জার্মানির সাম্প্রতিক নির্বাচনে সমর্থন হ্রাস পেল দক্ষিণপন্থীদের
বিশেষ প্রতিবেদনঃ জার্মানির বুন্দেসটাগ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এসপিডি) এবং ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ)-এর মধ্যে আসনের ফারাক খুব একটা না থাকলেও যে বার্তা গত ২৭ সেপ্টেম্বরের নির্বাচন দিলো, তা বিশ্বগ্রাসী বাজারব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি রায় বলা যায়। এসপিডি একটি মধ্য-বাম দল। সিডিইউ একটি দক্ষিণপন্থী দল যারা বিগত ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও সেই দেশে দক্ষিণপন্থী জনবিরোধী অর্থনীতির সিংহভাগটাই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চাপে রূপায়ণ করতে পারেনি। আবার এই দক্ষিণপন্থী দলটি ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’ (এএফডি–নাজিদের উত্তরাধিকার বহনকারী)-র মতো অতি দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার মতো অবস্থায়ও যেতে পারেনি।
দক্ষিণপন্থীদের পশ্চাৎগতি এবং মধ্য-বামের অগ্রগতি
এই নির্বাচনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দক্ষিণপন্থীদের পশ্চাৎগতি। এই নির্বাচনে এএফডি’র ভোট ১০.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। গতবারে অর্থাৎ ২০১৭ সালে তাদের ভোট ছিল ১২.৬ শতাংশ। কিন্তু পুর্ব জার্মানিতে তারা কিছুটা হলেও তাদের জমি শক্ত করেছে। পুর্ব জার্মানি ১৯৯০ সালের আগে ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, জার্মানির পুনর্গঠনের পর পুর্ব জার্মানির জনগণের একটি অংশ নিজেদের বঞ্চিত বলে মনে করেন এবং তাদের সরকার-বিরোধী ভোট এই অতি দক্ষিণপন্থীদের ঝোলায় গেছে। পুর্ব জার্মানিতে দক্ষিণপন্থী দল সিডিইউ’রও ভোট উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। তাসত্ত্বেও এএফডি’র বক্তব্য হলো, সিডিইউ চাইলে তারা সরকার গঠনে সাহায্য করবে। এবারের নির্বাচনে অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল সিডিইউ’র ভোট ২০১৭-র তুলনায় ৮.৯ শতাংশ কমেছে। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে, দক্ষিণপন্থীরা সামগ্রিকভাবে কিছুটা হলেও পিছু হটেছে।
যে দলগুলি এবারে কিছুটা হলেও শক্তি সঞ্চয় করেছে তাদের মধ্যে আছে এসপিডি এবং গ্রিন পার্টি। এসপিডি এবং গ্রিন দলের ভোট ২০১৭-র তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ৫.২ এবং ৫.৮ শতাংশ। ডাই লিংকে বা বাম দলের ভোট কমেছে ৪.৩ শতাংশ।
এই সেপ্টেম্বরের দেশব্যাপী নির্বাচনে সমাজজীবনের আলোচ্য সমস্যাগুলি এবং রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে Tagesschau.de নামে টেলিভিশন নিউজ চ্যানেল এবং তাদের ওয়েব পোর্টাল একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষাটির ফল প্রকাশিত হয় গত ১৩ আগস্ট। সমীক্ষাতে সিডিইউ, এসপিডি, এএফডি, এফডিপি, লেফট পার্টি এবং গ্রিন পার্টির ইশতেহারের পর্যালোচনাও করা হয়।
ওই সমীক্ষায় দেখা যায়, দলগুলির আগামী দিনের কর্মসুচির মধ্যে পার্থক্য ছিল উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জলবায়ু নীতির কথা। অতি দক্ষিণপন্থী দল এএফডি ছাড়া বিষয়টি প্রত্যেকটি দলের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সমস্যাটির প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দেয় গ্রিন পার্টি। জলবায়ু নিরপেক্ষতার (পরিকল্পনা এমনভাবে করা, যাতে দেশের দূষণ মাত্রা শূন্যতে নিয়ে যাওয়া যায় কিংবা কার্বন নির্গমন এবং কার্বন শোষণ সমান থাকে) লক্ষ্যে সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা রয়েছে গ্রিন পার্টি, ডাই লিংকে এবং এসপিডি’র। তাদের পরিকল্পনা হলো, ২০৪৫-র মধ্যে জলবায়ু নিরপেক্ষতার জায়গায় পৌঁছে যাওয়া।
কর নীতি কী হওয়া উচিত সেই ভাবনার মধ্যেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা দলগুলির মধ্যে বড়ো পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। বিগত দিনে করোনার সংকট এবং বন্যার ক্ষতি একটা বড়ো অংশের জনসাধারণের আর্থিক সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এসপিডি, গ্রিনস এবং বাম দলের মতে, ধনীদের আয়ের উপর আরও বেশি কর বসানো দরকার। অন্য দলগুলি এই কর বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। পূর্বের সরকার সবার উপর সমানভাবে কার্বন কর চাপানোর চেষ্টা করেছিল। শ্রমিক-কর্মচারীদের ইউনিয়নগুলি এরও বিরোধিতা করে।
এই প্রসঙ্গে একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা যায়। ২০২০ সালে যখন করোনা অতিমারীর প্রথম আঘাত একটু কমেছে সেই সময়ের জুন মাসের ২৭ তারিখে মধ্য জার্মানির সালফেল্ড-রুডলস্টাট জেলাক্ষেত্রের নির্বাচন হয়। জেলার আধিকারিক (ল্যান্ডস্টাটড) হিসাবে নির্বাচিত হন এসপিডি’র দীর্ঘদিনের নেতা মার্কো ভোলফরাম।
ভোলফরামের মতে এএফডি জার্মানির জন্য এক বিপদের আবহ তৈরি করেছে। করোনাকালে মাস্ক-বিরোধী এবং টিকা-বিরোধী আন্দোলন গডে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। অন্যদিকে দেশের প্রধান দলগুলি করোনা বিধি পালনের জন্য সচেষ্ট। এসপিডি এবং বামদলগুলি দেশে সিরিয়া, লেবানন, তুর্কি ইত্যাদি দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মানবতার কারণে যখন জার্মানিতে আশ্রয় দিতে চাইছে তখন এএফডি তার তীব্র বিরোধিতা করছে। ভোলফরামের মতে, আমেরিকায় ট্রাম্পের হার সারাবিশ্বে অতি দক্ষিণপন্থীদের নিরুৎসাহিত করেছে।
নির্বাচনে এই মিশ্র ফলাফল থেকে বলা যায় যে, ইয়োরোপের এই শক্তিশালী অর্থব্যবস্থা কিছুটা হলেও ঝুঁকছে বিশ্বায়িত বাজার নীতি এবং মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আমেরিকা এবং ইয়োরোপের দেশগুলিতে সামাজিক সুরক্ষা ব্যয় হ্রাস এবং বিভিন্নক্ষেত্রে মুক্ত বাণিজ্যের সূচনার প্রায় এক দশকের পর থেকে এই দেশগুলির সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই নীতিসমূহের বিরুদ্ধে এক প্রতিরোধের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। একথা ঠিক যে, এই পরিস্থিতির উদ্ভব পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ। বলা যেতে পারে, এর ফলে বিশ্বায়িত পুঁজি কিছুটা হলেও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। আবার একথাও সত্য যে, এই পৃথিবীকে বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে বাঁচানোর তাগিদও অনেকেই অনুভব করছেন যার প্রতিফলন এই নির্বাচনের ফলেও প্রকাশ পেয়েছে।