E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

করোনা পরিস্থিতি এবং করণীয়


কোভিড ১৯ এবং তাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে শতদিনব্যাপী লকডাউন জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি ও সার্বিকভাবে সমাজের ক্ষেত্রে এক ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। এর শেষ কোথায় এখনও পর্যন্ত কেউ জানে না। করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক বা এর ওষুধ নিশ্চিত একদিন উদ্ভাবিত হবে। এক সময়ে যক্ষা, কলেরা, গুটি বসন্ত, টাইফয়েড, কালাজ্বর, প্লেগ ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসক-বিজ্ঞানী-গবেষকদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এইসব রোগ নিরাময়ের ওষুধ উদ্ভাবিত হয়েছে। বর্তমানে এদের মধ্যে অনেকগুলি রোগ অতীতের বিষয়। কিন্তু অতীতের মহামারীগুলির থেকে বর্তমান অতিমারীর নানান দিক থেকেই পার্থক্য রয়েছে যা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এরজন্য নতুন সৃষ্ট এই পরিস্থিতির কয়েকটি দিকের আলোচনা একান্ত জরুরি। প্রথমত, এই করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে কর্মসংস্হান দারুণভাবে সংকুচিত হয়েছে। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-এর হিসাব অনুযায়ী ১৪ কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সংগঠিত ও অসংগঠিত উভয় ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরাই রয়েছেন। দেশান্তরী বা পরিযায়ী শ্রমিক যারা শিল্প ও কৃষি উভয়ক্ষেত্রে কর্মরত তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। এই অংশের প্রায় ১০ কোটি শ্রমজীবী কাজ হারিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটেছেন, পাড়ি দিয়েছেন নিজেদের জন্মভূমির উদ্দেশে। ইতিমধ্যেই এদের একটা অংশ ট্রেন দুর্ঘটনায় বা বাস-ট্রাকে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকারগুলি এদের ঘরে ফেরার জন্য বিন্দুমাত্র ব্যবস্থা করেনি। মাত্র চারঘণ্টার নোটিশে লকডাউন এদের দারুণ বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এদের চাকুরিচ্যুত না করা বা বেতন না কাটার যে নির্দেশ আদালত দিয়েছিল তাও গ্রহণ করা হয় নি। দ্বিতীয়ত, সমস্ত অংশের শ্রমজীবীরাই এই অবর্ণনীয় পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হয়েছেন, অথচ এদের শ্রম-ঘাম-রক্তের বিনিময়ে ভারতের জিডিপি দু’লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। শিল্পজাত পণ্য, কৃষিজাত পণ্য, জনগণকে পরিষেবা প্রদান, বিশেষত পণ্য রপ্তানি করে দেশের জন্য বিদেশি মুদ্রা অর্জন করায় তাঁদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এদের এই অবর্ণনীয় দুর্দশার দিনে দেশের বেশিরভাগ সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত নেতিবাচক।

তৃতীয়ত, বর্তমান পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে কেন্দ্র ও অধিকাংশ রাজ্য সরকার বর্তমানে শ্রমজীবীদের অর্জিত অধিকারগুলো দেশি-বিদেশি মালিকশ্রেণির স্বার্থে হরণ করতে উদ্যত হয়েছে। এই ব্যাপারে সামনের সারিতে রয়েছে বিজেপি এবং তাদের সহযোগীদের পরিচালিত রাজ্যগুলি। যেমন, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, কর্ণাটক, ত্রিপুরা। এছাড়াও রয়েছে কংগ্রেস পরিচালিত রাজস্থান, পাঞ্জাব। বিজেডি পরিচালিত ওডিশা সরকারের ভূমিকাও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কাজের সময়সীমা বৃদ্ধি, বেতন সংকোচন, ছাঁটাই প্রভৃতি এদের ওপর নামিয়ে আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যতিক্রম কেরালার বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের সরকার, যারা স্পষ্ট করেই শ্রমিক বিরোধী আইন প্রণয়নের বিরোধিতা করেছে। শুধুমাত্র সরকারের ক্ষেত্রেই নয় বামপন্থী ব্যতীত অন্যান্য আঞ্চলিক দলগুলিও শ্রমিকশ্রেণির অধিকার হরণের প্রশ্নে বিজেপি সরকারের সাথেই হাত মিলিয়েছে।

চতুর্থত, কোভিড ১৯ মহামারী মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় বিপর্যয় আইনের আড়ালে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। একদিকে রাজ্যগুলিকে ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, অন্যদিকে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এইরকম দুর্যোগের দিনেও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি সাম্প্রদায়িক অ্যাজেন্ডাকে ব্যবহার করে জনগণের বিভাজন প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখেছে।

পঞ্চমত, কোভিড ১৯ ও লকডাউনে কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার যে ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করেছে তা চরম প্রতারণাপূর্ণ এবং তথ্যের কারচুপি ভিন্ন আর কিছুই নয়। যেমন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজের অধিকাংশই বাজেটে রয়েছে বা তা পূর্ব ঘোষিত প্রকল্প। অর্থনীতিবিদদের মতে ২০ লক্ষ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র দেড় থেকে ২ লক্ষ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয়িত হবে। দুর্দশাপীড়িত জনগণের হাতে নগদ অর্থ বা খাদ্যশস্য দেওয়ার পরিবর্তে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত কার্যকর হবে না। অর্থমন্ত্রীর ৫দফা ঘোষণায় ব্যাপক বেসরকারিকরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষণা,কয়লা খনি কিছুই বেসরকারিকরণের আওতা থেকে বাদ যায়নি।

ষষ্ঠত, এই সংক্রমণ আন্তর্জাতিকস্তরে পুঁজিবাদ নয় সমাজতন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সংক্রমণে আক্রান্ত ও মৃতের নিরিখে প্রথম স্থানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দ্বিতীয় স্থানে ব্রাজিল। উভয় দেশেই রয়েছে চরম দক্ষিণপন্থী সরকার। পরবর্তী স্থানগুলিতে ইতালি, গ্রেট ব্রিটেন, স্পেন প্রভৃতি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, লাওস, কিউবা প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশ যথাযথভাবেই একে মোকাবিলা করেছে। ফলে এইসব দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম। সমাজতান্ত্রিক চীনে এই সংক্রমণের সূচনা হলেও পরবর্তীকালে তাকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। এই সব দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে পুঁজিবাদী দেশ স্পেন তাদের সামগ্রিক স্বাস্হ্যব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

জাতীয় ক্ষেত্রেও এর নজির রয়েছে। বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি কিংবা নানা আঞ্চলিক দলের রাজ্য সরকার বিশেষত মহারাষ্ট্র, গুজরাট, তামিলনাড়ু, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যেও যখন সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ, তখন কেরালার বাম গণতান্ত্রিক পরিচালিত সরকার যেভাবে এই অতিমারীকে মোকাবিলা করেছে তা শুধু জাতীয়স্তরেই নয় আন্তর্জাতিক স্তরেও স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই কারণে কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রসংঘে আমন্ত্রিত ও সংবর্ধিত হয়েছেন। করোনা-উত্তর পরিস্থিতিতে জনগণকে দুর্দশামুক্ত করতে বামপন্থীদলগুলি যে ৪ দফা দাবি পেশ করেছে তাকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই সব দাবির মধ্যে রয়েছে আগামী ৬ মাস আয়করদানের বাইরে থাকা প্রতিটি পরিবারকে মাসে ৭,৫০০ টাকা করে দিতে হবে, প্রতিটি পরিবারে সদস্যপিছু মাসে ১০ কেজি চাল/গম দিতে হবে, গ্রাম শহর নির্বিশেষে ১০০ দিনের পরিবর্তে ২০০ দিনের কাজ দিতে হবে, দেশের আত্মনির্ভরতার ভিত্তি রাষ্টায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ করা চলবে না। ইতিমধ্যে এসব দাবি নিয়ে দেশব্যাপী লড়াই শুরু হয়েছে। আগামীদিনে তাকে জোরদার করাই হবে আমাদের কর্তব্য।