আলোচনার মাধ্যমেই সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা উচিত
প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীনের সাথে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনাকে কেন্দ্র করে উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। উভয় দেশের সেনাবাহিনীর কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়েছেন বলে সংবাদে প্রকাশ। ভারতের সাথে চীনের প্রায় দীর্ঘ চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে এবং তাকে কেন্দ্র করে কিছু সমস্যাও রয়েছে। তবে ১৯৭৫ সালের পর তেমন বড়ো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। উভয় দেশই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক সংস্থা যেমন এসসিও এবং ব্রিকস্-এর সদস্য। বিগত ছয়/সাত বছরে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার সফরে গেছেন।
বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নের প্রশ্নে এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশি রাষ্ট্রের মধ্যে মিত্রতার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী বেশ দুঃখজনক। কারণ, পূর্ব লাদাখের সীমানা নিয়ে উদ্ভূত সমস্যা সম্পর্কে গত ৫ জুন ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব এবং চীনের বিদেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেলের সাথে কূটনৈতিকস্তরে আলোচনা হয়েছে। পরের দিনই উভয় দেশের সেনা কমান্ডের সাথেও সামরিকস্তরে আলোচনা হয়। এই আলোচনার রেশ টেনে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, ‘ভারত ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক এবং সামরিকস্তরে আলোচনা ইতিবাচক হয়েছে এবং তা পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকবে। দু’দেশই সমস্যা সমাধানে আলোচনা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছে’। প্রায় একই ধরনের বক্তব্য চীনের তরফ থেকেও বলা হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, উভয় দেশের মতপার্থক্য যাতে বিরোধ বা সংঘর্ষের মধ্যে চলে না যায় তা দেখার জন্য উভয় দেশই সহমত। পাঁচ ও ছয়ই জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের ফলাফলে বলা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ এবং প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন উঠেছে যে, উভয় দেশের কূটনৈতিক ও সামরিকস্তরে ‘ইতিবাচক’ আলোচনার মাত্র দশ দিনের মধ্যে এই সংঘর্ষ কেন ঘটল? এক্ষেত্রে কি কোনও ধরনের গোয়েন্দা ব্যর্থতা ঘটেছে? ১৯ জুন অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, চীন সীমানা অতিক্রম করে ভারতীয় সীমানায় প্রবেশ করেনি। তাহলে প্রশ্ন ওঠে যে, তাহলে ভারতীয় সেনাদের মৃত্যু ঘটেছে কোন্ এলাকায়? চীন যদি ভারতীয় সীমানা অতিক্রম করে থাকে, তাহলেও প্রশ্ন জাগে এ সম্পর্কে আগাম কোনও সংবাদ কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কেন ছিল না।
এতদ্সত্ত্বেও ভারতীয় জওয়ানদের আত্মত্যাগ অবশ্যই অভিনন্দনযোগ্য। পার্টির পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে এর জন্য গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এক বিবৃতিতে এই অঞ্চলে শান্তি যাতে বজায় থাকে তা অবশ্যই সুনিশ্চিত করার দাবি জানানোর পাশাপাশি বলা হয়েছে, ভারত সরকারের অবশ্যই সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানানো প্রয়োজন ওই অঞ্চলে বাস্তবে কি ঘটেছে। এই সরকারেরই অবশ্য কর্তব্য হলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জরুরি ভিত্তিতে উচ্চস্তরে আলোচনা শুরু করা এবং সীমান্তে শান্তি এবং নিরুত্তেজনা বজায় রাখতে দুই পক্ষের ঐকমত্য বোঝাপড়ার ভিত্তিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
দক্ষিণ এশিয়ার দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তি দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে হওয়া প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয়স্তরে কিছু শক্তি উভয় দেশের মধ্যে বিরোধ-সংঘর্ষকে জিইয়ে রেখে নিজেদের স্বার্থকে চরিতার্থ করতে চায়। যেমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বর্তমানে এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে চীনকে কোণঠাসা করতে ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। ইতিমধ্যেই জি-৭-এ ভারতকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মার্কিন রাষ্ট্রপতি সওয়াল করেছেন। এছাড়া এই গোষ্ঠীতে ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্তিও তারা চায়। ইতিমধ্যেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি উভয় দেশের মধ্যে বিরোধের নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যদিও চীনের পক্ষ থেকে এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখান করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলের এক বড়ো অংশই মনে করেন যে, আসন্ন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের জন্য জয়ী হতে ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনকে ইস্যু করতে চায়। সেইলক্ষ্যে ভারত-চীন বিরোধের নিষ্পত্তির প্রশ্নে ট্রাম্পের এই আগ্রহ। ইতিমধ্যে করোনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসন চীন বিরোধী জিগির তুলেছে। ভারতকেও তারা এখানে শামিল করতে চাইছে। এই প্ররোচনার ফাঁদে ভারতের পা দেওয়া উচিত হবে না।
আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও কিছু অশুভ স্বার্থান্বেষী মহলের পক্ষ থেকে চীন বিরোধী জিগির তোলা হয়েছে। এই লক্ষ্যে কখনো এরা চীনা পণ্য বয়কটের ডাক দিচ্ছে কখনো চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ফেক নিউজ প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। প্রচার মাধ্যমের একটা অংশও চীনা পণ্য বয়কট-এর বিকৃত ভাবাবেগকে মদত দিয়ে চলেছে। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে এর বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ভারতে উৎপাদিত মোটর গাড়ি শিল্পে যে সমস্ত যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয় তার ২৭শতাংশই চীন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এক্ষেত্রে মার্কিন দেশ থেকে আমদানির পরিমাণ মাত্র সাত শতাংশ। এমনিতেই বর্তমানে ভারতীয় গাড়ি শিল্প ভয়ঙ্কর মন্দায় আক্রান্ত। এই অবস্থায় চীনা পণ্য বয়কটের দাবি দেশের স্বার্থকে কতটা রক্ষা করবে তা ভেবে দেখা দরকার। একই চিত্র ইলেকট্রনিক্স গুড্স পণ্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে ভারতীয়রা যে ইলেকট্রনিক্স পণ্য ব্যবহার করে তার ৭৩ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করা হয়।
এ অবস্থায় একটি দেশের পণ্য বয়কট করতে হলে যে স্বনির্ভরতার প্রয়োজন তা ভারতের বর্তমানে নেই। যে সামান্য স্বনির্ভরতা ছিল তা মোদী সরকার ক্রমশ ধ্বংস করে চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের স্বার্থে বিশেষত ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মধ্যদিয়ে এই সীমান্ত বিরোধের নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন।