E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বিদ্যুৎব্যবস্থার বেসরকারিকরণ চলবে না


সমগ্র দেশ যখন কোভিড ১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত ঠিক তখনই কেন্দ্রের খসড়া বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল (ইএবি), ২০২০ উপস্থিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শক্তি মন্ত্রকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আলোচনা ও মতামতের জন্য বিলটি হাজির করা হলো। বাজপেয়ীর নেতৃত্বে প্রথম এনডিএ সরকার ২০০৩ সালে বিদ্যুৎ বিল সংসদে অনুমোদন করে।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন ভারতে শিল্প ও কৃষি অর্থনীতির উন্নতি বিধানে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার যথাযথ প্রয়োগের উদ্দেশে বিদ্যুৎ আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রধানত এই ক্ষেত্রটা সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। এর প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, না লাভ না ক্ষতি। এই আইন প্রণীত হওয়ার পর বিগত ৪ দশকে বিদুৎ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই সময়কালে দু’কোটি পাম্পসেটকে বিদ্যুদয়িত করা হয়েছিল। কৃষি অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল ইতিবাচক। অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের গ্রাহকদের কাছ থেকে বর্ধিত অর্থ নিয়ে দরিদ্র গ্রাহকদের তুলনামূলক কম দামে বিদ্যুৎ প্রদান করা হতো। যা ‘ক্রস সাবসিডি’ বলে পরিচিত।

বিগত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে গ্যাটের বাণিজ্যিক আলোচনায় ভারত অংশগ্রহণ করতে শুরু করে। এর প্রভাব বিদ্যুৎনীতির ওপর পড়ে। ১৯৮৫ সালে বিদ্যুৎ আইনের সংশোধন করে রাজ্যপর্ষদগুলিকে বাধ্যতামূলকভাবে ৩ শতাংশ মুনাফা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে তথাকথিত সংস্কার নীতির নামে যে বেসরকারিকরণের নীতি সার্বিকভাবে গৃহীত হলো তা বিদ্যুৎনীতিকেও প্রভাবিত করল।

১৯৯১ সালে নতুন শিল্পনীতিতে ইস্পাত প্রভৃতি শিল্পের মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকেও দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলো। এর পথ ধরে মহারাষ্ট্রে এনরন কোম্পানি, ওডিশায় এইএস সার্ভিসেসের মতো বিদেশি বহুজাতিক সংস্থাগুলি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে প্রবেশ করে। অন্যান্য রাজ্যে ফার্স্ট ট্র্যাক প্রোজেক্ট, আল্ট্রা মেগা পাওয়ার প্রোজেক্ট শিরোনামে একাধিক বিদেশি কোম্পানি ভারতে প্রবেশ করে। বিদেশি কোম্পানিগুলির পাশাপাশি রিলায়েন্সের মতো দেশীয় বৃহৎ সংস্থাগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্ত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায় দেশি-বিদেশি বৃহৎ সংস্থাগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদন, সংবহন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিতে শুরু করে। যে মহারাষ্ট্র রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ একসময়ে বিপুল লাভজনক সংস্থা হিসাবে পরিচিত ছিল এনরন-এর শর্ত পূরণ করতে গিয়ে কয়েক দশকের মধ্যেই একটি লোকসানি সংস্থায় পরিণত হয়। একইভাবে ওডিশায় চলতি শতকের শুরুতে যখন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলবর্তী শহরগুলি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, সেই সময়ে বিপর্যয় মোকাবিলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এইএস সার্ভিসেসের টিকিটি পর্যন্ত দেখা যায়নি। রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ, এনটিপিসি-র মতো সরকারি সংস্থাগুলি এগিয়ে এসে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

এইসব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা না নিয়ে ২০০৩ সালে এনডিএ সরকার বিদ্যুৎ আইন, ২০০৩ প্রণয়ন করে। এই আইনে বিদ্যুৎ শিল্পে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করা হয়। বিদ্যুৎ কর্মী এবং অফিসারদের সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে ২০০৩ সালের বিদ্যুৎ আইনের ফলাফল সম্পর্কে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানানো হয়েছিল, কিন্তু তা গ্রাহ্য হয়নি। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদের লোকসানের পরিমাণ যেখানে ছিল মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা, সেখানে ২০০৩ সালে বিদ্যুৎ আইন লাগু হওয়ার পর এই দেড় দশকে বিদ্যুৎ পর্ষদগুলির লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ কোটি টাকা। এদের ঋণের সর্বমোট পরিমাণ ৫ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এই আইনের বলে রাজ্য বিদ্যুৎপর্ষদগুলিকে ভেঙে উৎপাদন, সংবহন ও বণ্টনের আলাদা আলাদা কোম্পানি করে দেওয়া হয়। এর পরিণতিতে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎ সংস্থা এখন লোকসানি সংস্থায় পরিণত হয়েছে। ব্যতিক্রম, কেরালা। সেখানে এই বিভাজন প্রক্রিয়া লাগু হয়নি।

বস্তুতপক্ষে, ২০০৩ সালে গৃহীত বিদ্যুৎ আইনের ফলাফল এক কথায় ভয়াবহ। এখানে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য যা বলা হয়েছিল তার ধারে কাছে পৌঁছনো যায়নি। যেমন, বলা হয়েছিল বেসরকারিকরণ, ঠিকাকরণ, প্রভৃতির মাধ্যমে ১৬ টি আলট্রা মেগা পাওয়ার প্রোজেক্ট করা হবে। কিন্তু এপর্যন্ত এধরনের প্রকল্পের সংখ্যা মাত্র ৩টি। ব্যর্থতার এরকম বহু নজির রয়েছে।

কিন্তু গভীর ক্ষোভের বিষয় হলো এই যে, ‘আত্মনির্ভরতা’র কথা বলে কার্যত বিদ্যুৎ আইন সংশোধন, ২০২০ বিলের আড়ালে দেশি-বিদেশি সংস্থাগুলির কাছে দেশের বিদ্যুৎ স্বনির্ভরতাকে বিসর্জন দেওয়া হলো। এই সংশোধনী বিল দেশের সংবিধানের মূলে কুঠারাঘাত করেছে। বিদ্যুৎ বিষয়টি সংবিধানে যুগ্ম তালিকাভুক্ত। এই বিষয়টি বাতিল করতে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার স্টেট কমিশনের চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য সদস্যদের নির্বাচনের জন্য একটি সিলেক্ট কমিটি গঠন করবে। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

দ্বিতীয়ত, এই বিলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, বেসরকারিকরণকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং এর জন্য বিদ্যুৎপর্ষদগুলিকে বিভক্ত করতে হবে। পারস্পরিক ভরতুকি বা ক্রস সাবসিডি বিলোপ করে তার জায়গায় ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার বা গ্রাহককেই সরাসরি ভরতুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে বড়োবড়ো গ্রাহকদের আর ভরতুকির অর্থ বহন করতে হবে না। এই দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করবে। এক হিসাব অনুযায়ী সরকারের ভরতুকি বাবদ ব্যয়ের পরিমাণ এর জন্য ১৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া ঘরে ঘরে ‘স্মার্ট মিটার’ লাগানোর নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা বৃহৎ পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। একে কেন্দ্র করে দুর্নীতির আশঙ্কাও প্রবল।

এক কথায় বলা চলে, ৩টি প্রধান উদ্দেশ্য প্রস্তাবিত বিলের ক্ষেত্রে রয়েছে। ১) সাব-লাইসেন্স এবং ঠিকা সংস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ করা হবে। ২) ক্রস সাবসিডি বাতিল করার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের ভূমিকা খর্ব করা হচ্ছে। ৩) রাজ্যস্তরের প্রতিষ্ঠানগুলির বর্তমান ক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস করে বিদ্যুৎক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে।

বিগত ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন দল দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণের যে ধারাবাহিক চেষ্টা করে গেছে এবারে তার চূড়ান্ত রূপ দিতে চাওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বিলটিতে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। বিদ্যুতের মাশুল শুধু বৃদ্ধি পাবে তাই নয়, পরিণতিতে সমস্ত শিল্পজাত পণ্যেরই মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। দেশের স্বনির্ভরতা বিপন্ন হবে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিরোধে এগিয়ে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।