৫৭ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ৩১ জুলাই ২০২০ / ১৫ শ্রাবণ ১৪২৭
‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০২০’ খসড়া বাতিল করার দাবি সিপিআই(এম)’র
দেশের পরিবেশ দূষণ কমানো নয়, আদিবাসী মানুষের অধিকার রক্ষা নয়, নরেন্দ্র মোদী সরকারের কাছে কর্পোরেট স্বার্থে পরিবেশ বিধিসমূহের উল্লঙ্ঘন এবং লঘুকরণ এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে। আমাদের দেশের পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কাঠামো যদিও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট পোক্ত নয়, তা সত্ত্বেও সম্প্রতি পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলা বিভিন্ন বিষয়ের বিধি-নিয়ম সংক্রান্ত যে খসড়া রিপোর্ট তৈরি হয়েছে সেখানে এমনকি জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল-এর অবস্থান, সুপারিশ, রায় এবং বিভিন্ন আদালত সহ সুপ্রিম কোর্টের রায়সমূহকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ‘এনভায়রনমেন্ট ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ)২০২০’ শীর্ষক এই খসড়াতে প্রতি পদক্ষেপে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে দেশের আইন এবং পরিবেশ সুরক্ষার চালু ব্যবস্থাকেই। (ইআইএ)২০২০-এর যে পক্ষপাতিত্বমূলক খসড়া বয়ান কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়েছে, তার তীব্র সমালোচনা করে সিপিআই(এম)’র পক্ষ থেকে পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকরকে একটি চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে তিনি খসড়ার বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে তা প্রত্যাহার করতে বলেছেন। তাঁর অভিযোগ, পরিবেশ রক্ষা নয়, কর্পোরেটের বানিজ্যিক স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত এই কেন্দ্রীয় সরকার। তার নজির বর্তমানের এই খসড়াটি। তাই জনগণের স্বার্থে ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ওই খসড়ায় পরিবর্তন করতে হবে। স্বার্থের সংঘাতকে নির্মূল করে বিভিন্ন নজরদারি ও বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে হবে দেশের গণতান্ত্রিক ও সামাজিক গঠনের প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে। খনি থেকে খনিজ উত্তোলনের প্রশ্নে চালু নির্দেশিকা পালনের ক্ষেত্রে আপস করা চলবে না। চলবে না খোলা মুখ খনির থেকে বাণিজ্যিক উত্তোলনের ক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইনে সংস্কার করে তা লঘু করা। আদিবাসী অংশের মানুষের সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকারকে লঘু করা বা লঙ্ঘন করা যাবে না, তা বজায় রাখতে হবে।
কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে বৃন্দা কারাত উল্লেখ করেছেন রিপোর্টের বিভিন্ন বৈষম্যমুলক এবং আইন লঙ্ঘনের নানা দিক। তিনি লিখেছেন, বিশ্বব্যাঙ্কের বাণিজ্যিক সুবিধা দান সংক্রান্ত সূচক-এর তালিকায় ভারত গত বছরের তুলনায় ১৪ ধাপ ওপরে উঠে এ বছর ১৯০টি দেশের মধ্যে ৬৩-তে পৌঁছেছে। কিন্তু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সংক্রান্ত সূচকে আমাদের দেশ ২.৯পয়েন্ট কম পেয়ে বেশ পিছিয়ে গেছে। এই দু’টি সূচক সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে চোখ রাখলেই দেখা যাবে যে, দেশের পরিবেশ রক্ষায় নয়, এই সরকার কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষায় নিবেদিত। তাই জীবন-জীবিকার জন্য প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরশীল আদিবাসী সহ বিভিন্ন অংশের মানুষকে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ লঘু করার গুরুতর ফল ভুগতে হচ্ছে। ২০০৬ সালে, অর্থাৎ প্রায় দেড় দশক আগে ইআইএ’র তৎকালীন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর পরিবেশ দপ্তরের নির্দেশিকা অনুযায়ী বিধি-নিষেধ আরোপ করা এবং পর্যবেক্ষণ বিধি কার্যকর করার জন্য আমাদের কাছে এবার আর একটা সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইআইএ ২০২০ সালের বিজ্ঞপ্তিতে ২০০৬সালের বিজ্ঞপ্তির দুর্বলতা চিহ্নিত করার পরিবর্তে ঠিক তার উল্টোটা করা হলো।
দেশের আইন অনুযায়ী, ২০২০ সালের এই খসড়াটি পরিবেশ রক্ষা আইন ১৯৮৬’র মোতাবেক হওয়া বাঞ্ছনীয়। ওই আইনে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে, পরিবেশের গুণগত মান উন্নয়ন, এবং পরিবেশ দূষণ রোধ, নিয়ন্ত্রণ এবং কমানোর বিধি রয়েছে। কিন্তু বর্তমান খসড়াটিতে ২০০৬ সালের প্রস্তাবটির উল্লঙ্ঘনই শুধু নয়, জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনাল এবং আদালতসমূহ এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ আইন সংশোধন, লঘুকরণ সংক্রান্ত চেষ্টার বিরুদ্ধে দেওয়া রুলিং সমস্ত কিছুকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে। অর্থাৎ, এই খসড়ার আইনি দিক সমূহ সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয় এবং সেগুলি আদালত কর্তৃক বাতিল করে দেওয়া হতে পারে।
বৃন্দা কারাত বিভিন্ন দৃষ্টান্ত যোগে আরও উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের খসড়াটি বাণিজ্যিক খনন ও উত্তোলন সংক্রান্ত পরিবেশগত নিয়ম এবং সময়ের মাপ সহ সামগ্রিকভাবে কর্পোরেট স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যে পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ন্ত্রণ বিধিকে লঘু করে এবং শিথিল করে তৈরি করা হয়েছে। মান্যতা দেওয়া হয়নি পরিবেশ সংক্রান্ত দিকগুলিকেও। গোটা খসড়াটির সবচেয়ে আপত্তিকর বিষয় হলো, সেখানে কোথাওই আদিবাসীদের কথা বলা হয়নি, যাঁরা এই সমস্ত পরিবেশ আইন লঘুকরণের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আদিবাসী, উপজাতি, গ্রাম সভা, বন অধিকার আইন, পঞ্চম সিডিউল, ষষ্ঠ সিডিউল, পিইএসএ এই সমস্ত শব্দের বা বিষয়ের কোনও উল্লেখ নেই। বেসলাইন ডেটা, সংজ্ঞা এবং সাধারণ শর্তাবলী থেকে জনশুনানি প্রভৃতি কোথাওই জনগোষ্ঠী হিসেবে তাঁদের উল্লেখ না করার বিষয়টির মধ্য দিয়ে আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এবং আইনি অধিকার সমূহ উপেক্ষা করা হয়েছে। শুধুমাত্র এই বিষয়ে খামতিটুকুই খসড়াটি বাতিল করার পক্ষে যথেষ্ট।
ইআইএ ২০০৬ অনুযায়ী ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে খনন এবং খনিজ উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে এএসসি হায়দরাবাদ-এর পক্ষ থেকে একটি নির্দেশিকা তৈরি করা হয়। ওই নির্দেশিকাতে প্রকল্পের মেয়াদ, ক্লজ, শর্তাবলী সহ বিভিন্ন সংজ্ঞা ও মাপকাঠি উল্লেখ করা আছে। কিন্তু ২০২০ সালের খসড়াটিতে ওই নির্দেশিকা সংক্রান্ত বিষয়গুলি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি উল্লেখ করা হয়নি ওই নির্দেশিকার ভবিষ্যৎ কি হতে চলেছে সে কথাও। কারণ খোলামুখ খনির থেকে উত্তোলনের ক্ষেত্রে যে বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং তার সংঘাত রয়েছে তা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার নির্দেশিত এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত দশকে দেখা গেছে, খনিজ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বায়ু, জল এবং জমি অর্থাৎ এককথায় সংশ্লিষ্ট পরিবেশ যা খোলামুখ খনির চারপাশে অবস্থিত তা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাণিজ্যিক খনন এবং উত্তোলনের দরুন এই ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়াজনিত পরিস্থিতিকে খনি শ্রমিকরা বলেন ‘স্লটার মাইনিং’। খনিজ উত্তোলনের পর খোলামুখ খনি বন্ধের ক্ষেত্রে এবং পরিবেশগত ক্ষতি মেরামতের ক্ষেত্রে এবং ব্যবহৃত জমি পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে দেবার উপযোগী করতে ওই নির্দেশিকা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়। এটা একটা চালু পদ্ধতি যেটা প্রতি পাঁচ বছরে রিভিউর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো যদি এই নির্দেশিকা বাতিল বলে গণ্য হয় সে ক্ষেত্রে প্রকল্প শেষ হবার পর তা নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নেবে কে এই জরুরি বিষয়টি অনালোচিত থেকে গেছে ওই খসড়ায়।
তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন, বেশ কয়েকটি বিষয়ে সাম্প্রতিক খসড়াটিতে মন্ত্রকের পক্ষ থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতার কথা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে খসড়ার ৬,৭,৮এবং ৯ধারায় বলা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ মন্ত্রকের সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে। এমনকি রাজ্যস্তরের সংশ্লিষ্ট কমিটি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করারও পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের। পরিবেশের পরিচর্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন দিকের সংগঠনের ক্ষেত্রে এই কমিটিগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এই কমিটিগুলি যেহেতু স্বশাসিত সংস্থা নয়, তাই এদের সুপারিশ মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অতএব কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রবার স্ট্যাম্প হিসেবে সরকার এই কমিটিগুলিকে ব্যবহার করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সাম্প্রতিক অতীতের বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটার প্রমাণ রয়েছে। বর্তমান খসড়ার ১১ নম্বর ধারায় কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রককে একাধিক নজরদারি, মুল্যায়ন ও বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্যস্তরে। একটু অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় যে, কেন্দ্রীয় সরকার যদি দেখে তার ঘোষিত কর্মসূচির সঙ্গে নির্দিষ্ট কোনো রাজ্যের বিশেষজ্ঞ কমিটির মতের অমিল হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কোনো পরামর্শ ছাড়াই তারা আরও একটি কমিটি গঠন করতে পারবেন। স্পষ্টই এই বিষয়টি আইন ভাঙার ফিকির। তাই এই ধরনের কমিটির সদস্যদের নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রকের বা সরকারের কোনও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়। কমিটিগুলোর গঠনের ক্ষেত্রে আরও কয়েকটা বিষয় উল্লেখ থাকা দরকার। গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক স্বার্থে এই ধরনের টেকনিক্যাল কমিটিগুলিতে মহিলা, অনুসূচিত জাতি এবং আদিবাসী অংশের মানুষ, যাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা রয়েছে তাদের স্থান দিতে হবে।
এই বিষয়গুলোর পাশাপাশি আরও চারটি মূল বিষয় রয়েছে, যেগুলি চালু প্রকল্পগুলিকে আইন এবং নিয়মের নিরীক্ষা থেকে পাশ কাটিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। যেমন এই সমস্ত প্রজেক্টগুলোর পুনরায় শ্রেণিবিভাগ করা যাতে গুণমান পরীক্ষা এবং জনগণের মতামত গ্রহণের পরিসরকে এড়ানো যায়। আবার কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিধিকে লঘু করে জনমত গ্রহণের প্রক্রিয়াটিকেই বাতিল করা যায়, তেমন বেশ কিছু বিষয় রয়েছে খসড়ায়। যেমন, প্রকল্পের রূপায়ণে আইন উল্লঙ্ঘন সংক্রান্ত কোনও নজির থেকে থাকলে তা আইনত বৈধ করা এবং বেশ কিছু ধারার এবং উপধারার মধ্য দিয়ে প্রকল্পগুলিকে বেশ কিছু ছাড় এবং সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।
বিভিন্ন প্রকল্পের পুনরায় শ্রেণিবিভাগ করার কথা যা নয়া খসড়ায় বলা হয়েছে, সেগুলি মূলত নানাভাবে ২০০৬ সালের নির্দেশিকার রাস্তা থেকে সরে আসাই নয়, এনভায়রনমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাক্ট ১৯৮৬-কে পাশ কাটানোর জন্য তৈরি হয়েছে। এমনভাবে এই প্রস্তাবগুলি রাখা হয়েছে যার ফলে পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছাড়াই প্রকল্পের বৈধতা মেলে। রিয়েল এস্টেট এবং নির্মাণ শিল্পের ক্ষেত্রে এর হাতেগরম নজির রয়েছে, যা বিস্ময়কর। দেখা যাচ্ছে, নয়া খসড়ায় ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ স্কোয়ার মিটার মাপ সম্পন্ন নির্মাণের ক্ষেত্রে আগে যেখানে স্ক্রুটিনি হতো এবং মূল্যায়ন কমিটির অনুমোদন প্রয়োজন হতো সেই ধাপগুলোই বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এটা কিছুতেই সমর্থনযোগ্য নয়। কুড়ি হাজার থেকে ৫০ হাজার স্কোয়ার মিটার মাপের কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট-এর ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ এবং গণশুনানির আবশ্যকীয় শর্তই বাদ দেওয়া হচ্ছে নয়া খসড়ায়। আবার কুড়ি হাজার স্কোয়ার মিটার-এর কম মাপের নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশ দপ্তরের সার্টিফিকেট ইত্যাদির কোনো প্রয়োজন হবে না - এরকমটাই বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রক ২০০৬-এর নির্ধারিত মাপকাঠির ক্ষেত্রে ৫০ হাজার থেকে দেড় লক্ষ স্কোয়ার মিটার মাপের প্রকল্পের ক্ষেত্রে আগেও নিরীক্ষা বাতিল করার জন্য সংশোধনী আনতে চেয়েছিল। সে সময় সরকারের এই পদক্ষেপকে জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল তৎক্ষণাৎ বাতিল করে। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও সুবিধা করতে পারেনি পরিবেশ মন্ত্রক। সুপ্রিম কোর্ট জাতীয় গ্রিন ট্রাইবুনাল-এর রায়কেই বজায় রাখে। নয়া খসড়ায় এনজিটি এবং সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়কে কার্যত মুছে ফেলা হলো।
এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের দূষণ ছড়ায় এমন শিল্প যা পরিবেশের পক্ষে বিপজ্জনক, তা নতুন শ্রেণিবিভাগের আওতায় আনা হচ্ছে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে। স্পষ্টতই যা পরিবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং অবশ্যই কর্পোরেট স্বার্থবাহী।
আবার স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পের সম্পর্কে যে সংজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। কারণ এই ধরনের প্রকল্পগুলো পরিবেশ বান্ধব হবে এটাই জনস্বার্থে আশা করা যায়। অতএব সেগুলির মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নজরদার কমিটি কেন হস্তক্ষেপ করবে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আবার অসামরিক বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক প্রকল্পের ক্ষেত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করা অবশ্যই উচিত জনগণের অবগতির জন্য।
নির্মীয়মান কোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে স্থানীয় অধিবাসীদের উন্নয়নের বিষয়টিকে লক্ষ্য রাখা হয় পরিবেশ বিধি অনুযায়ী। ডিস্ট্রিক্ট মিনারেল ফান্ড সংক্রান্ত বরাদ্দ এক্ষেত্রে ব্যয় করা হয় অনুন্নয়নের আওতায় থাকা মানুষদের জন্য। কিন্তু যারা ওই এলাকায় জমি লিজ নিয়েছেন, তাদের স্বার্থেই ওই ফান্ড এর টাকা ব্যয় করার কথা নয়া খসড়ায় বলা হয়েছে, যা আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন এবং উদ্দেশ্য ও বিষয়গতভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত। চিঠিতে প্রজেক্ট রিপোর্ট সংক্রান্ত বিষয়ে গণশুনানি বা প্রকল্পের খুঁটিনাটি প্রকাশ করার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার বা চেপে দেওয়ার চেষ্টার কথাও বলা হয়েছে। কারণ প্রকল্প সম্পর্কে তৈরি করা রিপোর্ট-এর ক্ষেত্রে দেখা গেছে নথিভুক্ত এজেন্সিগুলি গৎবাঁধা রিপোর্ট জমা দিতে অভ্যস্ত। প্রকল্পের খুঁটিনাটি বিবরণ যা জানার অধিকার রয়েছে মানুষের, সেগুলি স্বার্থের সংঘাতের কারণে সবিশেষ উল্লেখ করে প্রকাশ করা হয় না। এক্ষেত্রে প্রকল্পের অসংগতি সম্পর্কে সরকারকে এবং মূল্যায়ন ও নজরদারির সঙ্গে যুক্ত উপযুক্ত কমিটিকে বা আদালত এবং এনজিটি-কে জানানোর ক্ষেত্রে ৩০দিনের সময়সীমা প্রয়োজনের তুলনায় কম। এটা বাড়াতে হবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
খসড়াতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ এবং আধুনিকীকরণের ক্ষেত্রে জনশুনানি, বিবরণ প্রকাশ ইত্যাদি বিষয়গুলিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রামসভাকে জানানো এবং তার মতামত নেওয়া এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক রাখতে হবে। প্রকল্প শুরুর আগেই স্থানীয় বিষয় সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করে ছাড়পত্র নিতে হবে। জরিমানা দিয়ে ছাড়পত্র নেয়ার বিষয়টি কার্যত অবৈধ কার্যকলাপকে বৈধতা দেওয়ার একটা পথ যা এমনকি সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত আইন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করে এর থেকে বিরত থাকতে বলেছে।
চিঠিতে পরিশেষে এই খসড়াটি বাতিল করে সমস্ত ধরনের পরিবেশ সংক্রান্ত অংশীদারদের সঙ্গে নিয়ে পুনরায় নতুন খসড়া তৈরি করার দাবি তোলা হয়েছে পরিবেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এবং দেশের স্বার্থে।