৬০ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ৩১ মার্চ, ২০২৩ / ১৬ চৈত্র, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত গণতান্ত্রিক কাঠামো তত্ত্ব ও তথ্য (পাঁচ)
ঈশিতা মুখার্জি
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় কেমন আছে গ্রামের মানুষ? গ্রামীণ পরিকাঠামো কেমন এ রাজ্যে? সাধারণত পরিকাঠামো তো পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানেই গড়ে ওঠে বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন ব্যবস্থায়। কিন্তু বিজেপি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নীতি গ্রহণ করেনি; বরং ঘটেছে চরম কেন্দ্রীকরণ। দেশের রাজ্যগুলির গ্রামের পরিকাঠামো এবং ব্যবস্থার সমীক্ষা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার মিশন অন্ত্যোদয় যোজনার প্রকল্পে। ২০২০ সালে এই সমীক্ষা তারা করে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের তরফ থেকে। এই তথ্য থেকেই জানা যায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষ কীরকম সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছে। অন্য রাজ্যের তুলনায় কেমন আছেন এ রাজ্যের গ্রামের মানুষ? গ্রামের পঞ্চায়েত কী কাজ করছে তাও কিছুটা জানা যায় এই তথ্যে। ২০২০ সালের এই তথ্যই একমাত্র দেশের সব রাজ্যের পঞ্চায়েতের সমীক্ষা যার রিপোর্ট আমাদের কাছে আছে।
প্রথমে দেখা যাক গ্রাম পঞ্চায়েত গ্রামের মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে কিনা। পশ্চিমবঙ্গে ৩২৩১টি গ্রাম পঞ্চায়েতে পুরো অথবা কিছুটা সমীক্ষা করা হয়েছে। সারা দেশে সমীক্ষা করা হয়েছে ২৬৭৪৬৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের। সেই সমীক্ষার কিছু ফল সারণি-১ এ দেওয়া হল।
সারণি ১ - পশ্চিমবঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েতে সুযোগ-সুবিধা
যে ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে আছে | যে ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে নেই | |
কৃষিতে সরকারি বীজ কেন্দ্র | ৭৬৩ | ২৪৬৮ |
কৃষিতে শস্য রাখার গুদামঘর | ৬১৫ | ২৬১৬ |
জমি পরীক্ষা করার কেন্দ্র | ৪৭৮ | ২৭৫৩ |
সার বিক্রয়কেন্দ্র | ২৭৩৩ | ৪৯৮ |
সব আবহাওয়ায় যাতায়াত করার রাস্তা | ৩০৫৮ | ১৭৩ |
রেল স্টেশন যাওয়ার রাস্তা | ৬৪৯ | ২৫৮২ |
এই আমাদের গ্রামের পরিকাঠামোর ব্যবস্থা। দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র সার বিক্রয়কেন্দ্র এবং রাস্তার অবস্থা কিছুটা অন্য পরিকাঠামোর তুলনায় ভালো। কিন্তু প্রতি গ্রাম পঞ্চায়েতে এই পরিকাঠামো নেই। সার বিক্রয়কেন্দ্রে অবশ্য বেসরকারি লেনদেন হয় এবং সেখানে বিক্রেতারাই গড়ে তোলে এই কেন্দ্রগুলি।
এবার সরাসরি আলোচনা করি পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে যে কমিউনিটি সম্পদ রক্ষার কাজ পঞ্চায়েত করে সেখানে কী পরিস্থিতি। সারণি ২ দেখিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য পঞ্চায়েত মানুষের প্রয়োজনীয় সম্পদ কতটা রক্ষণাবেক্ষণ করেছে।
সারণি ২ - পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিটি সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ
যে ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে আছে | যে ক’টি গ্রাম পঞ্চায়েতে নেই | |
সাধারণ পরিষেবা কেন্দ্র পঞ্চায়েত দপ্তরে অবস্থিত | ৭৫১ | ২৪৮০ |
সাধারণ পরিষেবা কেন্দ্র আলাদা স্থানে অবস্থিত | ১৩৫৫ | ১৮৭৬ |
সাধারণ পরিষেবা কেন্দ্র নেই | ১১২৫ | ২১০৬ |
পঞ্চায়েত ভবন | ২৮৭৫ | ৩৫৬ |
সাধারণ তথ্য জানার বোর্ড নেই | ৬২১ | - |
সাধারণ তথ্য জানার বোর্ড আছে এবং তাতে পূর্ণ তথ্য আছে | ২২১২ | - |
লক্ষ করে দেখলে দেখা যায় যে, সাধারণ পরিষেবা কেন্দ্র পঞ্চায়েত ছাড়া আলাদা জায়গায় এর সংখ্যা বেশি। এই আলাদা জায়গা কোথায় সমীক্ষা সেই কথা জানায় না। সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায় যে, অধিকাংশ সময়েই তথ্য জানার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের কার্যালয়ে বা কোনো প্রভাবশালী নেতা নেত্রীর বাড়িতে যেতে হয় গ্রামবাসীকে। সেখানে যে আর্থিক লেনদেন এবং দুর্নীতির তথ্য আমাদের সামনে আছে তার সুবিধাও পাওয়া যায়। সারণি ২ উল্লেখযোগ্য, কারণ এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কমিউনিটি উন্নয়নের কাজ থেকে কতটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সরে এসেছে, যার উল্লেখ আগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সংকট এখানেই। পঞ্চায়েত গ্রামের মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার কাজ থেকে সরে এসেছে। কমিউনিটি পরিষেবা যার উৎপত্তি গ্রামাঞ্চলে বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত ব্যবস্থার হাত ধরে যেখানে পরিষেবা কীরকম হবে সে বিষয়ে কথা বলার সুযোগ থাকার কথা গ্রামের মানুষের, সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। তাই বর্তমান যে ব্যবস্থা চলছে তা মানুষের পঞ্চায়েত কোনো অবস্থাতেই নয়। বিভিন্ন জেলার চিত্র দেখলে আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারব কোথায় গ্রামের সাধারণ মানুষের থেকে পঞ্চায়েত মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
শুধুমাত্র যে গ্রামের মানুষকে দূরে সরিয়ে রেখেছে পঞ্চায়েত তা নয়, বর্তমান পঞ্চায়েত ব্যবস্থার গ্রামোন্নয়নের কোনো প্রচেষ্টা নেই। পঞ্চায়েতের যেটুকু আর্থিক ক্ষমতা ছিল, তা ধ্বংস করেছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। মাত্র কিছুদিন আগের যে তথ্য পাওয়া গেল, তাতে জানা যায় যে, ১৫ তম অর্থ কমিশন থেকে পঞ্চায়েতগুলি উন্নয়ন বাবদ যে বরাদ্দ অর্থ পেয়েছে তা দিয়ে রাজ্য সরকার তাদের বিদ্যুতের বিল মেটাতে বলেছে।অর্থ কমিশনের এই বরাদ্দ অর্থ তো মুলধনী ব্যয়, যা দিয়ে পঞ্চায়েতের গ্রামের মানুষের স্বার্থে সম্পদ সংগ্রহ করার কথা। বিদ্যুতের বিল বাবদ ব্যয় তো রাজস্ব ব্যয়। কখনো আর্থিক ব্যবস্থায় মুলধনী ব্যয়কে রাজস্ব ব্যয়ে রূপান্তরিত করা যায় না। তা করলে ক্ষতি হবে গ্রামের মানুষের উন্নয়ন। এরকম নির্দেশ রাজ্য সরকারের তরফে এই প্রথম দেওয়া হলো বলে জানা গেছে। এই নির্দেশ দেওয়ার যে কারণ জানা যায় বা যা সঙ্গত কারণেই অনুমান করা হয়, তা হলো পঞ্চায়েতের কাছে কোনো রাজস্ব সংগ্রহ নেই যা দিয়ে তারা বিদ্যুতের বিল মেটাতে পারে। বামফ্রন্টের সময়ে, কেরালার পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পঞ্চায়েতের নিজস্ব রাজস্ব সংগ্রহ থাকে। গত কয়েক বছরে রাজ্য সরকার পঞ্চায়েতের নিজস্ব উদ্যোগে রাজস্ব সংগ্রহের কোনো পরিকল্পনা নেয়নি বা চায়নি।পঞ্চায়েতগুলি আর্থিকভাবে ধুকছে বলা চলে। অথচ এই পঞ্চায়েতের শীর্ষ নেতৃত্ব সকলে আকণ্ঠ ডুবে আছে দুর্নীতিতে। কিন্তু পঞ্চায়েত গ্রামোন্নয়নের স্বার্থে যে নিজস্ব সম্পদ সংগ্রহ করবে, তার কোনো ব্যবস্থাই নেই। ওদিকে অর্থ কমিশনের এই বরাদ্দ অর্থ দিয়ে গ্রামে পানীয় জল সরবরাহ, বৃষ্টির জল ধরে রাখা, স্যানিটেশন ব্যবস্থা তৈরি করা ইত্যাদি বাবদ ব্যয় করার কথা।দীর্ঘদিন পঞ্চায়েতগুলির কোনো রাজস্ব আয় না থাকার ফলে বর্তমানে বিদ্যুতের অনাদায়ী বিলের পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। যে অর্থ মানুষের জন্য ব্যয় করার কথা, সেই অর্থ দিয়ে জমে থাকা বিদ্যুতের বিল মেটাবে পঞ্চায়েত। এই আর্থিক দুর্দশার জন্য তৃণমূল সরকারের পঞ্চায়েতকে ঘিরে শুধুমাত্র দুর্নীতির চক্র গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কোনো কারণ নেই। এই তথ্যের পাশাপাশি যে তথ্য রাখা যায় তা হলো পঞ্চায়েতের আর্থিক উন্নতির জন্য রাজ্য কোষাগারের অর্থ ব্যয় করে রাজ্য সরকার উপদেষ্টামণ্ডলী নিয়োগ করেছিল এ বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। এই উপদেষ্টামণ্ডলী ২০১৮-১৯ সালের পঞ্চায়েতের পরিকল্পনা ২০২২ সালে কতটা বাস্তবায়িত হলো, তা আরও উন্নত কীভাবে করা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেবে। ২০২২ সালের নিযুক্ত ওই উপদেষ্টামণ্ডলী কী উপদেশ দিলেন জানা যায় না। কিন্তু ২০২৩ সালে দেখা গেল আর্থিক ব্যবস্থা উন্নতির জন্য উপদেষ্টামণ্ডলী নিযুক্ত করার পর রাজ্য সরকার উন্নয়নের টাকা নিয়ে বিদ্যুতের বিল মেটাতে বলছে। তাই আদৌ যে সরকার পঞ্চায়েত ব্যবস্থা মজবুত করতে চায়, তা কোনভাবেই প্রমাণিত নয়। বরং এই কথা প্রমাণিত যে সরকার গ্রামের মানুষের উন্নয়ন বা বিকাশ কোনোটাই চায় না।
পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে শহরের চেয়ে বেকারি অনেক বেশি, জিনিসপত্রের দাম বেশি, পরিশুদ্ধ পানীয় জলের সরবরাহ কম, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্য বেশি। ঠিক এই কাজগুলিই করার কথা ছিল মানুষের পঞ্চায়েতের। সম্পদ সংগ্রহ থেকে সম্পদ সৃষ্টির কথা ছিল পঞ্চায়েতের, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় বিভিন্ন গ্রামে এই কাজগুলিই হয়নি। কিন্তু গ্রামে অপরাধের চক্র বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিন গ্রামবাংলায় কোথাও না কোথাও ঘটে চলেছে কোনো না কোনো অপরাধ। মহিলাদের নিরাপত্তা তীব্রভাবে বিঘ্নিত। মহিলাদের উপর হিংসা প্রায় প্রতিদিন ঘটে চলেছে গ্রামবাংলায়। প্রকল্পগুলি ঘিরে ঘটে চলেছে একের পর এক কেলেঙ্কারি। এরমধ্যে ইন্দিরা আবাস যোজনায় কেলেঙ্কারি রেকর্ড পরিমাণের। ওদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ করে রেগা বা একশ’ দিনের কাজের প্রকল্পে ঘোষিত বরাদ্দ অর্থ দেয়নি। এই দুই শাসক দলের উন্নয়ন আর বিকাশ-এই দুটি অ্যাজেন্ডার মধ্যে গ্রামের মানুষের ভালভাবে বেঁচে থাকার কোনো উপাদান নেই। মানুষের পঞ্চায়েতের যে ধারণা বা আদল তৈরি করেছিল বামফ্রন্ট সরকার, তার সবটাই উলটে দিয়ে গ্রামবাংলাকে লুঠের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করছে এই দুটি রাজনৈতিক দল।
সফল পঞ্চায়েত ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন মানুষের স্বার্থে উন্নয়নের মডেল এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। আঞ্চলিক শাসনকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বামপন্থা সবসময় প্রয়োজন হয় না। পৃথিবীর বহু দেশে সফল আঞ্চলিক শাসন চলছে বামপন্থীদের বাদ দিয়েই। আঞ্চলিক শাসন বামপন্থীরা মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বিকল্প তৈরি করতে সক্ষম হয়। বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলের কাছে তাই সহজ এক প্রশ্ন রাখা যায়। প্রশ্নটি হলো গ্রামের মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইকে না মেনে নিয়েও তো গ্রামে সম্পদ তৈরি, পঞ্চায়েতের আর্থিক সুব্যবস্থা, এইসব গড়ে তোলা যেত।পঞ্চায়েতের গোটা ব্যবস্থাই যদি এই দলগুলির কায়েমি স্বার্থে ব্যবহার হয় এবং ব্যাপক আর্থিক দুর্নীতির হাতিয়ার হয়, তাহলে তো পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করা হয়। এই দুটি দল তাদের নীতি এবং কর্মকাণ্ড কর্মসূচি দিয়ে তাই করেছে।
(ক্রমশ)