও বাংলায় বামফ্রন্ট সরকার শান্তি বজায় রেখেছিল। তখন বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনকে ব্যবহার করে উসকানি দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তারপরে ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই গুন্ডামি করে মিথ্যাচার করেছিল। ক্ষমতার লোভে তিনি আরএসএস-কে এখানে এনে দুধকলা দিয়ে পুষেছিলেন। এখন তাঁর দলের নেতারা বিজেপি-তে সব লাইন দিয়ে জয়েন করছে। অন্যদিকে আমফান দুর্নীতি, ত্রাণচুরি, রেশন চুরি এসবের ফলে তৃণমূলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকরা প্রতিদিন লাল ঝান্ডা হাতে তুলে নিচ্ছেন। রেড ভলান্টিয়ারদের কাজে মানুষ উৎসাহিত হয়েছেন। তৃণমূল তখন কোথায়? কাটমানিতে ব্যস্ত। বামপন্থীরাই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূল রাজ্যকে রক্ষা করতে পারবে না। পারবে বামপন্থীরাই।
মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় বিজেপি’র বাড়বাড়ন্তের উদাহরণ দিয়ে সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ নেতা মুকুল রায় আজ কোথায়? তিনি বিজেপি-তে। জঙ্গল মহলের যিনি মুখ্যমন্ত্রীকে মা বলতেন তিনি কোথায়? যে ছাত্রনেতাকে ফুলিয়ে দলের নেতা করেছিলেন, তিনি কোথায়?
তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন তোলেন, নন্দীগ্রামের ঘটনার সিবিআই রিপোর্ট প্রকাশ করেছেন? সিঙ্গুরে সিবিআই রিপোর্ট কোথায়। ‘২১ জুলাই’-এর ঘটনার সময়ের স্বরাষ্ট্রসচিবকে নিজের দলের মন্ত্রী ও সাংসদ করেছেন কেন? মুখ্যমন্ত্রীর সব মিথ্যা ধরা পড়ে গেছে। শুধু মিথ্যা বলে ক্ষমতায় বসেছেন। রাজ্যের সর্বনাশ করেছেন।