E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

মোদি সরকার নির্বাচন কমিশনকে কুক্ষিগত করতে চায়


সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অগ্রাহ্য করে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত বিল রাজ্যসভায় পাশ করল মোদি সরকার। এবছরের ২ মার্চ এ সংক্রান্ত রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলঃ মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত নয়। সংবিধান অনুযায়ী নির্ভীক, স্বাধীন, নিরপেক্ষ, সৎ নির্বাচন কমিশন প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী, লোকসভায় বিরোধী দলনেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করবে। কিন্তু ১২ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় যে ‘চিফ ইলেকশন কমিশনার অ্যান্ড আদার ইলেকশন কমিশনার্স (অ্যাপয়েনমেন্ট কনডিশন্স অব সার্ভিস অ্যান্ড টার্মস অব অফিস) বিল সরকার পাশ করেছে তাতে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত কমিটিতে প্রধান বিচারপতিকে রাখা হয়নি। বিলে বলা হয়েছেঃ ওই কমিটিতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিরোধী দলনেতা কিংবা লোকসভায় একক সর্ববৃহৎ দলের প্রতিনিধি। নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগের প্যানেল তৈরির জন্য সার্চ কমিটিতে থাকবেন আইনমন্ত্রী এবং কেন্দ্রের দুই সচিব। অর্থাৎ সংসদে গৃহীত এই বিলে যেটা স্পষ্ট তা হলো, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ ও নিয়োগের জন্য প্যানেল তৈরিতে সরকারেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধি থাকবে এবং নিয়োগ সংক্রান্ত সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। সংবিধান প্রণেতারাও এবিষয়ে সতর্ক ছিলেন এবং সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়েও এ থেকে যাতে মুক্ত থাকা যায় তারই নির্দেশ ছিল। রাজ্যসভায় বিরোধী দলগুলি নয়া-বিলে সরকারের এধরনের প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে এবং তারা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে কেন মানা হলো না তার জবাবও দাবি করে আইনমন্ত্রীর কাছে। স্বাভাবিকভাবেই এই বিলের অগণতান্ত্রিক দিকগুলির পক্ষে কোনো যুৎসই জবাব সরকারের কাছে ছিল না। তাই শুধুমাত্র সংখ্যার জোরে সমস্ত বিরোধিতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পাশে সরিয়েই মোদি সরকার এ বিলকে পাশ করেছে।

এতদিন পর্যন্ত মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হতো ইলেকশন কমিশন অ্যাক্ট ১৯৯১ দ্বারা। এই পুরনো প্রথায় প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করতেন। সংবিধানের ৩২৪(২) ধারায় বলা আছে, সংসদ কোনো আইন না প্রণয়ন করা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করবেন রাষ্ট্রপতি। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রাজ্যসভায় বলেছেন, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের বিষয়তেই এই আইনটার দুর্বলতা রয়েছে। এই বিল ১৯৯১ সালের আইনকে নাকচ করছে। পুরনো এই ব্যবস্থাটা যে খুবই গণতান্ত্রিক ছিল তা কখনই বলা যাবে না। কেউ সেই দাবি ইতিপূর্বে করেনি। আগে এই আইনে যখন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ হয়েছে তখন যে বিতর্ক হয়নি, কোনো প্রশ্ন ওঠেনি - তা একেবারেই নয়। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে প্রচলিত এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বলেছিলেন বিজেপি’র বরিষ্ঠ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিও। ২০১২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেনঃ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ক্ষমতা যেন কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না থাকে। খুব যথার্থভাবেই আদবানি পুরোনো আইনের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছিলেন ওই চিঠিতে। কিন্তু ওই আইন পরিবর্তন করে মোদি সরকার যে নয়া-আইন প্রণয়ন করতে চলেছে, তাতে সেই সীমাবদ্ধতার সমস্যাকে অতিক্রম করার চেষ্টা তো করাই হয়নি, বরঞ্চ নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতেই। এমনকী সার্চ কমিটিও এমনভাবে তৈরি করা হবে যেখানে সরকারের অপছন্দের কোনো ব্যক্তির নাম নিয়োগ কমিটির সামনেই আসবে না। সেক্ষেত্রে নিয়োগ কমিটিতে থাকা বিরোধী দলনেতার কোনো সুযোগই থাকবে না তাঁর মতকে তুলে ধরার।

সংবিধান পরিষদের সমস্ত সদস্যই স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। ১৯৪৯ সালের ১৫ এবং ১৬ জুন সংবিধানের ২৮৯ ধারার ( এখন ৩২৪) খসড়া রচনার ব্যাপারে সংবিধান পরিষদে আলোচনা হয়। সংবিধানের খসড়া রচনার কমিটির চেয়ারম্যান ডক্টর বি আর আম্বেদকর বলেছিলেন, প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন কমিশন থাকলে তার স্বাধীনতার সাথে আপস করা হবে। পরে সংবিধান গৃহীত হলে প্রথমে ২৮৯ ধারা এবং পরে ৩২৪ ধারায় সেই কথাই বলা হয়েছিল। সংসদের দায়িত্বই হলো, প্রগতিশীল ও অগ্রগামী আইন প্রণয়ন করে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও শক্তিশালী করা। সুপ্রিম কোর্টের রায়ও ছিল সেই লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ। আগেও দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে তথ্য জানার অধিকার আইনের মতো বিভিন্ন আইন আমাদের দেশের সংসদে প্রণীত হয়েছে। কিন্তু মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত যে বিল রাজ্যসভায় পাশ হলো তাতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কোনো উপাদানই নেই। বলা যায়, এই আইন প্রণয়ন হলে একটা পশ্চাদগামী ব্যবস্থারই প্রবর্তন হবে, যা নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠিত করা দুই-ই প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যে ইলেকটোরাল বন্ড দেশের নির্বাচনগুলিতে ব্যাপক অর্থের ব্যবহার এবং অসাধু পন্থা অবলম্বনের পথকে ক্রমশ প্রশস্থ করছে। এই ইলেকটোরাল বন্ডের সবচেয়ে সুবিধা ভোগ করছে বিজেপি দল।এবং এর দ্বারাই তারা দেশের সবচেয়ে ধনী দলে পরিণত হয়েছে। পরপর দুটো লোকসভা নির্বাচন ও অনেকগুলি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন ও বিধায়ক কিনে সরকার গঠনে এই অর্থ শক্তির পূর্ণ ব্যবহার করেছে বিজেপি। আগামীদিনে যদি তারা আইনবলে নির্বাচন কমিশনকেও দখল করে নেয় তাহলে দেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আরএসএস দেশের প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নিজের লোক বসাতে শুরু করে। দশ বছরের শাসনে তারা একাজে অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। একাধিক তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমও সারাদেশে তারা গড়ে তুলেছে। বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করারও অপচেষ্টা জারি আছে। এখন আরএসএস’র লক্ষ্য সমস্ত সাংবিধানিক পদের দখল। যেখানে এধরনের পদের দখলে আইনের পরিবর্তন দরকার এখন সেকাজেই মনে হয় তারা নজর দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত এই বিল পাশের মধ্যে সেই লক্ষণই দেখা যাচ্ছে। এখন এই আইন প্রণয়ন হলে, নিজের লোককে নির্বচন কমিশনারের পদে বসাতে আরএসএস-বিজেপি’র আর কোনো অসুবিধা হবে না। ইতিমধ্যে এরকমই একটি সাংবিধানিক পদ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের পদে প্রধানমন্ত্রী তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিকে বসিয়েছেন। যদিও উল্লেখিত বিলটি এখনো লোকসভায় পেশ হয়নি। তবে সংখ্যার জোরে সেখানেও এই বিল পাশ করাতে বিজেপি অসুবিধা না হওয়ারই কথা।

আরএসএস-বিজেপি’র লক্ষ্যই হলো ভারতকে ফ্যাসিস্তধর্মী হিন্দুরাষ্টে পরিবর্তন করা। সেই লক্ষ্যপূরণেই তাদের সব পরিকল্পনা,এবং একে একে তার রূপায়ণ চলছে।ফ্যাসিস্তধর্মী কোনো রাষ্ট্রেই গণতন্ত্র, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। ফ্যাসিস্তরা তা রাখতে দেয় না। তাই বিজেপি সরকার কোনো বিল পাশ করবে কিংবা আইন প্রণয়ন করবে তাতে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার কিংবা জনমুখী উপাদান থাকবে তা ভাবা বাতুলতা মাত্র।

এই কুৎসিত শক্তিকে ক্ষমতার কুরশি থেকে সরাতে পারলেই একমাত্র দেশ এবং দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষিত থাকবে।সামনেই লোকসভা নির্বাচন। নির্বাচনী যুদ্ধে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সেই রাজনৈতিক কাজকেই পাখির চোখ করতে হবে।