৫৭ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ৩১ জুলাই ২০২০ / ১৫ শ্রাবণ ১৪২৭
নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠায় তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদী ঘনিষ্ঠতা নতুন নয় এখন তা আরও স্পষ্ট হলো
সুপ্রতীপ রায়
অতি সম্প্রতি তৃণমূল সাংগঠনিক স্তরে রদবদল করেছে। মিডিয়ার ভাষ্য - ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে তৃণমূল কাজ করছে। বিধানসভা নির্বাচনে জেতাটাই তৃণমূলের লক্ষ্য। বর্তমান সময়ে মানুষ বিপন্ন। করোনা ভাইরাস গোষ্ঠী সংক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। রাজ্যের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। করোনা সংক্রমণের ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা-উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার বদলে তৃণমূলের এখন লক্ষ্য - ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন। মানবিকতার চিহ্ন মাত্র নেই তৃণমূলের মধ্যে। বিজেপি-ও তাই।
তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে বেশ কিছু নতুন মুখ এসেছে। ওদের কমিটিতে কাউকে নেওয়া বা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত একজনের কথাতেই হয়। ‘সুপ্রিমো’ যা বলবেন তাই সিদ্ধান্ত। যাই হোক, যে নতুন মুখগুলি রাজ্য কমিটিতে এসেছে তার মধ্যে ছত্রধর মাহাতো আছেন। ছত্রধর মাহাতো এতদিন পরে পুরস্কার পেলেন মমতা ব্যানার্জির কাছ থেকে। ছত্রধর মাহাতোর মতো ব্যক্তিরাই তো ২০১১-তে তৃণমূলকে ক্ষমতায় আনার কারিগর। আবারও প্রমাণিত হলো পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী ও তৃণমূল ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’।
১৮ মে ২০০৬, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল। ২০০৬ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল বামফ্রন্ট। আর এই নির্বাচিত সরকারের বিরূদ্ধে প্রথম থেকেই চক্রান্ত শুরু হয়। পরিবর্তন-এর স্লোগানকে সামনে রেখে চরম আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছিল সিপিআই(এম)’র বিরূদ্ধে। গড়ে উঠেছিল বাম-বিরোধী মহা-রামধনু জোট। বিচিত্র এই জোটে অন্য সকলের সঙ্গে নকশালপন্থীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী, মাওবাদীরা ছিল।
বামফ্রন্টের বিরূদ্ধে নানা মঞ্চ গড়ে তোলা হয়েছিল। যেমন - নন্দীগ্রামে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’,জঙ্গলমহলে ‘পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি’, সিঙ্গুরে ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’, ‘মূলবাসী কমিটি’ ইত্যাদি। জনসাধারণের কমিটির ‘লালগড় আন্দোলন’কে সাঁওতাল বিদ্রোহ’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। উল্লেখিত মঞ্চ বা কমিটিগুলি আসলে তৃণমূল-মাওবাদীদের মঞ্চ হিসাবেই কাজ করেছিল। কিষেনজি, ছত্রধর মাহাতোর মতো মাওবাদীরা অনেক পরিশ্রম করেই মমতা ব্যানার্জিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
মাওবাদীদের রাজনীতি হত্যার রাজনীতি। আর সন্ত্রাস তৈরি করে ক্ষমতায় আসা ও টিকে থাকা তৃণমূলের রাজনীতি। আসলে জঙ্গল মহলে যে দিনে তৃণমূলের কর্মী সেই কর্মীই রাতে মাওবাদী ছিল। জঙ্গলমহলে খুন, হত্যা, লুটতরাজ সহ যে সমস্ত অন্যায় কাজ ছত্রধর মাহাতো সহ মাওবাদীরা করেছিল তাকে মমতা ব্যানার্জি ‘মহান বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
নন্দীগ্রামে দিনের পর দিন তৃণমূল-মাওবাদীদের যৌথবাহিনী, ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা বামফ্রন্ট কর্মীদের রক্তের হোলি খেলেছে। সিপিআই(এম)’র পার্টি অফিসগুলি পুড়িয়ে দিয়েছে। মাওবাদীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে তৃণমূল। ৭ জানুয়ারি ২০০৭, নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারীরা। ওই একই দিনে তৃণমূল কংগ্রেস ও নকশালপন্থীরা কলকাতার কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে হামলা চালায়। ঘটনাচক্রে ওই একই দিনে নন্দীগ্রামের সোনাচূড়ায় মাওবাদী-তৃণমূলের নৃশংসতায় প্রাণ হারান স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতা শঙ্কর সামন্ত। তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয়েছিল।
তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীদের ঘনিষ্ঠতার একাধিক উদাহরণ আছে। ২১ ফেব্রুয়ারি ’০৭ ঝাড়খণ্ডের রাঁচির লালপুরচকের প্যাটেল ভবনে একাধিক নকশালপন্থী ও মাওবাদী ব্যক্তি ও সংগঠনের সম্মেলন হয় ২০-২১ ফেব্রুয়ারি। গঠিত হয় ‘অ্যান্টি ডিসপ্লেসমেন্ট ফ্রন্ট’। ২১ ফেব্রুয়ারি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষি জমি নিয়ে নিচ্ছে। এই যৌথ বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের অন্যতম ছিলেন - মহাশ্বেতা দেবী। বলা বাহুল্য, মহাশ্বেতা দেবী তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবী ছিলেন। ১৪ মার্চ ’০৭, নন্দীগ্রামের ঘটনা দুঃখজনক হলেও এটি ছিল তৃণমূল-মাওবাদীদের গভীরতর ষড়যন্ত্রের ফসল। তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ কবীর সুমনের লেখা “নিশানের নাম তাপসী মালিক’ বইতে তার প্রমাণ মেলে। ১৫ মার্চ ’০৭, মমতা ব্যানার্জি নন্দীগ্রামে মাওবাদীদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। ২৭ মার্চ ’০৭ ‘গণশক্তি’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, “রাজ্যের উন্নয়নে বাধা দেওয়ার জন্য বিরোধী শিবির রাজনৈতিকভাবে অন্তর্ঘাত করছে। এরা রাজনৈতিকভাবে লড়াই করতে পারে না। তৃণমূল কংগ্রেস, মাওবাদী, নকশালপন্থী, এসইউসি সব একজোট হয়েছে।”
তৃণমূলপন্থী সংগঠন গণমুক্তি পরিষদ ২ নভেম্বর ’০৭, তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাতিলকে এক চিঠি দেয়। এই চিঠিতে পরিষদ বলেছিল, নন্দীগ্রামে মাওবাদী তৎপরতার খবর রাজ্য সরকারের বানানো।
তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীদের ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ মেলে ১২ নভেম্বর, ২০০৭ ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় নন্দীগ্রামের বাসিন্দা কানাই শীটের লেখা “চোখের সামনে দেখেছি শঙ্কর সামন্তের খুন” শীর্ষক লেখা থেকে। ঐ লেখাতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “...আসলে সেই সময়টা আমরা সবাই যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। সোনাচূড়ার জলপাই গ্রামে আমাদের দোতলা বাড়ি। আমি আর আমার দুই ছেলে খোকন ও মণি সকলেই তৃণমূল করতাম। গ্রামে বেশিরভাগ মানুষই সিপিআই(এম) সমর্থক। ফলে শুভেন্দুবাবু (শুভেন্দু অধিকারী) আমাদের বাড়িটিকেই বেছে নেন। আমার একতলার ঘরে মিটিং বসত। প্রথমটায় শুভেন্দুবাবুই থাকতেন। তারপর দু’জন লোককে দেখতাম। নারায়ণ আর সুকুমার। শুভেন্দুবাবুর সঙ্গেই ওরা আসত। পরে জানলাম ওরা মাওবাদী। কলকাতার কিছু ছেলে মেয়েও আমাদের বাড়ি গেছে। কয়েকদিন রাতেও থেকেছে তারা। ওরা যখন যেত নিচতলাটা ছেড়ে দিতাম”।
২ নভেম্বর ’০৮, শালবনীতে জিন্দাল ইস্পাত প্রকল্পের শিলান্যাস করে ফেরার পথে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে মাইন ফাটিয়ে হত্যার চেষ্টা করে মাওবাদীরা। ৩ নভেম্বর ’০৮, এ প্রসঙ্গে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন “আই ওয়াশ”। ৫ নভেম্বর, ০৮ মুখ্যমন্ত্রীকে মাইন ফাটিয়ে হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যাদের ধরা হয় তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য ছিল। ৬নভেম্বর ’০৮, ধর্মতলায় “গণতন্ত্র বাঁচাও”দিবসের দিন মাওবাদীদের সমর্থনে মমতা ব্যানার্জি বলেন - “যা ঘটছে সব মাও। আমি তো একটাও মাও দেখতে পাচ্ছি না। এসব সিপিআই(এম)’রই ছায়া। সব তাদেরই পরিকল্পনা। মহাশ্বেতা দেবীকে বলছে তুমি মাও। আমরা সবাই মাও। আর সিপিআই(এম) হয়েছে ফাও। মাওবাদীরা তো আদর্শবাদীও হতে পারে”।
৮ নভেম্বর ’০৮, লালগড়ে দলিলপুরচকে একটি বৈঠক থেকে মাওবাদীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি। ছত্রধর মাহাতো হন মুখপাত্র। তৃণমূল ও মাওবাদীরা এই কমিটির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিল। জনসাধারণের কমিটি ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে। এই দাবিগুলির অন্যতম ছিল - শালবনী বিস্ফোরণ কাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ধৃতদের ছেড়ে দিতে হবে।
২৬ নভেম্বর ’০৮, লালগড়ে তৃণমূলপন্থী বুদ্ধিজীবীরা যান। এঁরা ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন। স্কুল থেকে পুলিশ ক্যাম্প সরানোর দাবিতে লালগড়ের নাড়ঢ্যা থেকে জনসাধারণের কমিটির সশস্ত্র মিছিল বেরোয়। ছত্রধর মাহাতো ওই দিন বক্তব্য রেখে বলেছিলেন,“যেখানে উন্নয়নের ছিটেফোঁটা পৌঁছায়নি, সেখানে পুলিশেরও প্রয়োজন নেই। আমাদের অনুরোধ ২৪ ঘন্টার মধ্যে স্কুল থেকে পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হোক”। ৬ ডিসেম্বর ’০৮, লালগড়ে গিয়ে জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে বৈঠক করেন তৃণমূল নেতা পার্থ চ্যাটার্জি। ৪ ফেব্রুয়ারি ’০৯, জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের ডেরাতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জি ছত্রধর মাহাতো ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে সভা করেন। এদিন লালগড় থানা থেকে মমতা ব্যানার্জি ছত্রধরের পাঠানো মোটর সাইকেলে জঙ্গলে যান। ছত্রধরদের সঙ্গে বৈঠক করে তিনি জনসভাতেও বক্তব্য রাখেন।
২০০৯ সালে ছিল লোকসভা নির্বাচন। ছত্রধর মাহাতো দাবি করেছিলেন - লালগড়ের ভোটে সুশীল সমাজের লোকজনকেই ‘পর্যবেক্ষক’ রাখতে হবে। এই সুশীল-সুশীলারা তৃণমূলের এজেন্ট ছিল। ২৪ এপ্রিল ’০৯, কলকাতায় ব্যাপক গণ্ডগোল করার চেষ্টা করেছিল তৃণমূল ও মাওবাদীরা। ঐ দিন রানি রাসমণি রোডে ‘লালগড় সংহতি মঞ্চ’র পক্ষ থেকে সভা করা হয়। কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার মারা হয়। তাতে লেখা ছিল “সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের পথ দেখাল লালগড়”।
১১ জুন ’০৯, লালগড়ে সিপিআই(এম) কর্মী সালকু সোরেনকে মাওবাদী-তৃণমূলীরা নৃশংসভাবে খুন করে। ১৪ জুন মাওবাদী জনসাধারণের কমিটি লালগড়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। ওই দিন তিন সিপিআই(এম) নেতাকে খুন করে মাওবাদীরা। মাওবাদীদের আড়াল করে ১৭ জুন তৃণমূল বিবৃতি দিয়ে বলে, “লালগড়ে যা চলছে তা দু’টি কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে সংঘর্ষ”।
যদিও ওই দিনই ছত্রধর মাহাতো একটি ইংরেজি খবরের চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, “লালগড় আন্দোলনে তৃণমূলের সমর্থন আছে”। তিনি আরও বলেন, “ঝাড়গ্রাম ও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মাওবাদীরা এসে লালগড়ে রয়েছে”।
১৭ জুন ’০৯, রাজ্য সরকার লালগড়কে সশস্ত্র মাওবাদীদের দখলমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৃণমূল ঐ দিন প্রেস বিবৃতি দিয়ে বলে, “রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মদতেই মাওবাদী নাটক চলছে”। ১৮ জুন কিষেনজি বলেছিলেন, “নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে এমন কি লালগড়েও আমরা তৃণমূলের পাশে থেকেছি। সবরকমভাবে সাহায্য করেছি”। ওই দিন তৃণমূলপন্থী বুদ্ধিজীবীরা যৌথ অভিযানের বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন।
২১ জুন ’০৯, অর্পিতা ঘোষ, শাঁওলী মিত্র, অর্পনা সেন প্রমুখ তৃণমূলী বুদ্ধিজীবীরা লালগড়ে গিয়ে ছত্রধর মাহাতোর সঙ্গে দেখা করেন। জনসাধারণের কমিটির সুরেই বলেন, ১৪ জুলাই পর্যন্ত যৌথ অভিযান বন্ধ রাখতে হবে। মমতা ব্যানার্জি বলেন, “শুধু লালগড়ে যৌথ বাহিনী কেন?”
মাওবাদীদের এসব সন্ত্রাসকে সমর্থন জানিয়েছিল বিজেপি। ৫ জুলাই ’০৯, বিজেপি’র রাজ্য নেতৃত্ব দাবি করেছিলেন - ছত্রধর মাহাতো বিজেপি’র সদস্য। যদিও ওই দিনই ছত্রধর মাহাতো জানান, “আমি বরাবরই তৃণমূলের লোক ছিলাম। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের এখানে তৃণমূল প্রার্থী ক্ষমানন্দ মাহাতোর নির্বাচনী এজেন্ট ছিলাম”। ২৮ জুলাই ’০৯, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে লালগড়ে জনসাধারণের কমিটি ও মাওবাদীদের সঙ্গে দেখা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়, শিশির অধিকারী এবং বিধানসভার বিরোধী দলনেতা পার্থ চ্যাটার্জি।
২৬ সেপ্টেম্বর ’০৯, জনসাধারণের কমিটির মুখপাত্র ছত্রধর মাহাতোকে পুলিশ লালগড়ে তার গোপন আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার করে। ২৭ সেপ্টেম্বর ’০৯, তৃণমূলপন্থী বুদ্ধিজীবীরা একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে ‘লালগড়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’ এবং সিপিআই(এম)’র ‘পার্টি সন্ত্রাস’এর বিরোধিতা করে। ২৮ সেপ্টেম্বর তৃণমূল ঘনিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা বিবৃতি দিয়ে, ছত্রধর মাহাতোর গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করেন।
৬ নভেম্বর ’০৯, লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী বলেন, “ছত্রধর মাহাতো মাওবাদী কিনা সে বিষয়ে তিনি ওয়াকিবহাল নন। ছত্রধরের সঙ্গে তাঁর বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে। একবার ছত্রধর আমার বাড়িতে কয়েকজন মহিলা ও টিভি চ্যানেলের লোকজন নিয়ে আসেন। যখন আমাকে বলা হলো ওই মহিলারা মাওবাদী, আমি ওদের তাড়িয়ে দিয়েছিলাম”। এদিনই মমতা ব্যানার্জি বলেন, “জনসাধারণের কমিটি নিষিদ্ধ সংগঠন নয়”।
১০ নভেম্বর ’০৯, মমতা ব্যানার্জি ‘স্টার আনন্দ’ চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাওবাদী নেতা কিষেনজিকে তার সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওইদিন তিনি সাক্ষাৎকারে যা বলেছিলেন তার নির্যাস হলো - (১) কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় বসা। (২) সেই আলোচনায় তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি। (৩) তৃণমূলের সঙ্গে মাওবাদীদের অনেক ‘আন্দোলনমূলক’ মিল আছে। (৪) ছত্রধর মাহাতোকে গ্রেপ্তারের তিনি বিরোধিতা করেন। (৫) লালগড়ের যৌথ অভিযানের তিনি বিরোধী। মমতা বলেছিলেন, “আমরা লালগড় আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছি।’’
ছত্রধর মাহাতোকে ছেড়ে দেওয়ার দাবিতে মাওবাদীরা বারেবারে সন্ত্রাস তৈরি করেছে। তৃণমূল সেই সন্ত্রাসের সঙ্গী ছিল। ২৭ অক্টোবর ’০৯, ভুবনেশ্বর থেকে দিল্লিগামি রাজধানী এক্সপ্রেসকে ঝাড়গ্রামের কাছে বিকাল ৩টে নাগাদ জনসাধারণের কমিটি আটকে দেয়। বাঁশতলা স্টেশনে চার ঘণ্টা ট্রেনটিকে আটকে রাখে। তাদের দাবি ছিল ছত্রধর মাহাতোকে ছাড়তে হবে।
ওই সময় রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জি। তিনি খবর পাওয়া মাত্র বলেন, “মাওবাদীরা বলে দিয়েছে তারা একাজ করেনি। তাহলে কে করেছে? মাওবাদীদের নামে মার্কসবাদীরাই”। কিন্তু ওই দিনই শিশির অধিকারী বলেন, “ঝাড়গ্রামের কাছে বাঁশতলায় মাওবাদী উগ্রপন্থীরা যে রাজধানী এক্সপ্রেস আটকাবেন তা তিনি জানতেন”। ২৮ অক্টোবর রেল কর্তৃপক্ষ ঝাড়গ্রাম থানায় এবং জিআরপি’তে অভিযোগ করে। কিন্তু ওই অভিযোগপত্রে কারও নাম ছিল না। এমন কি জনসাধারণের কমিটির কথাও ছিল না।
ছত্রধর মাহাতো-তৃণমূল যোগ প্রমাণিত হয় ১১ জানুয়ারি ২০১০, ‘স্টার আনন্দ’ চ্যানেলে এক বিতর্কসভায়। ওই চ্যানেলে তৃণমূলের সাংসদ কবীর সুমন তৃণমূল-মাওবাদী গাঁটছাড়ার কথা বলেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে কবীর সুমন তৃণমূল-ছত্রধর এবং মাওবাদীদের সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য বলে ফেলেছিলেন। ২৩ জানুয়ারি ’১০, ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ জেলবন্দি ছত্রধর মাহাতোর মমতা ব্যানার্জিকে উদ্দেশ্য করে একটি খোলা চিঠি প্রকাশিত হয়। ওই চিঠিতেই ছত্রধর-তৃণমূল গভীর সম্পর্ক প্রমাণিত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি ’১০, মাওবাদী শাখা সংগঠন পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির সভাপতি লালমোহন টুডু যৌথবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন। ৬ মার্চ ’১০, লালমোহন টুডুকে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ সংবলিত চিঠি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠান তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বুদ্ধিজীবীরা।
শুধু তাই নয়, ৫ আগস্ট ’১০, মাওবাদী নেতা কিষেনজি সংবাদ মাধ্যমকে জানান - ৯ আগস্ট লালগড়ে মমতা ব্যানার্জির জনসভাকে মাওবাদীরা সমর্থন করছে।
৩০ জানুয়ারি ’১১ লালগড়ের স্কুলের মাঠে তৃণমূল কংগ্রেস ও জনসাধারণের কমিটির যৌথসভায় বক্তব্য রেখেছিলেন শিশির অধিকারী, মুকুল রায়। ওই সভায় শুভেন্দু অধিকারী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেছিলেন, “বামফ্রন্টবিরোধী শক্তি এক জায়গায় এসেছে। কে কোন্ পতাকা নিয়ে এসেছে সেটা বড়ো কথা নয়”। ৩১ জানুয়ারি মেদিনীপুর শহরে পুরসভার অতিথি নিবাসে তৃণমূলের সাজানো ত্রাণ শিবির থেকে ধরা পড়ে মাওবাদী স্কোয়াড সদস্য অমিয় মাহাতো, অসীম মাহাতো।
১১ এপ্রিল, ’১১-র বিধানসভা নির্বাচনে মাওবাদীরা তৃণমূলকে সমর্থন করবে এবং সিপিআই(এম)-কে প্রচারে বাধা দেবে বলে ঘোষণা করে। ছত্রধর মাহাতোকে বীর নেতা বলে চিহ্নিত করা হয়। ৬ মে ’১১, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহলের সভাগুলিতে তৃণমূল নেত্রী বলেছিলেন, “লালগড়ে ২০০৮-এর নভেম্বর থেকে আন্দোলন শুরু করেছিল তৃণমূলই”।
২০১১’তে বামফ্রন্টকে উৎখাত করতে বড়ো ভূমিকা ছিল ছত্রধর মাহাতোদের। তাই ২০২০ সালে ছত্রধর মাহাতোকে বড়ো পুরস্কার দিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তৃণমূলের রাজ্য কমিটিতে ঠাই দিয়ে। কিন্তু শালকু সোরেন, শঙ্কর সামন্তদের রক্ত কিংবা মার্শাল মুর্মুর প্রতিরোধ বৃথা যাবে না। একদিন সত্যের জয় হবেই। নীতিহীন রাজনীতি পরাস্ত হবেই।