অবিলম্বে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হবে
আধুনিক সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হলো জ্বালানি তেল। অন্যদিকে আবার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপোড়েনের ক্ষেত্রেও জ্বালানি তেলের ভূমিকা রয়েছে। বিগত শতাব্দীর সত্তরের দশকের শুরু এবং শেষের দিকে তেল রপ্তানিকারক দেশগুলির সংস্থা (ওপেক) জ্বালানি তেলের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি করে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতিকে তা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে তা সৃষ্টি করে তীব্র বিভাজন। তেলসমৃদ্ধ দেশগুলি এবং তেলহীন দেশগুলির মধ্যে সৃষ্টি হয় বিশাল পার্থক্য। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে জাপান এবং ইয়োরোপের দেশগুলি জ্বালানি তেলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ওপেক-অন্তর্ভুক্ত শক্তিশালী দেশগুলির উপর আধিপত্য সৃষ্টি করে নিজেদের জ্বালানির প্রয়োজনকে পূরণ করে।
সত্তরের দশকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতে তেল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির জাতীয়করণ হয়। নতুন নতুন সংস্থা আত্মপ্রকাশ করে। জ্বালানি তৈল অনুসন্ধান, উত্তোলন, নিষ্কাষণ এবং পরিশোধন প্রক্রিয়া রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আওতায় রাখা হয়। এরফলে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৭০ শতাংশ সরকারি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পরিণতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আশির দশকে বৃদ্ধি ঘটলেও তার প্রভাব থেকে জাতীয় অর্থনীতিকে অনেকটাই রক্ষা করা সম্ভব ছিল। এইসময় প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৭০ শতাংশেরই অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে উৎপাদন হতো।
কিন্তু নব্বইয়ের দশকে জাতীয় অর্থনীতির বিশ্বায়নে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের উদারিকরণের মধ্য দিয়ে নব্য-উদারনীতির নামে যে শোষণ শুরু হয় তার পথ ধরে জ্বালানি তেল উত্তোলন থেকে পরিশোধন প্রক্রিয়া সবটাই দেশি- বিদেশি বেসরকারি সংস্থার নিকট খুলে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর এই প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া তীব্রতা লাভ করে। পরবর্তীতে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে যে স্বনির্ভরতা ছিল তা ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর পরিণতি হয়েছে ভয়ানক। এর পাশাপাশি রয়েছে প্রশাসনিক নির্দেশে মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা।
বিগত চতুর্থ দফার লকডাউনের পরে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার একটানা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন ধরনের কর বৃদ্ধি করে পেট্রোলের দাম লিটার প্রতি ৮.৩০ টাকা এবং ডিজেলের দাম ৯.৪৬ টাকা বৃদ্ধি করেছে। এইসময় আন্তর্জাতিক বাজারে কিন্তু অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৪০ ডলার থেকে কমে ২০ ডলার হয়েছে। তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির কর চাপানো হয়েছে। ভারতে জ্বালানি তেলের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্কের পরিমাণ ৬৩ শতাংশ। এবং কয়েকটি দেশে এই হার হলো— যেমন ইতালিতে ৬৪ শতাংশ, স্পেনে ৫৩ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ শতাংশ। সাম্প্রতিক এই মূল্যবৃদ্ধির পরিণতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাড়তি প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছে।
এই অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষের পকেট কেটে সংগ্রহ করে চলেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, এমন সময় এই অর্থনৈতিক আক্রমণ কেন্দ্রীয় সরকার জনগণের ওপর নামিয়ে এনেছে, যখন কোভিড-১৯ অতিমারীর রূপ পরিগ্রহ করেছে। একে মোকাবিলার নামে তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলছে লকডাউন। লকডাউনের শিকার হয়ে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। কোভিড-১৯-এর পূর্ব থেকেই জাতীয় অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। চাহিদার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয়েছিল এক ধরনের সঙ্কট। জাতীয় অর্থনীতির এই দূরবস্থা দূর করতে প্রয়োজন ছিল সাধারণ মানুষের হাতে নগদ অর্থের জোগান বৃদ্ধি করা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বিপরীত পথেই চলেছে। জনগণের কাছে যে সামান্য অর্থ রয়েছে তাও এখন হরণ করতে উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। আসলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বৃহৎ শিল্পপতিদের এই ১ বছরে বিপুল পরিমাণে আর্থিক সুবিধা দিয়েছে। এর পরিমাণ ২ লক্ষ কোটি টাকার সমান। শিল্পপতিদের আর্থিক সুবিধা প্রদান করতে গিয়ে রাজকোষে যে ঘাটতি হয়েছে তা পূরণ করতে গিয়েই সাধারণ গরিব মানুষদের ক্রয়ক্ষমতার ওপর আক্রমণ করা হয়েছে।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ভয়ানক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এরফলে পরিবহণের ব্যয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। পরিণতিতে যাত্রী পরিবহণ এবং পণ্য পরিবহণ খরচ উভয়ই বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে এই নেতিবাচক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বর্তমানে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় নতুন কিছু বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। অতীতে পেট্রোলের দামের তুলনায় ডিজেলের দামের দৃশ্যমান পার্থক্য ছিল। বর্তমানে এই পার্থক্য ক্রমহ্রাসমান। এমনকি দিল্লিতে পেট্রোলের দামকে অতিক্রম করে গেছে ডিজেলের মূল্য। এর একটি প্রযুক্তিগত প্রতিক্রিয়া আছে। ডিজেলের মূল্য কম থাকায় ৪ চাকা বিশিষ্ট প্যাসেঞ্জার গাড়ি ডিজেলবাহিত হওয়ার প্রবণতা ছিল। এই প্রযুক্তিগত বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে যাবে। এর আর্থিক প্রভাবও রয়েছে।
তৃতীয়ত, কৃষিপণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত পাম্প সেটগুলি সাধারণভাবে ডিজেলে চলে। সুতরাং, কৃষিপণ্য পরিবহণের ব্যয়ই শুধু বৃদ্ধি পাবে তাই নয়, কৃষিপণ্য উৎপাদনের খরচও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে।
পূর্বোক্ত প্রেক্ষাপটে একথা বলা চলে যে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পরিণতি জাতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে। তাই এই মূল্যবৃদ্ধি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।