পদ্মা সেতুঃ স্বপ্নের উন্মোচন
অমিতাভ রায়
আবেগ আপ্লুত দেশ। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এক গর্বের উন্মাদনা। দেশের মানুষ তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় বসবাসরত সমস্ত বাংলাদেশি এক স্বপ্নের উন্মোচন নিয়ে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষমান। অবশেষে শনিবার ২৫ জুন, ২০২২ সকালে বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতার প্রকল্পর বাস্তবায়ন হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করলেন।
নদী পারাপারের জন্য সেতু নির্মাণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে কোনো বিরল ঘটনা নয়। প্রায়শই হয়ে থাকে। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণ নিঃসন্দেহে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি। প্রথমত, পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রমত্ত নদীগুলির তালিকায় পদ্মা নদীর স্থান দ্বিতীয়। প্রথম আমাজন। উপযুক্ত প্রযুক্তি, প্রভূত অর্থ ছাড়া এমন উদ্যোগের কথা ভাবাই যায় না। সর্বোপরি দরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস। বাংলাদেশ সরকার সেই সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পদ্মা নদীর উপরে তৈরি হয়েছে এই সেতু।
বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া-য় ২০০১-এর ৪ জুলাই পদ্মা সেতুর শিল্যান্যাস করেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর সরকার বদল হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা নদীতে বহে গেছে জল। আর সেতু নির্মাণ নিয়ে ছড়িয়েছে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের জাল।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক প্রথমে ঋণ দিতে উৎসাহী ছিল। বছর দশেক বাদে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক আচমকা অভিযোগ করে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে যথেষ্ট দুর্নীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক তৎক্ষণাৎ প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নেয়। সহযোগী ঋণদানকারী সংস্থাগুলিও প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। সরকারের স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সেতু বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসেন ভুঁইয়া ও মুখ্য ইঞ্জিনিয়ার কাজী ফেরদৌস। অভিযোগ ছিল কানাডার এক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের পাঁচ কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছিল। কানাডার আদালতে সেই দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। দুর্নীতির অভিযোগ মোকাবিলা প্রসঙ্গে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, “...ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আমেরিকানদের বলেছিলাম যে, হিলারি ক্লিনটন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কয়েকটি কোম্পানির হয়ে তদবির করেছিলেন। বলেছিলেন যে, ওদের কাজ দিলে কত পার্সেন্ট পাওয়া যাবে। আমার ডায়েরিতে সেসব লেখা আছে। দেব নাকি সব ফাঁস করে? তখন ওরা চুপ করে যায়।...” তিনি আরও বলেন যে, ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিলেন গ্রামীণ ব্যাংকের এম ডি নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস। গ্রামীণ ব্যাংকের এম ডি পদে ইউনুসকে বহাল রাখার জন্য ফোন করেছিলেন ব্রিটেনের তখনকার প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি। শেখ হাসিনা বলেছেন যে, এই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, দেশের রাজকোষের টাকায় এবং জনগণের আর্থিক সহযোগিতায় এই সেতু নির্মাণ করা হবে।
সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১৪-র ৭ ডিসেম্বর। বিশ্বের সেরা প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে তোলা এই সেতুর জন্য উপযোগী রসদ পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। মূল নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে চীনের একটি সংস্থা।
পদ্মা সেতু দেশের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষ উপকৃত হবেন। যাতায়াতের সময় কমবে। বাঁচবে জ্বালানি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো খরস্রোতা পদ্মা নদী পারাপারের জন্য এখন থেকে আর কোনো ঝুঁকি নিতে হবে না।
মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া থেকে ওপারের শরীয়তপুর পর্যন্ত নদীর উপর সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। আর ভায়াডাক্ট বা স্থলভাগে সেতুর অংশ সহ মোট দৈর্ঘ্যঃ ৯.৮৩ কিলোমিটার। প্রস্থঃ ২১.৬৫ মিটার। মোট পিলারের সংখ্যাঃ ৪২টি। স্প্যানের সংখ্যাঃ ৪১টি। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্যঃ ১৫০ মিটার। স্প্যানগুলোর মোট ওজনঃ ১,১৬,৩৮৮ মেট্রিক টন। প্রতিটি পিলারের নিচে পাইলের সংখ্যাঃ ৬টি (কিছু কিছু পিলারে ৭টি পাইলও দেওয়া হয়েছে)। পাইলের ব্যাসঃ ৩ মিটার। পাইলের সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্যঃ ১২৮ মিটার। মোট পাইলের সংখ্যাঃ ২৬৪টি (ভায়াডাক্টের পিলারের পাইলসহ ২৯৪টি)। ব্যবহৃত স্টিলের পরিমাণঃ ১,৪৬,০০০ মেট্রিক টন।
পদ্মা সেতুর জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তের ৬ নম্বর পিলার স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় মূল সেতুর নির্মাণ কাজ। সেতুটি দৈনিক ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচল করার উপযোগী। নদীর জলস্তর থেকে সেতুর উচ্চতাঃ ১৮ মিটার। ইংরেজি এস (S) অক্ষরের মতো পদ্মা সেতুর আকৃতি। রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূকম্পন হলেও সেতুর ক্ষয়ক্ষতি হবে না। সেতুর দুই পাড়ের অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্যঃ ১২ কিলোমিটার। সেতুর আয়ুষ্কাল ১০০ বছর ধরে নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। সেতুর জন্য মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হলেও শেষ পর্যন্ত ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
পদ্মা সেতুকে জলের মধ্যে ধরে রেখেছে ৪০টি স্তম্ভ। প্রত্যেকটি স্তম্ভ ইস্পাতের মজবুত পাইল দিয়ে তৈরি হয়েছে। জলের নিচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছে এই স্তম্ভের ভিত। পৃথিবীর আর কোনো দেশে আর কোনো সেতুর স্তম্ভ নদী বা সমুদ্রের এত গভীরে প্রোথিত হয়নি। পদ্মা সেতুর ভূমিকম্প প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ পৃথিবীর অন্য সব সেতুর চেয়ে অনেক বেশি। প্রায় ১০ হাজার টন। এই ক্ষমতায় এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও অনায়াসে টিকে যাবে।
২০১৪ সালে পদ্মার উপর শুরু হয় সেতু নির্মাণের কাজ। দোতলা এই পদ্মা সেতুর পিলার সংখ্যা মোট ৪২টি। প্রথম তল দিয়ে রেল চলাচল করবে। আর উপরের তলে রয়েছে সড়ক। স্প্যান সংখ্যা ৪১টি। শেষ স্প্যানটি বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। সেতু নির্মাণে যুক্ত ছিলেন প্রায় ৪ হাজার মানুষ। চীন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, নেদারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, ইতালি, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, কলম্বিয়া, তাইওয়ান, নেপাল ও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অবশ্যই বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ, ইঞ্জিনিয়ার ও কারিগররা পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিয়োজিত ছিলেন।
পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ট সুবিধা হবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গেও যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ও সুগম হবে। কলকাতা থেকে বাসে ঢাকায় আসতে হলে এতদিন পর্যন্ত পদ্মা পার হতে স্টিমারের প্রয়োজন হতো। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর সড়কপথেই সরাসরি ঢাকায় পৌঁছনো যাবে। কলকাতা থেকে ঢাকার দূরত্ব অন্তত ৫০ শতাংশ কমে যাবে। আগে কলকাতা থেকে ঢাকা, ৪০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে সময় লাগত ১০ ঘণ্টা। এখন তা মোটামুটি চার ঘণ্টায় হয়ে যাবে। আর রেলপথে পৌঁছতে সময় লাগবে মোটামুটি সাড়ে ছ’ঘণ্টা। সব ঠিক থাকলে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পদ্মা সেতু দিয়েই ভারত সফরে যেতে পারেন।
শুধু যে কলকাতা-ঢাকার রাস্তার দূরত্ব কমবে তাই নয়, পদ্মা সেতুর ফলে বঙ্গোপসাগর তীরের মংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব একশো কিলোমিটার কমে যাবে। বাংলাদেশ সরকার অনুমতি দেওয়ায় ভারত এখন এই দুটি বন্দর ব্যবহার করতে পারে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগ সুগম হবে। দুই দেশই আশা করছে, শেখ হাসিনার সফরের আগেই ভারত-বাংলাদেশ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। পদ্মা সেতু দু’দেশের বাণিজ্যেও নতুন সেতুবন্ধন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।পদ্মা সেতু তৈরির জন্য কোনো বৈদেশিক ঋণ-দান-অনুদান নেওয়া হয়নি। এমনকী ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক প্রবর্তিত ইদানিংকালের জনপ্রিয় নিদান পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিও অনুসরণ করা হয়নি। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অভিযোগ খারিজ করে এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের পিপিপি নিদানপত্র বাতিল করে দেশের মানুষের করের টাকায় অর্থাৎ সরকারি বাজেট থেকে বরাদ্দ করা টাকায় পুরো প্রকল্পটি নির্মিত হয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ নয়, রীতিমতো শিক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
সেতু ব্যবহারের জন্য টোল আদায় করা হবে। অবশ্যই টোল বাবদ সংগৃহিত অর্থ সরাসরি সরকারের তহবিলে জমা পড়বে। এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। মাওয়া প্রান্ত থেকে রওনা দেওয়ার আগে টোল জমা না দিলে সেতুর দরজা খুলবে না। একইভাবে সেতুর অন্য প্রান্তের শরীয়তপুর থেকে কোনো গাড়ি সেতু দিয়ে মাওয়া যাওয়ার চেষ্টা করলে সবার আগে টোল জমা দিতে হবে। অন্যথায় সেতুর দরজা বন্ধ। উদ্বোধনের সময় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ৭৫০ টাকা টোল দিয়ে সেতু ব্যবহার করেছেন।
একান্ন বছর আগে ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রমনা ময়দানের জনসমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেওয়ার সময় বলেছিলেন, “...আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না...”। হয়তো সেই শব্দবন্ধের অনুরণনে বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন বা সরকারি ভাষ্যে ‘স্বপ্নের উন্মোচন’ করার সময় সুকান্ত ভট্টাচার্যর কবিতা থেকে উচ্চারণ করলেন... ‘‘জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়...।”
বাংলাদেশ মাথা নোয়ায়নি। নিজের ক্ষমতায় আস্থা রেখে স্বপ্নের উন্মোচন সম্পন্ন করে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ ছড়িয়ে দিয়েছে সত্যিকারের আত্মনির্ভরতার বার্তা।