E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ৩১ মার্চ, ২০২৩ / ১৬ চৈত্র, ১৪২৯

আদানি শিল্প গোষ্ঠী এবং ধান্দার অর্থনীতি

দেবাশিস সরকার ● অভিজিৎ সাহা


১৯৪৭ সালে ভারত রাষ্ট্র স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা কমিশন (১৯৫০) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দেশের আর্থ-সামাজিক ও বস্তুগত এবং মানবসম্পদের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে (১৯৫৬–৬১) শিল্প স্থাপন ও শিল্পের প্রসারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল। যা মহলানবিশ মডেল নামে পরিচিত। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময়কাল থেকেই অর্থাৎ ১৯৬০ এর দশকের শুরু থেকে এবং ১৯৭০ অবধি শিল্প ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যদিও এই পর্বে বেসরকারি শিল্পের জন্য নির্দিষ্ট ক্ষেত্র চিহ্নিত ছিল। ১৯৮০ দশকের শেষ পর্যন্ত ভারতে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে সরকারি পুঁজির পাশাপাশি বেসরকারি পুঁজির অস্তিত্বও বিরাজমান ছিল। তবে এইখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শুরু থেকে ১৯৮০ দশক অবধি সরকারি ক্ষেত্র, বেসরকারি ক্ষেত্র এবং যৌথ ক্ষেত্র - ধারাবাহিক বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে শিল্পের বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এই কথা অনস্বীকার্য যে, এই পর্বে ভারি এবং মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগের প্রশ্নে সরকারি ক্ষেত্র অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৯০ দশকের শুরুতে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়নের (LPG) সামগ্রিক প্রভাব অর্থনীতির বিকাশের প্রতিটি ধারায় পরিলক্ষিত হয়। এই পর্বের মূল বৈশিষ্ট্য হলো শিল্প ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ ক্রমাগত সংকোচন এবং এর দরুন বেসরকারি বিনিয়োগের সুযোগ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৯০ দশকের শুরুতে নয়া-উদারবাদী নীতি গ্রহণ করার ফলে স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কাল থেকে চলে আসা ভারতের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর আমূল এবং মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। যেটাকে অর্থনীতি চর্চার পরিভাষায় কাঠামোগত সামঞ্জস্য প্রোগ্রাম (SAP) বলা হয়। এই মডেলের মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষত উৎপাদন ক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির অবাধ বিনিয়োগকে খোলাখুলি এবং কিছু ক্ষেত্রে নির্বিচারে স্বাগত জানানো। এই সময়কালে ভারতের সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে জোট রাজনীতির যুগের সূচনা হয়। শিল্পক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দান এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহের বিলগ্নিকরণের জন্য বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আমলে একটি বিলগ্নিকরণ দপ্তরও তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তী দশকগুলিতে ধাপে ধাপে সরকারি ক্ষেত্রের সংকোচন এবং বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রসারের ধারা অব্যাহত থাকে।

পরবর্তী সময়ে ২০০৪ সালে ইউপিএ-১-কে কেন্দ্র করে জোট রাজনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছিল। ইউপিএ-১ সরকার বামপন্থীদের সমর্থনে চলার দরুন একটি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি তৈরি করা হয়েছিল। যদিও এ কথা খেয়াল রাখা দরকার যে, চরিত্রগতভাবে ইউপিএ দক্ষিণপন্থী জোট হলেও বামপন্থীদের সমর্থন এর পিছনে থাকার ফলে বেশ কিছু প্রগতিশীল কর্মসূচি গৃহিত হয়েছিল। যেমন, ১০০ দিনের কাজ (২০০৫), শিক্ষার অধিকার (২০০৯), তথ্য জানার অধিকার (২০০৫) ইত্যাদি। ২০০৪-২০১৪ এই দশ বছরের ইউপিএ-১ এবং ইউপিএ-২ সরকারের কার্যকাল শেষ হলে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রে এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পর্বে এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যা কোনোভাবেই পূর্বেকার অবস্থার সঙ্গে তুলনীয় নয়। এই সময়কালে ১৯৯০ দশকে নয়া-উদারবাদ প্রসূত যে উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়নের নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল তা আরও তীব্র এবং নগ্নভাবে অনুসৃত হতে লাগল। এই পর্বে পুঁজির চরিত্রেও গুণগত পরিবর্তন ঘটল। সংস্কারের নামে একাধারে সরকারি ক্ষেত্রের বিলগ্নিকরণ এবং বল্গাহীন বেসরকারিকরণের প্রবণতা এক নতুন মাত্রা পেল। এর ফলে একদিকে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধান্দার পুঁজির গুরুত্ব বৃদ্ধি পেল, অন্যদিকে বিশ্বজুড়ে ধান্দার ধনতন্ত্রও শক্তিশালী হলো। আমাদের মনে রাখা দরকার ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে যে আর্থিক মন্দা শুরু হয়েছে যার প্রভাব ২০২৩ সালে এসেও অনুভূত হচ্ছে। সেই পর্বকালে বিশেষত অতিমারীর পরিস্থিতিতে আদানি এন্টারপ্রাইজের বিদ্যুৎগতিতে উত্থান আমাদের মধ্যে এক বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটিয়েছে, একথা বললে অত্যুক্তি হবে না। ২০০৮ সাল থেকে চলা আর্থিক মন্দার মূল কারণ হচ্ছে চাহিদার সংকট। পুঁজির মালিকরা বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির তীব্র ব্যবহারের মধ্য দিয়ে উৎপাদন ক্ষেত্রে শ্রমশক্তির ব্যবহার কমিয়ে ফেলছে কিন্তু তাদের মুনাফার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবের ফলে ভারত সহ দুনিয়া জুড়ে বেকারত্ব, কর্মহীনতা, শ্রমিক ছাঁটাই বাড়ছে আর কমছে মজুরির হার এবং কাটছাঁট হচ্ছে সামাজিক সুরক্ষার সুবিধাসমূহ। এই আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গৌতম আদানির মালিকানাধীন আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের উত্থান বিশেষ বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

কে এই গৌতম আদানি?

২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি গৌতম আদানি এবং তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডকে নিয়ে হিন্ডেনবার্গ নামক একটি আর্থিক গবেষণা সংস্থা ১৩৭ পাতার একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ধনকুবের ও তাঁর ব্যবসায়িক সংস্থাসমূহের শেয়ারের দাম অভাবনীয় হারে পড়তে শুরু করে, কিছু ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম ৬০ শতাংশ অবধি পড়েছে। আর টাকার হিসেবে এই সংস্থার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা। এই রিপোর্ট প্রকাশের বারো দিনের মাথায় দুনিয়ার তিন নম্বর ধনী শিল্পপতি এক ধাক্কায় ২২ নম্বরে নেমে যায়। রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন আদানি শিল্প গোষ্ঠী কর্তৃক বাজার থেকে FPO মারফত ২০,০০০ কোটি টাকা তোলার প্রক্রিয়াটি স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়।

এখন প্রশ্ন হলো, কে এই গৌতম আদানি। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে, প্রায় কুড়ি বছর আগে গৌতম আদানি মুম্বাইয়ের জাভেরি বাজারে হিরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করতেন। ২০০২ সাল থেকে ২০২২ সাল অবধি এই শিল্প সংস্থার যেভাবে রকেট গতিতে উত্থান হয়েছে তা বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে শেষ তিন বছরে, অতিমারীর সময়কালে (২০১৯-২০২২) এই শিল্প সংস্থার বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮১৯ শতাংশ। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আদানি এন্টারপ্রাইজের তালিকাভুক্ত ৭টি সংস্থার শেয়ারের দাম ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে থাকে। যেমন, বন্দরের ক্ষেত্রে ৩৯ শতাংশ, আদানি বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ২৬.৪৩শতাংশ, আদানি ট্রান্সমিশন-এর ৪৩.৯ শতাংশ, আদানি গ্যাসের ৫৬ শতাংশ, আদানি গ্রিন এনার্জির ৪৫.৭৫ শতাংশ, এবং আদানি উইলমারের ২৬.৪৬ শতাংশ হারে শেয়ারের দাম পড়েছে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, ২০০৮ সাল থেকে চলে আসা বিশ্বব্যাপী আর্থিক মন্দা, যার প্রভাব এখনো অনুভূত হচ্ছে, অন্যদিকে অতিমারীর সময়কালে কীভাবে এই শিল্প সংস্থাটি মুনাফার পাহাড় গড়ে তুললো তা এক পৃথক গবেষণার দাবি রাখে।

আদানি এন্টারপ্রাইজের গঠন কাঠামোর দিকে যদি লক্ষ রাখা যায় তাহলে দেখা যাবে যে, এই সংস্থাটি আদতে একটি পারিবারিক সংস্থা। এই সংস্থার ২২ জন শীর্ষস্তরের আধিকারিকের মধ্যে ৮ জনই আদানি পরিবারের সদস্য। আদানি এন্টারপ্রাইজের মূল ৭টি তালিকাভুক্ত ব্যবসায়ী সংস্থা রয়েছে। এই ৭টি সংস্থা প্রধানত যে সমস্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করেছে প্রধানত সেগুলি হলোঃ বন্দর (১৩টি), এয়ারপোর্ট (৬টি), বিদ্যুৎ উৎপাদন (৮-১০টি), রিয়েল এস্টেট, কৃষিজ পণ্য এবং খাদ্য দ্রব্য, পরিকাঠামো, লজিস্টিক এবং গণমাধ্যম। পশ্চিমবঙ্গে অনুষ্ঠিত শেষ বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিটে (২০২২) এই শিল্পপতি উপস্থিত থেকে ঘোষণা করেন যে, তাঁরা তাজপুর গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্প এবং কয়লা উত্তোলনের জন্য দেউচা পাঁচামি-তে বিনিয়োগ করবেন।

হিন্ডেনবার্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক আদানি এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলি হলো, ক্রমাগত পরিবেশগত নিয়ম বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিল্প সংস্থা স্থাপন ও বিনিয়োগ, নিজের শেয়ারের দাম বাজার দরের তুলনায় বেশি করে দেখানো, যার ভিত্তিতে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, বিমা সংস্থা থেকে টাকা ধার নেওয়া। এছাড়াও এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরো বড়ো অভিযোগ হলো বিভিন্ন সেল কোম্পানি মারফত দেশের বাইরে থেকে প্রচুর পরিমাণে টাকা সংস্থাতে বিনিয়োগ। আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড হিন্ডেনবার্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্টটি প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ দিন পরে ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ ‘আদানি রেসপন্স’ নামে ৪১৩ পাতার একটি পালটা রিপোর্ট প্রকাশ করে, হিন্ডেনবার্গ গবেষণার অভিযোগগুলিকে প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। আদানির এই ঘটনার ফলে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান সমূহ যারা শিল্প সংস্থার কার্যাবলী ও ভূমিকাকে নিরীক্ষণ করে তাদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অতএব হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টটি আদানি এন্টারপ্রাইজের বেআইনি কার্যপদ্ধতি নিয়ে যে সমস্ত অভিযোগ তুলে ধরেছে সেটাকে ভারতের অর্থনীতি এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে গুরুত্ব সহকারে পর্যালোচনা করা উচিত।

আদানি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড ও ভারত রাষ্ট্র

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের ইতিহাসে বহু শিল্প গোষ্ঠীর উত্থান লক্ষ করা গিয়েছে। কিন্তু আদানি এন্টারপ্রাইজের রকেট গতিতে উত্থান পূর্বেকার সমস্ত রেকর্ডকে ভেঙে দিয়েছে শুধু তাই নয়, বরং এক নতুন নজির সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে। আদানির উত্থানের পিছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের সময়কালে, আদানি শিল্প গোষ্ঠীর বৃদ্ধি ভারতের শিল্প বাণিজ্যের ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টটিকে হাতিয়ার করে বিরোধীরা মূলত দুটি প্রশ্ন রেখেছে, একঃ গৌতম আদানির সাথে ভারত রাষ্ট্র তথা নরেন্দ্র মোদির কী সম্পর্ক রয়েছে। দুইঃ হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের ভিত্তিতে আদানি এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলির সারবত্তা নিরীক্ষণের জন্য একটি জেপিসি (JPC) গঠন। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষণীয়, মোদি সরকার এই দুটি দাবিকে গুরুত্ব দিতে একদমই নারাজ। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এবং পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী এটাও সামনে এসেছে যে, স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া এবং এলআইসি ও মোটা অঙ্কের টাকা আদানি এন্টারপ্রাইজে বিনিয়োগ করেছে। এর ফলে জনগণের টাকার নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্থায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এই সব বিষয়ে আদানি গোষ্ঠী এবং ভারত রাষ্ট্রের পরিচালকদের নীরবতা - আদানি গোষ্ঠীর সাথে বর্তমান কেন্দ্রের শাসক দলের পারস্পরিক সম্পর্কটিকে সন্দেহের চোখে দেখতে বাধ্য করছে।

আদানির সঙ্গে বিজেপি দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের আরও একটি দিক হলো নির্বাচনী বন্ড। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে সরকারি সম্পত্তি যেভাবে জলের দরে আদানির কাছে বিক্রি বা লিজ দেওয়া হচ্ছে তার বিনিময়ে অর্থের একটা পরিমাণ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি’র তহবিলে জমা হচ্ছে। ২০২৩ সালে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী বিজেপি’র আয়ের ৫৫ শতাংশ এই নির্বাচনী বন্ড থেকে সংগৃহীত হয়েছে। এই বিপুল টাকা বিজেপি নির্বাচনে খরচ করছে।

উৎপাদনের ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি বা কর্মকুশলতার, পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় শক্তির প্রত্যক্ষ মদত এবং রাষ্ট্র পরিচালকদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে যদি কোনো বেসরকারি শিল্প সংস্থার রকেট গতিতে উত্থান হয় তাহলে সেটাকে ধান্দার ধনতন্ত্র বলা হয়। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে আদানি গোষ্ঠীর উত্থান হলো এই ধান্দার ধনতন্ত্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সুতরাং আদানি এন্টারপ্রাইজের সাথে বিজেপি দলের কী সম্পর্ক তা খতিয়ে দেখার জন্য অবশ্যই যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করতে হবে জাতীয় স্বার্থ, দেশের সম্পদের সুরক্ষা এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের স্বার্থে। স্বচ্ছতার খাতিরে বিরোধীদের এই দাবি কেন্দ্রীয় সরকারের অবশ্যই মেনে নেওয়া উচিত।

অঙ্গীকার

নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রায় নয় বছরের সময়কালে ভারতীয় অর্থনীতির সমস্ত সূচক নিম্নমুখী। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে বেকার সমস্যা এক নতুন রেকর্ড তৈরি করেছে। দ্রুত গতিতে আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। অক্সফ্যাম রিপোর্ট (২০২৩) অনুসারে, দেশের উচ্চ আয়ের প্রথম ১০ শতাংশ মানুষের হাতে দেশের মোট সম্পদের ৭৭ শতাংশ রয়েছে। সম্পদের কেন্দ্রীকরণের প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত হচ্ছে। জনকল্যাণ খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট বরাদ্দ কমেছে। শিল্পপতি ও সম্পদশালী শ্রেণীর জন্য কর ছাড়ের হার বেড়েছে। গরিব আরও গরিব আর ধনী হয়েছে আরও বিত্তশালী। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভরতুকির পরিমাণ হ্রাস করেছে। এই সময়কালের মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলিতে বিশাল পরিমাণ নন পারফরমিং সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রধান কারণ, ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতিরা সময়মতন ঋণ নেওয়া অর্থরাশি ব্যাংকে জমা দিচ্ছেন না। এর ফলে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই বকেয়া ঋণের খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে।

কিন্তু এই বিষয়ে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নীরব। দেশের এই পুঁজিপতিরা সবার নজরে থেকেও দেশের বাইরে আত্মগোপন করে রয়েছে। সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষের কমেছে ক্রয় করার ক্ষমতা। সংকুচিত হয়েছে বাজারের চাহিদা। এক চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী ভাবধারায় পরিচালিত অর্থনীতি ভারতের বৃহত্তর অংশের মানুষের কল্যাণ হ্রাস করেছে। কিন্তু এই আবহে উত্থান ঘটেছে আদানি গোষ্ঠীর মতো শিল্পপতিদের, যার মূল চালিকা শক্তি হচ্ছে ধান্দার অর্থনীতি।

এই আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তের আশু কর্তব্য। বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির সংবদ্ধ, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের মানুষের ঐক্যের আবহ জনগণকে এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে।