ইউক্রেন-রুশ সংঘাত ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ
লালন ফকির
রুশ-ইউক্রেন বৈঠক।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমশই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে এবং তা বিস্তৃতি লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশের মতে পরিস্থিতি যেভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, তার ফলে বিশ্বযুদ্ধের চেহারা গ্রহণ করতে পারে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক যুদ্ধ জোট এই সংঘর্ষকে অসামরিক নাগরিকদের রক্ষার স্বার্থ দাবি করছে। পাশাপাশি রাশিয়া এর বিপ্রতীপে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয়টিকে হাজির করছে। রাশিয়ার মতে ইয়োরোপের পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণে এই নিরাপত্তাহীনতা যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। প্রকৃতপক্ষে ইউক্রেন সহ পূর্ব ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে ন্যাটোর সম্প্রসারণের পরিকল্পনা পশ্চিমী দেশগুলি কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনে ‘একটি বিশেষ সামরিক অভিযান’ সংগঠিত করতে উদ্যোগী হন। এক টেলিভিশন বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা করেন যে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য হলো ইউক্রেনে ‘সামরিকীকরণ বন্ধ করা’, ইউক্রেনকে দখল করা নয়।
মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুগত প্রচারমাধ্যমগুলি তারস্বরে প্রচার করে চলেছে যে, এ হলো পরদেশ ঘিরে রাজনীতি যা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি সাধারণভাবে করে থাকে। কিন্তু বিগত দু-তিন দশকের আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি তা প্রমাণ করে না। ১৯৯৯ সালে মার্কিন সেনাদের নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া দখলের প্রক্রিয়া চলেছিল এবং যুগোস্লাভিয়া খণ্ডবিখণ্ডের মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক ইরাক দখল ছিল পরদেশ দখলের প্রক্রিয়া। একইভাবে গত দশকে লিবিয়া এবং সিরিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে সামরিক অভিযান চালিয়েছিল, তা ছিল এই পরিকল্পনারই অংশ।
প্রসঙ্গত স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, যুগোস্লাভিয়ায় যে সামরিক অভিযান ন্যাটো কর্তৃক সংগঠিত হয়েছিল, তা ইয়োরোপের বুকে অনুষ্ঠিত হয়। এই অভিযান পরিচালনার পূর্বে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। ইরাকের উপর সামরিক আক্রমণ সমস্তরকম আন্তর্জাতিক রীতি-নীতিকে লঙ্ঘন করে করা হয়। এইসব অপকর্মের বিষয়গুলি পশ্চিমী দুনিয়া বেমালুম ভুলে গেছে। এইসব সামরিক অভিযানের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলেই তারা আন্তর্জাতিক আইনের দোহাই দিয়ে সমস্ত দায়-দায়িত্বকে অস্বীকার করে যাচ্ছে।
ভ্লাদিমির পুতিনের মতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার বর্তমান লড়াইয়ের অন্যতম অভিমুখ ‘মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হীন প্রচারের’ বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। তাঁর মতে বিগত এক বছর ধরে ন্যাটোর সাথে রাশিয়া একটা সমঝোতায় আসতে চেয়েছে যার ভিত্তি হলো সমগ্র ইয়োরোপের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ‘সমতা এবং স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ’।
রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন বলেছেন যে, তিনি কখনও কোনো দেশের দখলদারি চান না বা দখল করার প্রশ্নে ব্ল্যাকমেইলের নীতি অনুসরণ করতে চান না। কিন্তু অন্যদিকে বিপুল আপত্তি এবং উদ্বেগ প্রকাশ করা সত্ত্বেও ন্যাটোর নেতৃত্বে বিশাল সামরিক সম্ভার রাশিয়ার সীমানায় হাজির করা হয়। রুশ কর্তৃপক্ষ একাধিকবার বলেন যে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ রাশিয়ার কাছে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন।
ইয়োরোপীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে এক উদ্যোগ গৃহীত হয়েছিল। এই যৌথ বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ইয়োরোপীয় নিরাপত্তা রক্ষা এবং ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণ বন্ধ। কিন্তু এই বৈঠক ব্যর্থ হয়। এরপরই মার্কিন প্রশাসন বিভিন্ন দেশের সামরিক মিত্র নির্ধারণের প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করে অর্থাৎ পুরানো মনরো নীতিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়। লাতিন আমেরিকার দখলদারি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিগত শতাব্দীতে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল।
পুতিন ন্যাটো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ করেছে যে, তারা ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং নব্য ফ্যাসিস্ত সংগঠনগুলিকে মদত দিয়ে চলেছে। এই প্রবণতার সূত্রপাত ঘটে ২০১৪ সাল থেকে, যখন পশ্চিমী মদতপুষ্ট ম্যাডন বিপ্লব সংগঠিত হয়। সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ অভিযান সংগঠিত হওয়ার একদিন পূর্বে রাশিয়া-ইউক্রেনের দুই স্বশাসিত অঞ্চলকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়। রাজনৈতিক মহলের মতে ইউক্রেনে রুশ অভিযানের অন্যতম কারণ হলো এই দুই অঞ্চলের নিরাপত্তা রক্ষা। ২০১৪ সালে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ-এর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সময় এই দুই অঞ্চল স্বায়ত্ত শাসনের দাবি করেছিল। ইয়ানুকোভিচ চেয়েছিলেন ইউক্রেন ন্যাটো বা ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে নিরপেক্ষতা বজায় রাখুক।
এই প্রেক্ষিতে রাশিয়ার নীতি হলো আরপিসি (রাইট টু প্রোটেক্ট সিভিলিয়ানস) নীতি। এই নীতি একসময় মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছিল। এই নীতির মূল কথা হলো অসামরিক নাগরিকদের রক্ষা করতে সামরিক হস্তক্ষেপ। ইউক্রেনে সংখ্যালঘু রুশ ভাষাভাষীদের উপর উগ্র ইউক্রেনীয়দের বিগত আট বছর ধরে আক্রমণ প্রতিরোধে রুশ হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
ইউক্রেনের দুটি অঞ্চলের স্বীকৃতি প্রদানের সময় রুশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, ইউক্রেন শুধু রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয় বরং তা রাশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্মিক সত্তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রুশ রাষ্ট্রপতির মতে, আধুনিক ইউক্রেনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহযোগিতায়। তিনি হুঁশিয়ারির সুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগীদের জানিয়ে দেন যে, তারা যদি ইউক্রেন অভিযানে শামিল হয়, তাহলে তাদের রুশ সেনার মুখোমুখি হতে হবে। পুতিন ন্যাটো জোটের শরিক দেশগুলির উদ্দেশে এও বলেছেন যে, তারা ২০১৯-এর পর থেকে ইউক্রেনের উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং নব্য ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলিকে মদত দিয়ে চলেছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে অর্থোডক্স চার্চগুলির ভূমিকাও রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপ ঘটলে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার চার্চগুলির ভূমিকা পুনরুজ্জীবিত হয়। ২০১৪ সালের ম্যাডন বিপ্লবের পর ইউক্রেনের সরকার এই পুনরুজ্জীবন প্রশ্নে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে। ইউক্রেনের নতুন সরকারের বিরুদ্ধে রুশ রাষ্ট্রপতির অভিযোগ যে, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করে রেখেছে। ইউক্রেন সরকারের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব প্রায় প্রতিদিন পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত ভাণ্ডার গড়ে তোলার উপর জোর দিয়ে চলেছে - তা বেশ উদ্বেগজনক।
রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিন সহ অন্যান্য নেতৃত্ব ইউক্রেনকে রাশিয়ার সামনে এক ‘প্রত্যক্ষ বিপদ’ বলে মনে করে। পশ্চিমী দেশগুলিকে এই বিপদের দিকটি অবশ্যই স্মরণে রাখতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দুনিয়ার থেকে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি সত্ত্বেও রাশিয়া তার ইউক্রেন অভিযানকে বন্ধ করেনি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পশ্চিমী দেশগুলি রাশিয়াকে শাসানির সুরে বলেছিল যে, ইউক্রেন আক্রান্ত হলে রাশিয়াকে দেয় ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্যে কাটছাঁট করা হবে। ইতিমধ্যেই দুটি গুরুত্বপূর্ণ রুশ ব্যাঙ্ককে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টার ব্যাঙ্ক ফিনান্সিয়াল টেলি কম্যুনিকেশন (সুইফ্ট) থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
ইতিমধ্যে রুশ-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে উদ্বাস্তু সমস্যা ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়েছে। সংঘাত শুরু হওয়ার দশদিনের মধ্যে প্রায় ১৩ লক্ষ ইউক্রেনবাসী নিজ দেশ ত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের রিফিউজি এজেন্সির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ইয়োরোপ আগামীদিনে বিশ্বের সর্ববৃহৎ উদ্বাস্তু সংকটের সম্মুখীন হতে চলেছে।
ইউক্রেনীয় উদ্বাস্তুরা অবশ্য ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক সংবর্ধিত হচ্ছেন এবং তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিদেশি নাগরিকদের জন্য যে সমস্ত বিধিনিষেধ ছিল তাও এক্ষেত্রে শিথিল করা হয়েছে। অবশ্য আফ্রিকান ছাত্ররা জানিয়েছে যে, ইউক্রেন পরিত্যাগে সেনাবাহিনী তাদের বাধা দিচ্ছে।
মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলি অবশ্য কোনো পক্ষ অবলম্বন করতে রাজি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা সহ আফ্রিকার ১৪টি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে মত দেয়নি। এক্ষেত্রে আফ্রিকায় বর্ণবিদ্বেষবাদী শাসকের পক্ষের যে অবস্থান মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছিল তারা তা ভুলতে পারেনি। এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলি বিশেষত জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর এবং অস্ট্রেলিয়া রাশিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে মত দিয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো এই যে, ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি জাইরে বোলসোনারো এই প্রশ্নে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন। ব্রিক্সভুক্ত দেশগুলির অবস্থান কিছুটা ভিন্ন। এই জোটে রাশিয়া অন্যতম সদস্য।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বলা চলে যে, রুশ-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলির পারস্পরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে এর মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন।