সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে
লালন ফকির
ইউক্রেনের সামরিক যুদ্ধজোট ন্যাটোয় অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে রুশ-ইউক্রেন সংঘাত তুঙ্গে।এইরকম অবস্থায় বাল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত দুই দেশ সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড ন্যাটো যুদ্ধজোটের সদস্যপদের আবেদন করায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে ১২টি দেশ নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা ন্যাটো চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ন্যাটোর উদ্ভবের সময়ে কারণ হিসাবে বলা হয়েছিল, পূর্ব ইয়োরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সামরিক ও অর্থনৈতিক আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এই ধরনের চুক্তির প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট ব্রিটেন, ইতালি, তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি প্রভৃতি এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন রুশ নেতৃত্ব ওয়ারশ চুক্তি বাতিল করেন এবং ন্যাটো যুদ্ধজোট ভেঙে দেবার দাবি জানান। কিন্তু বলাই বাহুল্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রুশ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ন্যাটোকে শুধু রেখে দিল তাই-ই নয়, এর সামরিকীকরণ আরও বৃদ্ধি করা হলো এবং পূর্ব ইয়োরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ শুরু হলো। রাশিয়া তা মেনে নিতে পারেনি এবং প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করেছে।
রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের মধ্যেই বাল্টিক সাগর অঞ্চলের দুই দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন ন্যাটো যুদ্ধজোটে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছে।একে কেন্দ্র করে আবার নতুনভাবে এই অঞ্চলে উত্তেজনা সৃষ্টি হচ্ছে। অতি সম্প্রতি ন্যাটোর সদস্যভুক্তির জন্য এই দুই দেশে জন সমর্থন ছিল অত্যন্ত সামান্য। ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত এক মতামত সমীক্ষায় দেখা যায় ফিনল্যান্ডের মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ ন্যাটোয় যোগদানকে সমর্থন করছে। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের এক মাসের মধ্যে এই সমর্থন ৭০ শতাংশে পৌঁছায়। সুইডেনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ঠান্ডা যুদ্ধের দীর্ঘ সময়েও এই দুই দেশের সঙ্গে রাশিয়ার কোনোরকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। রুশ-ইউক্রেন সংঘাত শুরু হলেও সেই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, কারণ রাশিয়ার যুদ্ধ অভিযানের লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন এবং সেখানকার রুশভাষী সংখ্যালঘুদের স্বার্থ, ফিনল্যান্ড বা সুইডেন রাশিয়ার আক্রমণের লক্ষ্য কখনোই ছিল না।
সুইডেন বিগত দু’শো বছর ইয়োরোপের বিভিন্ন সংঘাতে নিরপেক্ষ ছিল। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও তাদের এই অবস্থান বজায় ছিল। সুইডিশ সংসদে ন্যাটোয় যোগদানের সরকারি প্রস্তাবের বিপক্ষে একমাত্র বামপন্থীরা এবং গ্রিন পার্টি ভোট দেয়। অথচ সুইডেনে জোট সরকারের অস্তিত্ব এই দুই দলের সমর্থনের ওপর টিঁকে আছে। মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডানেলা অ্যান্ডারসন বলে আসছিলেন, তাঁর দেশ ন্যাটোয় যোগদান করবে না। এর পক্ষে যুক্তি হিসাবে তিনি বলেছিলেন যে, এর ফলে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান অঞ্চলে অস্থিরতা দেখা দেবে। সেদেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিটার হুল্টকুইস্ট একই ভাবে বলেছিলেন, ন্যাটোয় যোগদান করলে তাঁদের দেশে অস্থিরতা দেখা দেবে। কিন্তু এপ্রিল মাসের প্রথমে এই সুইডিশ রাজনৈতিক নেতারাই উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেন। সোশাল ডেমোক্র্যাট, যারা দেশের বর্তমান জোট সরকারের প্রধান দল তারা ন্যাটোয় যোগদানের পক্ষে ওকালতি করতে গিয়ে দেশের জনগণকে বোঝাচ্ছেন ন্যাটোকে কখনই সুইডেনের মাটিতে স্থায়ী ঘাঁটি গড়তে দেওয়া হবে না এবং ন্যাটো ভূখণ্ডে কোনো মার্কিন পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের জন্য মজুত করা হবে না। অন্যদিকে ন্যাটোয় ফিনল্যান্ডের যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিশেষ সমস্যা ছিল না, কারণ সেখানে শাসকদল সোশাল ডেমোক্র্যাট এবং বিরোধী দক্ষিণপন্থী দলগুলি সবাই এর পক্ষে ছিল।
আসলে এই দুই নর্ডিক দেশের রাজনৈতিক মহলের একাংশের ন্যাটোয় যোগদানের পক্ষে বরাবরই একটা ঝোঁক ছিল। ফিনল্যান্ডের কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সফরের সময়ে জো বাইডেনকে বলেছেন, দীর্ঘ ষোল বছর তাঁর দল তাঁদের দেশের ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্তির জন্য চেষ্টা চালিয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফিনল্যান্ড নাৎসি জার্মানির পক্ষে যোগদান করেছিল এবং সোভিয়েতকে আক্রমণে সহায়তা করেছিল। বিগত শতাব্দীর ৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে উভয় দেশই ন্যাটোর ‘শান্তির জন্য সহযোগী’ কর্মসূচিতে যোগদান করেছিল। এই কর্মসূচির লক্ষ্য ছিল রাশিয়ার সীমানা বরাবর বাল্টিক অঞ্চলে পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে পৌঁছে যাওয়া। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যখন আফগানিস্তান দখল করে সেই সময়ে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনও মার্কিনিদের সাহায্যের জন্য সেনা পাঠিয়েছিল। ২০১২ সালে মার্কিন বোমারু বিমানবাহিনী যখন লিবিয়ায় মুয়াম্মার গদ্দাফির সরকারের পতন ঘটায় তখন সুইডিশ বিমানবাহিনী তার সঙ্গে যুক্ত ছিল। এমনকি ২০১৭ সালে ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন মার্কিনবান্ধব ব্রিটেন পরিচালিত ‘জয়েন্ট এক্সপিডিশনারি ফোর্স’-এর সঙ্গে যোগদান করেছিল, যার লক্ষ্য ছিল বাল্টিক ও নর্ডিক অঞ্চলে ন্যাটোকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তিশালী করা।
ফিনল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার ১৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে। সেন্ট পিটার্সবার্গের সঙ্গে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কির দূরত্ব মাত্র ৩০০ কিলোমিটার। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলেনবার্গ বলেছেন, ইউক্রেনের ব্যাপারে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ পশ্চিমী এই সামরিক জোটকে “আগের যেকোনো সময়ের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী” করেছে। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো জোটে প্রবেশের পরে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার বাস্তবতা তৈরি হলো।
পূর্বতন ওয়ারশ চুক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলিকে নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে ন্যাটোর দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটেছে।ন্যাটোর বর্তমান সদস্য দেশের সংখ্যা ৩০। এদের সম্মিলিত সামরিক শক্তি রাশিয়ান ফেডারেশনের চারগুণ। এর সঙ্গে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড যুক্ত হলে তা রাশিয়ার আশঙ্কার কারণ হতে পারে বলে ধারণা।
রাশিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, সম্প্রসারিত ন্যাটোর মোকাবিলা তারা করবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ন্যাটোকে মোকাবিলা করতে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহ অন্যান্য ব্যবস্থা তাঁরা গ্রহণ করবেন। বরিষ্ঠ রুশ আধিকারিকরা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, রুশ বাহিনী পরমাণু কেন্দ্রগুলি উভয় দেশের সীমানায় স্থাপন করছে।
ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়, অর্থাৎ কোনো একটি সদস্য দেশ আপত্তি করলে সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়না। ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তুরস্ক ইতিমধ্যেই সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছে। তুরস্ক মনে করে উভয় দেশই ‘‘সন্ত্রাসবাদীদের অতিথিশালা’’। সুতরাং, এদের কিছুতেই সদস্যপদ দেওয়া উচিত নয়। সিরিয়া এবং ইরাকের বিচ্ছিন্নতাবাদী কুর্দরা মার্কিন মদতপুষ্ট। নিষিদ্ধ সংগঠন কুর্দিস ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যরা ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোগান চান না তাঁর দেশ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক দীর্ঘকালের। তুরস্কের প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের এক তৃতীয়াংশ আসে রাশিয়া থেকে। এছাড়া রাশিয়া সেখানে বিপুল পরিমাণ গম সরবরাহ করে।তুরস্ক রাশিয়া থেকে সম্প্রতি এস ৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছে। রাশিয়া তুরস্কতে একটি বড়ো পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন করেছে। তুরস্কের অর্থনীতি তাৎপর্যপূর্ণভাবে রুশ পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল। এই ক্ষেত্রটি কোভিড অতিমারী এবং ইউক্রেন সংঘাতের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।তুরস্ক রুশ-ইউক্রেন সমস্যা সমাধানের জন্য মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়েছে, যা মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকায় বাধা পেয়েছে। এসব সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য ন্যাটো সদস্য, যেমন ফ্রান্স এবং জার্মানি মনে করে - কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারলে সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে তুরস্ককে সম্মত করানো যাবে।
ন্যাটো সম্প্রসারণ পরিকল্পনার কঠোর সমালোচক হলো চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইউক্রেন সংঘাতকে হাতিয়ার করে ন্যাটোর সম্প্রসারণে উদ্যোগী হয়েছে, চীন তারও সমালোচক। প্রসঙ্গত, পশ্চিমী দুনিয়া এই জোটে এশীয় দেশগুলির অন্তর্ভুক্তি চায়। কার্যত অস্ট্রেলিয়া এখন ন্যাটোভুক্ত হয়ে আছে কারণ তারা ‘আউকুস’ (অস্ট্রেলিয়া-ইউকে-ইউএস) জোটের অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইছে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াকেও ন্যাটোভুক্ত করতে। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিদেশমন্ত্রীরা এপ্রিল মাসে ন্যাটোর উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে যোগদান করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু গ্রেট ব্রিটেন ন্যাটোকে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে টেনে আনার অভিপ্রায়কে গোপন করেনি। ব্রিটিশ বিদেশ সচিব লিজ ট্রুস বলেছেন, ন্যাটোর “একটি বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি” থাকা দরকার এবং “ইন্দো- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমস্যা সৃষ্টি না হতে দেওয়া” উচিত।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন টোকিয়োতে কোয়াড সম্মেলনে যোগ দিতে এসেও এ সম্পর্কে কিছু বক্তব্য রেখেছেন। ন্যাটো সম্প্রসারণের বিপদ ইউক্রেন-ফিনল্যান্ড-সুইডেনের ন্যাটোভুক্তির প্রসঙ্গে আবদ্ধ থাকছে না, তা অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ছে।