বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে
কেন্দ্রে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৯১ সাল থেকে শুরু হওয়া বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় এক নতুন মাত্রা। ‘স্ট্র্যাটেজিক সেল’ প্রভৃতির নামে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাকে সরাসরি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলতি আর্থিকবর্ষের জন্য যে সাধারণ বাজেট অর্থমন্ত্রী সংসদে পেশ করেছেন সেখানে বিলগ্নিকরণের মধ্যে দিয়ে ২ লক্ষ ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে ১ .৫০ লক্ষ কোটি টাকা সংগৃহীত হবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে। স্ট্র্যাটেজিক সেলের মাধ্যমে সংগ্রহের পরিমাণ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ধরা হয়েছে।
বাজেট পেশের পর বিলগ্নিকরণ সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় নি। কিন্তু কোভিড ১৯-কে সামনে রেখে জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম টেলিভিশন ভাষণে প্রতারণাপূর্ণ ২০ লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ এবং এর সূত্র ধরে অর্থমন্ত্রীর ৫ দফা ঘোষণায় বেসরকারিকরণের বিষয়টি স্পষ্ট আকারে তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে ভারতীয় রেলের বেসরকারিকরণ, ৪১ টি কোল ব্লক বেসরকারি সংস্থার কাছে বিক্রি করে দেওয়া, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র মহাকাশ গবেষণায় বেসরকারি সংস্থার প্রবেশের অনুমোদন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কৌতুকের বিষয় হলো এই যে, এ সবই করা হচ্ছে আত্মনির্ভর ভারত অভিযান ( এবিএ)-এর নামে। তাছাড়া কোভিড ১৯ মোকাবিলার ঘোষণায় বিষয়টি উল্লেখ হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বিক্রির সাথে কোভিড ১৯ নিরাময়ের সম্পর্ক কোথায়-তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়নি।
একথা সর্বজনবিদিত, দেশের আর্থিক স্বনির্ভরতা,প্রযুক্তিগত ভিত্তিকে শক্তিশালী করা,আমদানি বিকল্প নির্মাণ প্রভৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত, দেশের রাজনৈতিক গণতন্ত্র মজবুত করতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা প্রতিষ্ঠিত সত্য।এখানেই শেষ নয়, জাতীয় অর্থনীতিতেও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পালন করে চলেছে ইতিবাচক ভূমিকা।
কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশিত ব্যুরো অফ পাবলিক এন্টারপ্রাইজের ২০১৭-১৮ এবং ২০১৮-১৯ সালের প্রতিবেদন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ সালে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সংখ্যা ছিল ৩৩৫টি। এর মধ্যে ১০ টি মহারত্ন, ১৪ টি নবরত্ন, ৭৩ টি মিনি রত্ন-১ এবং ১২ টি মিনি রত্ন-২। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলির পেইড আপ ক্যাপিটালের পরিমাণ ২০১৭-১৮ সালে ছিল ২.৫৩ লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা। সর্বমোট পুঁজি বিনিয়োগের পরিমাণ ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ সালে ছিল যথাক্রমে ১৪.৩১ লক্ষ কোটি টাকা এবং ১৬.৪৪ লক্ষ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলির মোট আয়ের পরিমাণ ২০১৭-১৮ সালে ছিল ২০.৩২ লক্ষ কোটি টাকা যা ২০১৮-১৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ২৪.৪০ লক্ষ কোটি টাকা। নিট মুনাফার পরিমাণ ২০১৭-১৮ সালে ছিল ১লক্ষ ৫৫হাজার কোটি টাকা,যা ২০১৮-১৯ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ১ লক্ষ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির সংরক্ষিত মজুতের পরিমাণ ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৯.২৬ লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা। বিভিন্ন কর এবং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে কেন্দ্রীয় কোষাগারে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলির জমার পরিমাণ ২০১৭-১৮ সালে ছিল ৩.৫২ লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩.৬২ লক্ষ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলি ২০১৭-১৮ সালে বিদেশি মুদ্রা অর্জন করেছিল ৫.২২ লক্ষ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬.৬৯ লক্ষ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলির এইসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পাশাপাশি শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ একবছরে ১ লক্ষ ৫৩ হাজার কোটি টাকা থেকে ১ লক্ষ ৫২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
পূর্বোক্ত তথ্য পরিসংখ্যান দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্হাগুলির ইতিবাচক কার্যকলাপের ইঙ্গিত। কিন্তু বিগত শতাব্দীর ৯০ -এর দশক থেকে শুরু করে যে সমস্ত কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে তারা কেউই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগ নেয় নি, পরন্তু কেন্দ্রীয় কোষাগারীয় ঘাটতি পূরণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের অর্থকে ব্যবহার করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদী পরিচালিত বিজেপি জোট সরকারের আমলে এই প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে আরও তীব্র। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, বিগত দু’বছরে দেশের শিল্পপতি-বিত্তশালীদের আয়কর-কোম্পানি কর বাবদ কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করতে জাতীয় সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের শেয়ার বিক্রি করা হচ্ছে। অর্থাৎ এই বিলগ্নিকরণের অর্থ দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আধুনিকীকরণ করে পরিবর্তনের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় শিল্পপতিকে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ এক চরম দেশবিরোধী কাজ।
আশার বিষয় হলো, দেশের জনগণ বিশেষত শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনকেই তীব্র থেকে তীব্রতর করেছে। ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত যে ১৯ টি ধর্মঘট হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে অন্যতম দাবি ছিল-রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ রোধ।এই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার রেল ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের অংশ হিসাবে যে ১৫১টি রুটে ট্রেন চলাচল বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছে। দেশের ৪১টি কয়লা খাদান থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নিলামের সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন। এর বিরুদ্ধে কয়লা শিল্প শ্রমিকদের সব ক’টি ট্রেড ইউনিয়ন ২-৪ জুলাই তিনদিন ব্যাপী ধর্মঘট করেছে। ভবিষ্যতে আরও বড় সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের মাথা নত করাতে গেলে আন্দোলনের নতুন ধারার কথা ভাবতে হবে। যেমন, দুর্গাপুরের ইস্পাত কারখানার শ্রমিক আন্দোলন দেখিয়েছে। গত বছর ২১ অক্টোবর অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট কেনার জন্য দুর্গাপুর প্রশাসনিক ভবনে বিদেশি সংস্থা ওয়াটসন কোম্পানির প্রতিনিধিরা গেলে তাদের ঘেরাও করে রাখা হয়। এই প্রতিরোধের মুখে তারা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়ে দিতে হবে যে, ভারত মানে শুধু সংসদ নয়, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো আইন পাশ হলেও শ্রমিক শ্রেণি বাস্তবে তাকে কার্যকর করতে দেবে না। অবাধ্যতার চাবুক দিয়েই তাকে প্রতিহত করতে হবে।