৫৭ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা / ৩১ জুলাই ২০২০ / ১৫ শ্রাবণ ১৪২৭
মানুষের পাশে আমরাই
তাপস সিনহা
গড়বেতায় কমিউনিটি কিচেনে খাদ্য বিতরণ করছেন অভিনেতা বাদশা মৈত্র, সীমা মুখোপাধ্যায়, তাপস সিনহা প্রমুখ।
আমরা শূন্য,আমরা সাত,আমাদের দূরবিন দিয়ে দেখতে হবে। হ্যাঁ, সেই দূরবিন দিয়েই দেখা বামপন্থীরা আজকের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে ও দেশের বাইরে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় প্রস্তুতিহীন লকডাউনে প্রান্তিক, অসহায় মানুষের পাশে। লকডাউনের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দফা শেষ, চলছে আনলক প্রক্রিয়া। রাজ্যে এখন সপ্তাহে দু’দিন লকডাউন। উদ্ভূত পরিস্থিতির শুরু থেকেই, ভিন্ রাজ্যে বিভিন্ন কাজে গিয়ে আটকে থাকা মানুষ বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকরা যাদের বাসস্থান অনিশ্চিত, যাদের কাছে কোনো খাবার নেই এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার পর থেকেই আমাদের রাজ্যসহ সারা দেশের সবকটা রাজ্য ও জেলায় সিপিআই(এম) দপ্তর আরও তৎপর হয়ে উঠল। ব্যতিক্রম নয় সি পি আই(এম) পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা কেন্দ্র।
রাজ্য নেতৃত্বের পরামর্শ অনুযায়ী জেলা কেন্দ্রের পরিকল্পনা মাফিক, জেলার এরিয়া কার্যালয় খুলে দ্রুত হেল্প লাইন চালু হলো। জেলাকেন্দ্রে মুহুর্মুহু ফোন দিল্লি, কর্ণাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র, অসম, তামিলনাড়ু, কেরালা, ওডিশা, হরিয়ানা, পণ্ডিচেরি, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর, ছত্তিশগড়, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে সেলাই থেকে জরির কাজ বা রাজমিস্ত্রি থেকে মার্বেল বসানো মিস্ত্রিভাইরা অথবা সোনার কারিগর ও ফেরিওয়ালারা, নানান পেশায় যুক্ত সারা রাজ্যের বিভিন্ন জেলার শ্রমিকরা লকডাউনে আটকে। চরম দুরবস্থায় তখন মনসুর, সাত্তার,সৌরভ, রওশন, গৌতম, আজিজুল, সঞ্জয়, রবীন, সেখ আবু, তহিদুর, ইসরাফুদ্দিনের মতো হাজার হাজার শ্রমিক। অসহায় মানুষের মনে তখন বাঁচার ন্যূনতম আশা সিপিআই(এম)। সেখান থেকেই তাঁরা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলো নিজেদের জেলার পার্টি কমরেডদের সাথে। তাঁদের খাদ্য নেই,জল নেই,কোথাও কোথাও মাথার উপর ছাদও নেই, কিন্তু যথারীতি সিপিআই(এম) আছে। পরিযায়ীদের দলের কারো একজনের ফোন নম্বর ঠিকানা,সংখ্যা নিয়েই খবর গেল জেলা থেকে রাজ্যে, রাজ্য থেকে ভিন্ রাজ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। সিপিআই(এম) এবং বিভিন্ন বামপন্থী গণ সংগঠনের বন্ধুরা, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বন্ধুরা প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী নিয়ে পৌঁছে গেল। শুধু পরিযায়ী শ্রমিকবন্ধুরা নন, চিকিৎসা করতে গিয়ে ভেলোর, পন্ডিচেরি, বাঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, পুনে, চেন্নাইতে অসুস্থ রোগী নিয়ে আটকে থাকা অসহায় মানুষের পাশে। শুধু খাদ্য সামগ্রীই নয়, রান্না করার জ্বালানি গ্যাস পৌঁছে দিয়েছে সেই রাজ্যের কমরেডরা।
শুধু দেশ নয়, দেশের বাইরেও দুবাইতে অসহায় অবস্থায় কাঠের কাজ করতে যাওয়া মানোয়ার বিশ্বাস সহ দুই শতাধিক কাঠের মিস্ত্রির নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বর পাবার পরেই মাধবনের মতো বামপন্থী বন্ধু সবাইকে খুঁজে বের করে আশ্রয়স্থল ও পর্যাপ্ত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। মানোয়ারদের এখন থাকা খাওয়ার দুশ্চিন্তা নেই, ঘরে ফেরার চিন্তায় চিন্তিত তাঁরা। দাসপুর থেকে সোনার কাজ করতে নেপালে যাওয়া রবি পাত্র সহ শতাধিক সোনার কারিগর যখন কাঠমাণ্ডুতে দিশেহারা অবস্থায়, তখন জানানো হলো নেপাল ইয়ুথ ফেডারেশনের প্রাক্তন নেতা, বর্তমানে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন্দ্রনকে। সকলের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে ভরসা দিলেন রবীন্দ্রন সহ বামপন্থী বন্ধুরা। শুধু পরিযায়ী শ্রমিক নন, হরিদ্বারে তীর্থ করতে যাওয়া মানুষকে যখন হরিদ্বারের হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়, খবর পেয়ে ছুটে গেলেন হরিদ্বারের সিপিআই(এম) নেতা বিজয় মিশ্র সহ অন্যান্য নেতৃত্ব। এছাড়া বাড়িতে ফিরতে চেয়ে দাঁতন-চিঁচড়া চেকপোস্টে আটকে থাকা মানুষদের অনেকের কাছে যখন খাবার নেই, শিশুদের দুধ নেই - তখন ওই সমস্ত মানুষের জন্য খাবার ও শিশুদের জন্য দুধ নিয়ে দৌঁড়েছেন বামপন্থী বন্ধুরা। পাশাপাশি শুরু হলো জেলার ব্লকে ব্লকে সাবান, সঙ্গে সচেতনতা পত্র বিলির কাজ, সাথে সাথে জেলার দিনআনা দিন খাওয়া ও প্রান্তিক মানুষের খাদ্য সঙ্কট মেটাতে খাদ্য সামগ্রী হিসাবে চাল ডাল, মশলাপাতি, সবজি ও ডিম ইত্যাদি বিতরণের কাজ শুরু হলো। তখনও রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো সাহায্য মানুষের কাছে আসেনি, শুরু হলো কমিউনিটি কিচেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই নিদিষ্ট দূরত্বে সার্কেলের মধ্যে দাঁড়িয়ে নানান অংশের মানুষ রান্না করা খাবার পরিবারের সদস্য সংখ্যার অনুপাতে নিয়ে গেলেন। কোনো কোনো কেন্দ্র থেকে মানুষকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বসিয়ে খাওয়ানোর কাজ শুরু হলো। এবার স্রোতের বেগে আসতে শুরু করলো পরিযায়ী শ্রমিকদের বাস। দীর্ঘ পথে খাবার নেই, পানীয় জল নেই - সে এক দুর্বিষহ অবস্থা।
ধাদিকায় কমিউনিটি কিচেনে অসহায় মানুষদের বসিয়ে খাওয়ানো হচ্ছে।
ওডিশা রাজ্য শেষ হলেই বাংলার বর্ডার, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শুরু। বর্ডারেই বাংলায় প্রবেশের সাথে সাথে পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসে বাসে খাদ্য সামগ্রী,ফল,বাচ্চাদের দুধ তুলে দেওয়ার কাজ চলতে থাকে। শুধু বর্ডার না, জেলায় পার্টির বিভিন্ন এরিয়া কমিটি বিভিন্ন জায়গায় বাড়িফেরা মানুষদের গাড়িতে রান্না করা খাবার ও শুকনো খাবার তুলে দেবার কাজ করলো। এরপর শুরু হলো নতুন সমস্যা। মানুষ ফেরার পরে যাদের বিভিন্ন স্কুলে কোয়ারান্টাইন সেন্টারে রাখা হচ্ছে, সেখানেও অব্যবস্থা - খাদ্য নেই, নেই পানীয় জল। সেখানেও পার্টি ও বিভিন্ন গণসংগঠনের কমরেডরা সাহসিকতার সাথে ছুটে গেছেন। লক-আনলক যাই হোকনা কেন এই রাজ্যে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় মানুষের দুরবস্থার শেষ নেই। বর্তমানে চারদিকে দ্রুত সংক্রমণের কারণে জেলার বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে এক একটি সংক্রমিত এলাকা চিহ্নিত করে বাঁশের বেড়া দিয়ে একটি ফ্লেক্সে কনটেইনমেন্ট জোন লিখে দায়িত্ব সারছে সরকার ও প্রশাসন। সেই এলাকায় বসবাসকারী মানুষেরা দৈনন্দিন জীবনযাপন কী করে করবেন সে বিষয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই প্রশাসনের। সেই সমস্ত এলাকাতেও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী বেড়ার এপারে দাঁড়িয়ে কনটেইনমেন্ট জোনের ভেতরে থাকা মানুষের হাতে সরবরাহ করছেন কমরেডরা। সাথে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের রক্তের চাহিদা পূরণে রক্তদানে এগিয়ে যাচ্ছেন বামপন্থী সংগঠনগুলো।
বিজ্ঞান মঞ্চের বন্ধুরা সেনিটাইজার তৈরি করে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে সারা জেলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এই সময়কালের মধ্যে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের জন্য দ্রুততার সাথে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সামগ্রী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বামপন্থী কমরেডরা। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় চূড়ান্ত অব্যবস্থার বিরুদ্ধে পার্টি ও বিভিন্ন গনসংগঠনের ডাকে এবং বাম সহযোগী ও কংগ্রেস সহ সমস্ত যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি আমাদের নজর এড়িয়ে যায়নি। কখনো জেলা শাসক, জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক, মহকুমা শাসক, ব্লক আধিকারিদের কাছে ডেপুটেশন, অবস্থান, বিক্ষোভ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। এই কর্মসূচি সংগঠিত করতে গিয়ে পার্টির রাজ্য-জেলার নেতৃত্ব ও কমরেডরা দফায় দফায় গ্রেপ্তার হয়েছেন।
আলোচ্য সময়ে বামপন্থীদের ভূমিকা মিডিয়া সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেও, সোশ্যাল মিডিয়া প্রতিটি বিষয় তুলে ধরে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। লড়াই ক্রমশ তীব্রতর হচ্ছে।এলাকায় এলাকায় পার্টির নানাবিধ কর্মসূচিতে আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। ভিন্রাজ্য থেকে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিক থেকে এলাকায় এলাকায় পুরনো ও নতুন বন্ধুরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে লালঝান্ডার মিছিলে শামিল হচ্ছেন। পরিযায়ী শ্রমিকরা বিভিন্ন এলাকায় সভাগুলিতে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ‘‘এই দূর্বিষহ অবস্থায় আমরা শত চেষ্টা করেও তৃণমূল এবং বিজেপি’র কাছ থেকে কোনো সাহায্য পাইনি। নির্বাচনের সময় দেওয়া প্রতিশ্রুতি ওরা রক্ষা করেনি, একমাত্র সিপিএম ছাড়া কেউ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি”। একই কথা বলছেন এলাকার মানুষেরাও। না, দেশ-বিদেশে কর্মসুত্রে যাওয়া অবরুদ্ধ অসহায় আর্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে আমরা কারো রাজনৈতিক রং দেখিনি, জিজ্ঞেস করিনি গত নির্বাচনে কাকে ভোট দিয়েছেন। মানুষের পাশে থাকাটাই যে মানবতা। আমরা মানুষের পাশে ছিলাম আছি থাকব।