E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ৩১ মার্চ, ২০২৩ / ১৬ চৈত্র, ১৪২৯

রাজ্যে পঞ্চায়েতের হালহকিকত

সন্দীপন রায়


বাস্তুঘুঘুদের হটিয়ে এক নতুন পর্যায়ের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম হয় ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে, বামপন্থীদের হাত ধরে। ১৯৭৮-২০০৮ এই ত্রিশটা বছরে নিয়মিত ৫ বছর বাদে বাদে নির্বাচন, একটানা ত্রিশ বছরের এই রেকর্ড সারা দেশে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া আর কোনো রাজ্যে ছিল না। ২০০৮ সালেই এ রাজ্যে শেষবারের মতো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়। ২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তনের নামে পালাবদলের পর পরই ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার উপর প্রশাসনিক আক্রমণ শুরু হয়। সরকার নির্দেশনামা জারি করে তিনটি জেলায় সভাধিপতির (রাষ্ট্রমন্ত্রী পদমর্যাদাসম্পন্ন) ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে জেলাশাসকের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে। জেলায় জেলায় পদাধিকারবলে নির্বাচিত বিধায়ক ও সাংসদদের ধরে নিয়ে জেলা পরিষদের সভায় এসে স্থায়ী সমিতির কর্মাধ্যক্ষ সরানোর জন্য নির্দেশনামা জারি করে। পরবর্তীতে আইনের সাহায্য নিয়ে এই চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক কাজকে চরম বিরোধিতা করে আটকানো সম্ভব হয়।

ফিরে দেখা

প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকেই এরাজ্যে ভূমিসংস্কার ও ভূমিসংস্কার-নির্ভর পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ফলে গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা বেড়েছিল বাম আমলের সাতটি পঞ্চায়েত ব্যবস্থায়। সরকারের সহায়তা নিয়ে রাজ্যে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বাধা সত্ত্বেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি এসেছিল। উন্নয়নের অভিমুখে মানুষের চাহিদা বেড়েছিল। আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষকে গ্রামোন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত করার লক্ষ্যে তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য আসন ও পদ সংরক্ষণ করা হয়েছিল। সংখ্যালঘু অংশের মানুষকে গ্রামোন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। বাম আমলের শেষ পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ৩,২২০টি গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচিত মোট ৪৯ হাজারের কিছু বেশি জনপ্রতিনিধির মধ্যে ১০,৪৩৩ জন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। ১৮ বছরে ভোটাধিকার প্রদান করা সম্ভবপর হয়েছিল, প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও। শুধু বিরোধিতা নয়, ১৮ বছরের ভোটাধিকারকে কার্যত বানচাল করার জন্য আদালতে মামলা হয়েছে, কিন্তু সেই মামলাতেও বামফ্রন্ট জয়ী হয়েছে। ক্ষমতার গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের নীতি প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে কাজের অগ্রাধিকার নির্বাচন ও রূপায়ণের ক্ষমতা দিয়ে গ্রাম সংসদের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন সমিতি গড়ে উঠেছিল। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চলতে চলতে প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতির বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চতুর্থস্তরের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল। সমিতিতে শুধু বিজয়ী নয়, বিরোধী মতের প্রতিফলন ঘটানোর জন্য পরাজিতদের মধ্যে প্রথমকে যুক্ত করা হয়েছিল গ্রামোন্নয়ন সমিতিতে। সর্বস্তরে স্থায়ী সমিতিগুলোতে বিরোধী দলের একজন করে সদস্যকে যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা জেলা কাউন্সিলের অধ্যক্ষ। তার নেতৃত্বাধীন কমিটির জেলার অভ্যন্তরে যে কোনো পঞ্চায়েতে অডিট করার অধিকার ছিল। সাড়ে ছয় লক্ষের বেশি স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গঠন করে আর্থিকভাবে দুর্বল অংশের প্রায় ৫৫ লক্ষ মহিলাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলে সমাজে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। প্রাথমিকে, অষ্টম শ্রেণিতে ড্রপ আউট কমিয়ে আনা, বন্ধ করার লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। ৫ বছর উত্তীর্ণ শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করা এবং দরিদ্রতা যাতে পড়াশোনার ছেদ না ঘটায় তার জন্য বইপত্র ও বিদ্যালয়ে দুপুরের খাবার দেবার ব্যবস্থা চালু হয়। সার্বিক স্বাস্থ্যবিধান অভিযানে তখন দেশের প্রথম সারির রাজ্যগুলোর মধ্যে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। একশোদিনের জব কার্ড বিলি ও শ্রমদিবস সৃষ্টিতে তখন দেশের শীর্ষে পশ্চিমবাংলা। এসবই সম্ভব হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার, পঞ্চায়েত ও জনগণের মিলিত প্রয়াস আর উদ্যোগের ফলে। গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ শুধু গ্রামাঞ্চলে উন্নত জীবনের চাহিদা তৈরি করেছিল তাই নয়, রাজ্যের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছিল।

বিগত দশ বছরের পঞ্চায়েত

বিগত দশ বছরে মূলত পরিবর্তন হয়েছে অধিকারের ক্ষেত্রে, গ্রামীণ মানুষ ও পঞ্চায়েতের অধিকার খর্ব করার ক্ষেত্রে। দীর্ঘ ২০ বছর পর ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ পঞ্চায়েত (দ্বিতীয় সংশোধনী বিল)-এর মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া হয়েছে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব। নির্বাচিতদের সরিয়ে আমলাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২৬ মার্চ, ২০১২ রাজ্যে গণতন্ত্রের কালো দিন। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়। সঙ্গে মুর্শিদাবাদ ও নদীয়াতেও। ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয় জেলাশাসকের মাধ্যমে সরাসরি সরকারের হাতে। অর্থাৎ বিরোধীরা যাতে কোনোরকম উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে না পারে। তারপর ২০১৩-র পঞ্চায়েত নির্বাচন, আর তার পাঁচবছর বাদে ২০১৮ সালে প্রহসনের নির্বাচন। আজ দেশের মধ্যে নিকৃষ্টতম মিড ডে মিল চলে এরাজ্যে। দেশে ১৯৯৫ সালের স্বাধীনতা দিবসে মিড ডে মিল চালু হয়। আর এরাজ্যে বামফ্রন্টের হাত ধরে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মাধ্যমে ১৯৯০-৯১ সালে তা চালু হয়। ২০১৮-র প্রহসনের নির্বাচনের পর শুধু দখলদারি আর দুর্নীতি। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত শুধু চুরি আর চুরি। একদিকে প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে, নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে এরাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে কার্যত বিরোধী শূন্য করা হয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ পর্যন্ত ব্যবস্থার অভ্যন্তরে কার্যত প্রতিরোধ নেই। প্রশাসনকে পকেটে পুরে কার্যত লুট আর লুট। কিন্তু তবু এরই মাঝে বিভিন্ন প্রকল্প চলছে। তারই হাত ধরে নতুন নতুন উপভোক্তা সৃষ্টি হয়েছে। একশো দিনের কাজ দীর্ঘসময় বন্ধ। যা কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারের শাসক দলের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু সারা দেশের একমাত্র গ্যারান্টিযুক্ত কর্মসংস্থান প্রকল্প এই রাজ্যে বন্ধ। রাজনৈতিক কারণ যাই থাক, পুকুর চুরি নয়, এ কার্যত দিঘি চুরি। সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যের হতদরিদ্র গরিব মানুষ। আর এর থেকে দৃষ্টি আড়াল করতেই আবার ভোটের মুখে ‘দুয়ারে সরকার’। বিভিন্ন ছোটোবড়ো প্রকল্পের ঘোষণা। এখন দেখা দরকার প্রকল্পগুলোর চেহারা কীরকম। অতীতে কি আদৌ ছিল, নাকি সবই নতুন! প্রকৃত রূপে দেখার জন্য গ্রাম পঞ্চায়েতের বেশ কিছু প্রকল্প কর্মসূচি ভালো করে জানা দরকার, বোঝা দরকার।

খাদ্যসাথীঃ
২০১৬-র ২৭ জানুয়ারি চালু হয় ‘সবার জন্য খাদ্য‘ এই স্লোগান দিয়ে। আসলে পশ্চিমবঙ্গে ৮.৮৯ কোটির কিছু বেশি মানুষ গণবণ্টন ব্যবস্থার সুবিধাভোগী। যার মধ্যে ৬.০১ কোটি মানুষ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (AAY, PHH)–এর অধীনে এবং প্রায় ২.৮৮ কোটি উপভোক্তা রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনার (RKSY-1 এবং RKSY-2)-এর অধীনে। ব্যাপক দুর্নীতি রয়েছে এই প্রকল্প ঘিরে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার ‌আধার লিঙ্ক বাধ্যতামূলক করায় তা অনেকটা কমেছে।

স্বাস্থ্যসাথীঃ
২০১৬-র ২৫ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের পিএমজেএওয়াই বা আরএসবিওয়াই-এর সুযোগ পেতে দেওয়া হয়নি। বিপুল পরিমাণ টাকা বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। প্রচারের ঢক্কানিনাদে ব্লক থেকে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ভয়ংকর চিত্রকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা ভেঙে পড়েছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের মাধ্যমে বেশকিছু মানুষ সুযোগ পাচ্ছেন। পরিষেবাটি ঠিক, কিন্তু অভিজ্ঞতা এই যে, কোনো রোগী যখন স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের দোরগোড়ায় যাচ্ছেন তখনই শুনতে হচ্ছে ‘বেড নেই’ অথবা এই পরিষেবা এখানে দেওয়া সম্ভব নয়। অনেক রোগীর মধ্যে কেউ কেউ শাসকদলের কোনো কেষ্টবিষ্টুকে ধরে বেসরকারি হাসপাতালকে বলাতে পারলে হয়তো তার শিকে ছিঁড়ছে। টাকা না পাওয়ার কারণে বেসরকারি হাসপাতাল দূরে সরে যাচ্ছে। আবার সরকারি হাসপাতালে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ কার্ড দেখাতে হচ্ছে। অর্থাৎ ধীরে ধীরে সুকৌশলে গরিব মানুষের বিনা পয়সার চিকিৎসার সুযোগওটাও কেড়ে নিচ্ছে সরকার।

তপশিলি বন্ধুঃ
‘পশ্চিমবঙ্গ চায় বাংলা পেনশন’ প্রকল্পটি দু’টি পর্যায়ে সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে উৎসাহিত করার জন্য। আগে জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নামে যা ছিল তারই পরিবর্তিত রূপ। আধার লিঙ্ক বাধ্যতামূলক করার পর থেকেই রাজ্য প্রশাসনের উদ্যোগের ঘাটতির কারণে ২০২২-এর এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সাহায্য বন্ধ রয়েছে। পেনশন অনিয়মিত হয়ে গেছে।

মেধাশ্রীঃ
২০২৩-এর ১৯ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয়েছে। অনগ্রসর শ্রেণির পড়ুয়াদের মাসিক ৮০০ টাকা সহায়তা দেবার প্রকল্প। সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ের অনগ্রসর শ্রেণির ২ লক্ষ ৬৩ হাজার ছাত্রছাত্রীকে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, অতীতেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এই কর্মসূচি ছিল বইয়ের জন্য অনুদান ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি আকারে। অতীতে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে চালু করা মূলত অনগ্রসর শ্রেণির মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এই প্রকল্প পুনরায় চালু হয়েছে সদ্য।

শিক্ষাশ্রীঃ
অতীতের বই অনুদানের সহায়তা ও বিদ্যালয়গুলিতে দেওয়া বই রক্ষণাবেক্ষণ অনুদানে সহায়তা ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি - এর সঙ্গে যুক্ত সকল প্রকার স্কিমকে যুক্ত করে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির তপশিলি জাতির ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য।

জয় জহরঃ
আদিবাসী উন্নয়ন দপ্তর কর্তৃক তপশিলি উপজাতি বিভাগের জন্য এই পেনশন প্রকল্প ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয়। জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পেরই বর্তমান রূপ। আধার লিঙ্ক করার নির্দেশ আসার পরই বিপদে পড়ে রাজ্য সরকার। ২০২২-এর এপ্রিল থেকে কেন্দ্রীয় সাহায্য বন্ধ, পেনশন একেবারেই অনিয়মিত।

কন্যাশ্রীঃ
এই প্রকল্পের প্রচার সর্বোচ্চ। ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি শুরু হয়। আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের কন্যা সন্তানদের জন্য এই উদ্যোগ। আগেও অন্য নামে এই প্রকল্প ছিল। বর্তমানে প্রচারের সুযোগ নিয়ে এমন একটা বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছে যেন এরকম কোনো প্রকল্প আগে ছিল না। তবে, আগে সীমিত ছিল, এখন অনেকের জন্য।

রূপশ্রীঃ
আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের প্রাপ্তবয়স্ক কন্যাদের বিয়ের সময় ২৫ হাজার টাকা দেওয়া চালু হয় ২০১৮-র ৩১ জানুয়ারি। অতীতে এলআইসি বা ডাকঘরের বিভিন্ন সঞ্চয় প্রকল্পের সাথে যুক্ত করে নানা ধরনের স্কিম ছিল। ২০১৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সুকন্যা সমৃদ্ধি যোজনা স্কিমও ঘোষিত হয়। সেই ধারণাগুলোকে যুক্ত করেই ওই প্রকল্পের অবতারণা।

মানবিকঃ
প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য আগে যে পেনশন স্কিম ছিল, তাই নতুন রূপে নতুন করে সাজিয়ে ২০১৮-র এপ্রিল থেকে তার নাম দেওয়া হয় মানবিক।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডারঃ
অতীতে সাড়ে ছয় লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলে ৫৫ লক্ষেরও বেশি মহিলাকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। স্বনির্ভর দলের মহিলারা নিজ উদ্যোগে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলেছিলেন। এখন সব শেষ করে দেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে সাধারণ মহিলাদের জন্য ৫০০ টাকা আর তপশিলি জাতি উপজাতি মহিলাদের জন্য মাসিক এক হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে ঘোষণা হয়েছে। যাকে পারছে তার নাম ঢোকাচ্ছে। কোনো যোগ্যতা নির্ধারক ব্যবস্থা নেই। অনেক গরিব মানুষ এই অর্থ পাচ্ছেন না, আবার অনেক উচ্চ আয়ের মানুষ এর সুযোগ নিচ্ছেন। মহিলাদের স্বনির্ভর করার উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়ে টাকা হাতে পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা। আর্থিক সংকটের কারণে অনিয়মিতভাবে অর্থাৎ দু’তিন মাস অন্তর অনুদান দেওয়া হচ্ছে।

কৃষক বন্ধু, বাংলা কৃষি সেচ যোজনাঃ
কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুযোগ যাতে গরিব কৃষক, ভাগচাষি গ্রহণ না করে, সেই উদ্দেশ্যে কৃষি দপ্তরের মাধ্যমে এই দুটি প্রকল্প ২০১৯ এবং ২০২২ সাল থেকে চালু করা হয়েছে।

ঐক্যশ্রীঃ
২০১৯-২০ আর্থিক বছরে রাজ্য বাজেট থেকে সম্পূর্ণ অর্থের ব্যবস্থা করে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু‍‌ ছাত্রদের জন্য চালু হওয়া শিক্ষাবৃত্তি। এটি অতীতেও ছিল, কেন্দ্রীয় সরকারেরও নিজস্ব প্রকল্প আছে। তবে সব সময়ই মেধাবীদের স্কলারশিপ দেওয়াই লক্ষ্য ছিল। এখন সেটাকে আরও লঘু করে সংখ্যালঘু মানুষকে কাছে টানার উদ্দেশ্যে নতুন রূপে হাজির করা হয়েছে।

গতিধারাঃ
অতীতে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বামফ্রন্ট সরকার চালু করেছিল আত্মসন্মান, আত্মমর্যাদা প্রকল্প। যেখানে এককভাবে বা গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বেকার যুবকদের ব্যবসা করার জন্য রাজ্য সরকার সরাসরি আর্থিক সহায়তা করত - যা প্রকল্প মূল্যের ১৫ শতাংশ আর ১০ শতাংশ উপভোক্তার। বাকি ৭৫ শতাংশ সহজ কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য ঋণের মাধ্যমে (ব্যাংক মারফত) সহায়তা করত রাজ্য সরকার। বেকার যুবক-যুবতীদের ব্যবসায় উৎসাহিত করা, প্রণোদিত করাই লক্ষ্য ছিল। আর আজ যুবকল্যাণ দপ্তরের এই কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়েছে সরকারের অনিচ্ছায়। বিভ্রান্তি সৃষ্টির লক্ষ্যেই কতিপয় বেকার যুবক-যুবতীকে যানবাহন কেনার জন্য কিছুটা অর্থ জোগানের নাম ‘গতিধারা’ প্রকল্প। আর্থিক দুর্বলতায় তাও মুখ থুবড়ে পড়েছে।

সমব্যথীঃ
আর্থিকভাবে দুর্বল অংশের পরিবারের মৃত ব্যক্তির সৎকার করার জন্য ২,০০০ টাকার সাহায্য। এই টাকা গ্রাম পঞ্চায়েতে যাবার কথা নয়। ব্লকস্তর থেকে গরিব পরিবারের আবেদনের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করে সাহায্য করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিপরীত ঘটনা ঘটছে। টাকা নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে গ্রাম পঞ্চায়েতে। প্রধানের নির্দেশে যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। প্রকৃত উপভোক্তা পাচ্ছেন খুবই কম। যাদের দরকার নেই অনেক ক্ষেত্রে তাদের পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সর্বশেষ বলতে হয় যে, বামফ্রন্ট আমলে সযত্নে তৈরি হওয়া পঞ্চায়েত ব্যবস্থার চতুর্থস্তর গ্রামসভা, গ্রাম সংসদকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের (Participatory Democracy) ভাবনাকে শেষ করা হয়েছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের নীতির পরিবর্তে ‘নবান্ন’ আর ‘নীল-সাদা শাড়ি’ শেষ কথা বোঝানোর জন্য গ্রামসভার গুরুত্বকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে বাজেটের আর কোনো গুরুত্ব নেই। বার্ষিক কর্ম পরিকল্পনা কার্যত বন্ধ। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর ভরসা নেই প্রশাসনের, নবান্নের চোদ্দতলার। তাই ‘দুয়ারে সরকার’ আর ‘পাড়ায় সমাধান’-এর নাম করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা। সঠিক তথ্য তুলে ধরা দরকার। ঠিক নির্বাচনের মুখেই আবার ‘দুয়ারে সরকার’ ঘোষিত। শেষ মুহূর্তে বিগত বছরের যন্ত্রণা ভুলিয়ে মিথ্যা প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করতেই হবে।