E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৩ সংখ্যা / ৩১ মার্চ, ২০২৩ / ১৬ চৈত্র, ১৪২৯

মতাদর্শের চর্চা

ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (চার)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


লোকায়ত দর্শন বস্তুবাদী দর্শন, যেখানে দেহ নিরপেক্ষ আত্মার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। অনুশীলনের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব - লোকায়ত দর্শনের মত। এই বস্তুজগৎ অলীক নয়, আমাদের সংবেদনশীল উপলব্ধির মাধ্যমে এই বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। সংক্ষিপ্ত শব্দ ‘প্রমাণ’-এর ওপর লোকায়িতকরা জোর দিয়েছিলেন। কোনো কিছুকে সত্য হিসাবে চিহ্নিত করতে হলে বৈধ প্রমাণ প্রয়োজন। আগুনের ধর্ম হলো তাপ ও আলো, ঠিক তেমনই চেতনা হলো মানব দেহের গুণ। আগুন না থাকলে যেমন আলো বা তাপ থাকে না ঠিক তেমনই মানব দেহ ছাড়া চেতনা বা আত্মার অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রকৃত জ্ঞান অনুশীলনের (practice) মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে। লোকায়ত দর্শনে স্পষ্টভাবে বলা হলো, এই বস্তু জগৎ অলীক নয় এবং আমাদের সংবেদনশীল উপলব্ধির সাহায্যে বস্তুজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।

লোকায়ত দার্শনিকরা আত্মার স্বাধীন অস্তিত্বকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছিলেন। স্বর্গ-নরক, পূর্ব জন্ম, পরজন্মের ধারণাকে খারিজ করেছিলেন। লোকায়ত দার্শনিকদের মতে জড় ও জীব নিয়ে এই জগৎ গঠিত হয়েছে। মাটি, জল, আগুন ও বায়ু এই চারটি মৌলিক উপাদানে জগৎ গঠিত। জীবকুল এই চারটি উপাদানের নির্দিষ্ট সংমিশ্রণে তৈরি হয়। জীবন শেষ হলে আবার এই উপাদানের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। চারটি উপাদান অর্থাৎ মাটি, জল, আগুন ও বায়ু থেকে চেতনা তথা জীবনের ব্যাখ্যা ছিল এইরকম - ‘‘উপাদানগুলি পৃথকভাবে চেতনাহীন হলেও চেতনার উৎপত্তি এই উপাদানগুলি থেকে যেমন চাল সহ মদ উৎপাদনের নানা উপাদানগুলির পৃথক মাদক গুণ না থাকলেও একটি নির্দিষ্ট উপায়ে মিলিত হয়ে এটি মাদকতা গুণ পায়, তেমনি চেতনাহীন বস্তুগুলি নির্দিষ্ট উপায়ে সংবদ্ধ হয়ে বাস্তব মানবদেহ গঠনের পরে চেতনা লাভ করে। আত্মার ধারণার বিপক্ষে বস্তুগত ধারণার প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় এই লোকায়তিক দার্শনিক ব্যাখ্যা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

লোকায়ত দার্শনিকরা দৃঢ়ভাবে ভাববাদীদের কর্মফল তত্ত্বকে অস্বীকার করে। ব্রাহ্মণদের আধিপত্যবাদ, যজ্ঞসহ অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানকেও তারা অবৈধ ঘোষণা করে। ফলে পুরোহিত শ্রেণির নির্যাতন ও বর্ণবৈষম্যের সামগ্রিক নীতি ভয়ংকর বাধার মুখে পড়ে। পুরোহিত শ্রেণি ও লোকায়ত দার্শনিকদের সমস্ত সাহিত্যকর্ম, এমনকী প্রতিবাদীদের পুড়িয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এই কারণেই লোকায়ত দর্শনের কোনো নির্ভরযোগ্য সাহিত্যকর্ম পাওয়া যায় না। যাই হোক, লোকায়ত দর্শনের কিছু অনিচ্ছাকৃত বিকৃতি ও তাদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ লোকায়তদের বিরুদ্ধে নির্দয় প্রচারাভিযানের তথ্য অনুসন্ধান করে ‌আধুনিককালের বস্তুবাদীরা এই দর্শনের আংশিক পুনর্নির্মাণ করেছেন। লোকায়তদের সাহিত্যকর্ম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল একথা সত্য। বহু প্রমাণ রয়েছে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় বিশেষ করে দুইটি পুঁথির উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধ পুঁথি দিব্যবদান। তার আবার প্রমাণ পতঞ্জলির মহাভাষ্য। আবার একথাও সত্য যে, লোকায়তদের বিদ্রূপ ও খাটো করার জন্য বিপক্ষরা তাঁদের সম্বন্ধে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, তা থেকেও লোকায়তদের বক্তব্য অনেকাংশে জানা সম্ভব হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বলে একটা কথা উল্লেখ করতে হচ্ছে, আতঙ্কজনক গল্প প্রচার করে, আইন করে বই পুড়িয়ে - আরও হাজার রকম ব্যবস্থা অবলম্বন করে সাধারণ মানুষের মন থেকে সেকালের শাসকরা এই দর্শনকে সত্যিই সরাতে পারেনি।

‘‘কর্মফলবাদের মূলকথা অবশ্যই সহজ। প্রতিটি মানুষের কর্মের একটি অনিবার্য পরিণতি আছে। ধার্মিক কাজের ফল মঙ্গলজনক, অনৈতিক বা খারাপ কাজের ফল অমঙ্গলসূচক। সুতরাং আজকের সুখ বা দুঃখভোগ অতীত কর্মের ফল আবার আজকের কর্মকাণ্ড আগামী ভবিষ্যতের ফলে প্রতিফলিত হবে। এই মতবাদ আসলে আত্মার রূপান্তরের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ...এই মতবাদ সুস্পষ্টভাবে এক অন্ধকার অতীতের অপরিবর্তনীয় শক্তির কথা বলে। এই কর্মফলবাদ উপনিষদের সময় থেকে বর্ণব্যবস্থাকে ন্যায়সঙ্গত করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়েছিল।’’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

শ্রাদ্ধ ও পারলৌকিক ব্রাহ্মণ্য প্রথার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে লোকায়ত দার্শনিকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন। ‘‘শ্রাদ্ধ যদি মৃতদের তৃপ্তি দেয় তাহলে ইহজগতে কোনো ভ্রমণকারীকে যাত্রা শুরুর সময়ে খাদ্য/পাথেয় প্রদান নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। যদি মৃত মানুষ আমাদের পারলৌকিক ক্রিয়ায় সন্তুষ্টি লাভ করে, তবে উৎসর্গের মাধ্যমে বাড়ির নিচের তলার মানুষ উপরতলায় খাদ্য পরিবেশন করে না কেন?’’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

রামায়ণে জাবালি যিনি একজন লোকায়তিক, অনুরূপ প্রশ্নের মাধ্যমে কর্মযোগের অলীক ধারণা ত্যাগ করার কথা বলেছিলেন। ‘‘একজনের গ্রহণ করা খাদ্য কি অন্যের পুষ্টি দিতে পারে? ব্রাহ্মণকে দান করা খাদ্য কি পিতৃপুরুষের সেবা করতে পারে? স্বার্থান্বেষী চতুর পুরোহিত তাই বলতে পারেন - দান করো, তপস্যা করো এবং ধন-সম্পদ ত্যাগ করে প্রার্থনা করো।’’ লোকায়তিকদের এই প্রশ্নবাণের মুখে পুরোহিত শ্রেণি ক্রমশই বিরক্ত হয়, এমনকী ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চরম শত্রুতাপূর্ণ আচরণ থেকে লোকায়তিক ও লোকায়ত ধারণা - দর্শনকে সমূলে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। পরিকল্পিতভাবেই লোকায়ত দর্শনকে ধ্বংসের অভিযান শুরু হয়। মহাভারতের শান্তিপর্বে লোকায়তিকদের প্রতি অভিজাতদের এমন ঘৃণা ও শত্রুতার নিদর্শন পাওয়া যায়।

‘‘কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের পরে বিজয়ী পাণ্ডবভ্রাতারা যখন প্রাসাদে ফিরছিলেন তখন নগর দ্বারে শত সহস্র ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাজা যুধিষ্ঠিরকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। চার্বাক (লোকায়ত দার্শনিক) নামের এক ব্রাহ্মণ এগিয়ে এসে যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন - জ্ঞাতিভাইদের হত্যা করার জন্য এই ব্রাহ্মণকুল আপনাকে অভিশাপ বর্ষণ করছে। স্বজন-বন্ধুদের ধ্বংস করে আপনি কি পেলেন? চার্বাকের এই প্রশ্ন সমবেত ব্রাহ্মণদের বাক্‌রুদ্ধ করে দিয়েছিল। যুধিষ্ঠির হতমান হয়ে মৃত্যুবরণ করতে চেয়েছিলেন। বিস্ময় কেটে গেলে অন্য ব্রাহ্মণরা প্রতিবাদী চার্বাককে রাক্ষস ঘোষণা করে পুড়িয়ে মেরে ফেলে।’’ (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)।

এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, লোকায়ত দর্শন সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে, সাধারণের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ছিল এই দর্শন। লোকায়ত নামকরণ সম্ভবত সেই কারণে। তবে আর একটি মতও রয়েছে তা হলো, ই‍‌হলোক এই দর্শনের সর্বস্ব, তজ্জন্যেই নামকরণ ‘লোকায়ত’। লোকায়ত দর্শনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের মতাদর্শগত সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার। বস্তুবাদ ছাড়াও লোকায়ত দর্শনের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নারীপ্রাধান্য বা মাতৃপ্রাধান্য। ভারতের মাটিতে বস্তুবাদের কোনো শিকড় নেই এ‍‌ই প্রচারকে আমরা খণ্ডন করতে পারি। মনে রাখতে হবে বিশেষভাবে, সেই প্রাচীন যুগে লোকা‌য়ত দার্শনিকরা সীমিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে অবলম্বন করে বস্তুবাদী যুক্তিগুলি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগে সেই সমস্ত যুক্তি অনেকের অশোধিত ও মেয়াদ উত্তীর্ণ মনে হতে পারে। যুগের সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে বলা যায় ব্রাহ্মণ্যবাদ পুরোহিত তন্ত্র ও শাসকশ্রেণির মতাদ‍‌র্শের বিরুদ্ধে লোকায়ত দার্শনিকদের এই ঐতিহাসিক ভূমিকা এক শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ। আজকের শ্রমজীবী জনগণই অতীতের লোকায়ত দর্শনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী - ভারতীয় জনগণের কাছে এই বার্তা পৌঁছানোর দায়িত্ব আমাদের। লোকায়ত দর্শনের আ‍‌লোচনা শেষ করতে গিয়ে যে কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন যে, এই দর্শনের সম্পর্কে আমরা জানতে সক্ষম হয়েছি একমাত্র এই দর্শনের যারা চরম বিরোধী তাদের আলোচনা, লেখনীর মধ্য দিয়ে। লোকায়ত দর্শনের জনপ্রিয়তায় আতঙ্কিত হয়ে এই দর্শনকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে লোকায়ত সম্পর্কিত সমস্ত পুঁথি তো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বেদান্ত দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা শংকরাচার্য তাঁর রচনায় যেখানে তিনি লোকা‌‌য়ত ও সাংখ্য দর্শনের (যেহেতু শংকরাচার্য মনে করতেন সাংখ্য দর্শন লোকায়ত দর্শনের অনুসারী) বিরোধিতা করতে গিয়ে বলছেন, লোকা‌য়তরা এই দেহকে অবলম্বন করেই চেতনার কথা বলে। বস্তুর প্রাথমিকতার কথা লোকা‌য়তরা তুলে ধরেছিলেন।

(ক্রমশ)