৬০ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ৩১ মার্চ, ২০২৩ / ১৬ চৈত্র, ১৪২৯
দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা
রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ
অর্ণব ভট্টাচার্য
২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচন চলাকালীন রাহুল গান্ধীর একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দায়ের হওয়া মানহানি মামলায় গুজরাটের এক নিম্ন আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ করেছেন লোকসভার স্পিকার ওম প্রকাশ বিড়লা। যদিও কোর্ট থেকে রাহুল গান্ধীকে জামিন দেওয়া হয়েছে এবং উচ্চতর আদালতে ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এগুলিকে বিবেচনার মধ্যে না রেখে অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে দেশের প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম নেতার সাংসদ পদ খারিজ করে দেওয়া হলো। বোঝাই যাচ্ছে যে মোদি সরকারের অসহিষ্ণুতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও স্বৈরাচার কী ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে এহেন প্রবণতা ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত। ইতিমধ্যেই সিপিআই(এম) সহ দেশের বিজেপি বিরোধী দলগুলি এই চরম অগণতান্ত্রিক ও বিপজ্জনক প্রবণতার বিরুদ্ধে ধিক্কার জানিয়েছে।
এই সমস্ত বিতর্ক চলার মধ্যেই হয়তো অনেকের লক্ষ করেছেন যে, দেশের রাজধানীতে ‘‘মোদি হটাও দেশ বাঁচাও’’ লেখা পোস্টার ও ব্যানার টাঙানোর জন্য ৪৪টা এফআইআর করা হয়েছে এবং দুজন ছাপাখানার মালিকসহ চারজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ক্রমশ গোটা দেশকে বিরোধীশূন্য করবার এক ভয়ঙ্কর ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করেছে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি।
অন্যদিকে জি-টুয়েন্টি বৈঠক উপলক্ষে ছাপানো পোস্টারে কিংবা স্বাধীনতার ‘‘অমৃত কাল’’ উদ্যাপনের বিজ্ঞপ্তিতে ভারতকে 'গণতন্ত্রের মা' বলে প্রচার চলছে। মুখ আর মুখোশের এই পার্থক্য ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের কাছে।
আসলে আরএসএস-বিজেপি’র আতঙ্ক অন্য জায়গায়। এবার সংসদে প্রধান আলোচ্য বিষয় হওয়ার কথা ছিল শিল্পপতি আদানির সাম্রাজ্য তৈরি হওয়ার পিছনে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষত প্রধানমন্ত্রী ভূমিকা। বিগত এক দশকের ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে যে, এ কোনো ভিত্তিহীন অপপ্রচার নয় যে মোদি ও তাঁর দলের বদান্যতায় গৌতম আদানির এতটা বাড়বাড়ন্ত। স্টেট ব্যাঙ্ক এবং এলআইসি’কে তাদের সংস্থায় জমা জনগণের টাকা আদানির সংস্থায় বিনিয়োগ করতে বাধ্য করা, দেশের বিভিন্ন এয়ারপোর্ট আদানির হাতে তুলে দেওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের একচেটিয়া অধিকার আদানিকে দেওয়ার মত বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ রয়েছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। সংসদে এই সমস্ত বিষয়ে আলোচনা বন্ধ করার জন্য প্রথমে রাহুল গান্ধীর বিদেশে বক্তৃতাকে ভারত বিরোধী বলে শোরগোল তুলে দেওয়া হয়। এরপর আদানি গোষ্ঠীর অপকর্মের তদন্ত করবার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠনের জন্য বিরোধী দলগুলির দাবি এই সরকার যেভাবে নাকচ করেছে তাতেই স্পষ্ট যে শাসকের সাথে এই ধান্দাবাজ শিল্পপতির কি গভীর যোগাযোগ। কিন্তু শাসকদলের অস্বস্তি ও অসহিষ্ণুতা কি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বোঝা গেল যখন আইনের ধূর্ত প্রয়োগের সুবাদে সংসদে প্রধান বিরোধী দলের অন্যতম নেতার সাংসদ পদই বাতিল করে দিল সরকার।
প্রশ্ন এটা নয় যে রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবনের কী হবে, প্রশ্ন এটা যে ভারতীয় গণতন্ত্র কোন পথে এগোবে? আদৌ কি এগোতে পারবে যদি এই স্বৈরাচারী ও ধর্মান্ধ দল ক্ষমতায় থাকে?
গণতন্ত্রের প্রধানতম শর্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মতবিনিময় এবং বিরোধিতার অধিকার। আরএসএস-এর নির্দেশ মেনে চলা এই কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনো প্রকারের বিরোধী মতামতকে "দেশবিরোধী" আখ্যা দিয়েই কেবল ক্ষান্ত নয়, সরকার বিরোধী মত প্রকাশ করলেই সেই ব্যক্তিকে ভয় দেখানো, শারীরিক আক্রমণ ও কারারুদ্ধ করার মতো ঘটনা বারে বারে ঘটেছে বিগত আট বছরে।স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান থেকে সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ থেকে অভিনেতা এমনকী সাংবাদিকরাও শাসকের রুদ্ররোষের শিকার।
সম্প্রতি কর্ণাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা ও সমাজকর্মী চেতন কুমারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তথাকথিত ‘‘হিন্দু বিরোধী’’ মন্তব্যের জন্য। চেতনের অপরাধ যে তিনি হিন্দুত্ববাদী ভাবনাকে মিথ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলেছেন। তিনি সাভারকরের বক্তব্যের সমালোচনা করেন, বাবরি মসজিদকে রামের জন্মস্থান বলে দাবি করাকে ভ্রান্ত আখ্যা দেন এবং টিপু সুলতানকে দুইজন হিন্দু হত্যা করেছিল বলে বিজেপি'র পক্ষ থেকে যে রটনা হচ্ছে তাও মিথ্যা প্রচার বলে সোশ্যাল মিডিয়াতে মন্তব্য করেন। যথারীতি বিজেপি শাসিত কর্ণাটকে চেতন কুমারের স্থান হয় কারাগারে।
মোদির রাজত্বে এভাবে বিরোধী স্বর দমন করা, সমালোচকদের নির্যাতন করার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। হাথরসে দলিত কন্যার নৃশংস ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা রিপোর্ট করতে যাওয়া সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের দু'বছর হাজতবাস নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি। ভীমা-কোরেগাঁও-এর বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার সমাজকর্মী, অধ্যাপকরা এখনো জেলে। অশীতিপর ফাদার স্ট্যান স্বামীকে তো কার্যত চিকিৎসার যথাযথ সুযোগ না দিয়ে হত্যা করা হল। এরকম অসংখ্য ঘটনার একটাই অর্থ যে আরএসএস- বিজেপি'র মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করার যে কোনো প্রয়াসকে সমূলে বিনাশ করার ফ্যাসিস্ট প্রক্রিয়া আমাদের দেশে চলছে যাকে প্রতিহত না করতে পারলে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জন ও অর্জিত অধিকার রক্ষা করা যাবে না।
আরএসএস-বিজেপি'র এই স্বৈরাচারের সুবাদে যে সামাজিক শ্রেণিটি সবচেয়ে বড়ো লাভবান হচ্ছে তা হলো বৃহৎ পুঁজির মালিকরা। তারাই এই সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী শক্তির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। ১৯৯১ সাল থেকে আমাদের দেশে তথা বিশ্বে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে তার অন্যতম শর্ত দেশে দেশে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করা। ইতিহাসের শিক্ষা যে, চিলিতে সাতের দশকে স্বৈরাচারী পিনোচেতের রাজত্বে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা প্রথম রূপায়ণ করা হয়। ফুটবল মাঠকে সরকার বিরোধীদের বধ্যভূমিতে পরিণত করা পিনোচেত, বিপ্লবী কবি ভিক্টর জারাকে হত্যা করা পিনোচেত যেমন করপোরেটকুলের চোখের মণি ছিলেন, তেমনি উগ্র ধর্মান্ধতার রাজনীতির কারবারি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রচারক মোদির শাসন করপোরেট শ্রেণির বড়োই প্রিয়। মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র মানেই জানে যে, বুর্জোয়া গণতন্ত্র যখন বুর্জোয়াদের অর্থনৈতিক ও মতাদর্শগত আধিপত্যের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বুর্জোয়ারা একে ধ্বংস করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। আজ ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রকে আরএসএস- বিজেপির তত্ত্বাবধানে টুঁটি চিপে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। তাই আরএসএস- বিজেপি বিরোধীদের ওপর এত আক্রমণ-হয়রানি। সারা বছরে সংসদ সচল থাকার দিনের সংখ্যা ক্রমশ কমানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে । সংসদের অভ্যন্তরে কার্যত বিনা আলোচনাতেই পাস করে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ বিল। বাজেট নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। বিরোধীশূন্য দেশ তৈরি করার এই প্রকল্পের সুবাদে প্রহসনে পরিণত করা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদীয় গণতন্ত্রকে।
আসলে মর্মবস্তুর দিক থেকেই সম্প্রদায়িকতার দর্শন গণতন্ত্র বিরোধী কেননা তা সহাবস্থান ও সমন্বয়ে বিশ্বাস করে না। করপোরেটের আধিপত্যের জন্য এই মতাদর্শ সবচেয়ে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। তাই ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণি এখন সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদীদের সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষকে পর্যবসিত হয়েছে। গণতন্ত্রে যে আলোচনার পরিসর থাকে তাতে সত্য উদঘাটিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বহুত্ববাদ বিকশিত হয়। তাই গণতন্ত্রকে পদদলিত করবার জন্য করপোরেট শক্তি ও সাম্প্রদায়িক আরএসএস একে অপরের হাত ধরাধরি করে চলছে। এর ফলে কার্যত এক অঘোষিত জরুরি অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে আমাদের দেশ। মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বার্থে, নিজেদের প্রাপ্য ছিনিয়ে নেওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রক্ষা করতে হবে। গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের স্বার্থে সমস্ত সচেতন ভারতবাসীর তাই একত্রিত হওয়ার সময় এসেছে।