তালিবান শাসিত আফগানিস্তান ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্ক
(এক)
লালন ফকির
তালিবানদের শাসনে আফগানিস্তান চলে আসার পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক স্তরে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। এর ভূ-রাজনৈতিক কারণও আছে। আফগানিস্তান একটি স্থলবেষ্টিত দেশ। অন্তত সাতটি দেশের সাথে এর কয়েক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমানা রয়েছে। এইসব দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, তুর্কমেনিস্তান, আজারবাইজান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকস্তান। এইসব দেশ সহ বিভিন্ন রাষ্ট্র আফগানিস্তানে বিশ বছর পর তালিবান শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এইসব প্রতিক্রিয়ার ফলে পূর্বতন তালিবান শাসনকাল সম্পর্কে অবস্থানের মিল ও অমিল উভয়ই রয়েছে। চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলি এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে, তারা আফগানিস্তানের নতুন তালিবান সরকারের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য স্বাভাবিক করতে চায়। পাকিস্তান প্রত্যাশামতন আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানিস্তানে তালিবান সরকারের প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে আফগান জনগণের আত্মমর্যাদা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। পশ্চিমী দেশগুলি এখনও পর্যন্ত তালিবান শাসিত আফগানিস্তান সম্পর্কে সুসংহত কোনো নীতি ঘোষণা না করলেও পরিস্থিতিকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালে প্রথম যখন তালিবান মিলিশিয়ারা কাবুল দখল করে, তখন তাকে যে তিনটি দেশ স্বীকৃতি জানায় তার মধ্যে অন্যতম হলো পাকিস্তান। অপর দুইটি দেশ হলো সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি (ইউএই)। বর্তমানে পশ্চিম এশীয় অঞ্চলের অন্যতম দেশ কাতারের সাথে তালিবানদের ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কাতারের শাসকগোষ্ঠী রাজধানী শহর দোহাকে তালিবানদের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনার জন্য ব্যবহার করতে দিয়েছে।
প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তালিবানদের দপ্তর স্থাপনে নিজ দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে সম্মতি দিল, কিন্তু তালিবানরা তাদের প্রকৃত দূতাবাসটি দোহায় স্থাপনে আগ্রহী ছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদের পুরানো মিত্র থেকে দূরত্ব তৈরি করা। কিন্তু প্রবীণ তালিবান নেতা সৌদি শাসকদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উত্থাপন করে যে, তাঁরা আফগানিস্তানে মৌলবাদী মতাদর্শ ‘ওয়াহাবি’ প্রচার করছে। শেষ দশকে তালিবান নেতৃত্ব যখন আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পশ্চিমী শাসকদের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিল তখন তারা ঘোষণা করেছিল যে, প্রথমবার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তারা যে নীতি গ্রহণ করেছিল, তার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
আন্তর্জাতিক মহলে একথা সর্বজনবিদিত যে, তালিবানদের প্রধান মদতদাতা হলো পাকিস্তান। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের (যা ৯/১১ বলে পরিচিত) ঘটনার পর যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ন্যাটো বাহিনীর দ্বারা তালিবান নেতা, কর্মীরা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল, তখন তাদের উদ্বাস্তু হিসাবে পাকিস্তান আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, গত দশকে তালিবানদের উপর পাকিস্তানের প্রভাব বেশ খানিকটা হ্রাস পেয়েছিল। পাকিস্তানি তালিবানদের অবশ্য নিজস্ব কর্মসূচি ছিল। গত দশকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল প্রধানত সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থিত অসামরিক কেন্দ্রগুলির উপর আত্মঘাতী আক্রমণ সংগঠিত করা।
জুলাই মাসে বালুচিস্তানে নির্মীয়মান একটি জলাধারে কর্মরত চীনা শ্রমিকদের উপর যে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল, তা পাকিস্তানি তালিবান এবং আল কায়দা মদতপুষ্ট ইউগোর সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কোনো কোনো মহলের মতে এরা পাকিস্তানি রাষ্ট্র উৎখাত করে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করতে পারে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আত্মঘাতী জঙ্গি গোষ্ঠী গঠিত হয়েছে যাদের দ্বারা প্রচুর সংখ্যক পাক নাগরিক নিহত হয়েছে। তাছাড়া আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাকিস্তান মনে করছে, এর মধ্য দিয়ে পাক সামরিক বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে বাড়তি সুবিধা পাবে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং শাসকশ্রেণি সবসময়ই ভারতকে প্রধান বিপদ বলে মনে করে।
আফগানিস্তান-ভারত সম্পর্ক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বিগত দুই দশকে আফগানিস্তানে ভারতের বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। এই অর্থে সেখানে নির্মিত হয়েছে রাস্তা, জলাধার, হাসপাতাল প্রভৃতি। আফগান সামরিক অফিসার এবং নিরাপত্তা কর্মীরা ভারতে প্রশিক্ষিত হয়েছে। কাবুল সরকার চারটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভারতকে কূটনৈতিক দপ্তর স্থাপনে অনুমতি দিয়েছে। এগুলি হলো পাকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং ইরানের সীমান্ত এলাকা। কাবুলে যাওয়ার পথে প্রথম যে শহরটি তালিবানরা দখল করেছিল তা হলো নিমরুজ যা ইরানের সীমান্তে অবস্থিত। এর রাজধানী শহর জারাঞ্জও দখল হয়েছিল। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। কাবুল কান্দাহার সড়কের উপর অবস্থিত ডেলারাম শহরের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী ২১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথটি নির্মাণ করেছে ভারত। এই সড়ক নির্মাণের সময় কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকদের উপর বারেবারে তালিবানদের আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে। এই আক্রমণে ছয়জন ভারতীয় এবং ১৪০ জন আফগান নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, জারাঞ্জ শহরটি ইরানের চহ্বর বন্দরের কাছে অবস্থিত। এই বন্দরটি উন্নয়নে প্রধান ভূমিকা ছিল ভারতের। ভারতের প্রত্যাশা ছিল, এই বন্দরটির সাহায্যে ভারতীয় পণ্য আফগানিস্তানে এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছাবে। এখন আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তালিবানদের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর তা চালু হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর, ভারত তার কর্মচারীদের আফগানিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে। বিশেষত কান্দাহার, হেরাট, জালালবাদ এবং উজবেকিস্তানের সীমানায় অবস্থিত মাঝহার ই শরিফ থেকে এই প্রত্যাহার পর্ব জোরালো ছিল। অন্যান্য আফগান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি তালিবান কর্তৃক কাবুল দখলের আগে পর্যন্ত দূতাবাসগুলি চালু রেখেছিল। কৌতুকের বিষয় হলো এই যে, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি তাদের কূটনীতিবিদদের দেশে ফিরিয়ে আনে এবং কাবুলে তাদের দূতাবাসগুলি বন্ধ করে দেয়। অধিকাংশ ইয়োরোপিয়ান দেশগুলি যারা প্রধানত মার্কিন প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত, তারাও তাদের কূটনীতিবিদদের কাবুল থেকে ফিরিয়ে আনে।
ইউরেশিয়ান দেশগুলিও আফগানিস্তানে চলমান অস্থিরতায় উদ্বিগ্ন। এইসব দেশের আশঙ্কা, আফগানিস্তানের উপর তালিবান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ফলে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পাবে। মাদক পাচারও মাত্রাহীন হয়ে উঠবে। উদ্বাস্তু সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আফগানিস্তানে তালিবান শাসকদের সাথে কাজ চালানোর ন্যায় মৈত্রী স্থাপনে তারা আগ্রহী।
ভারত তাদের কূটনীতিবিদদের কাবুল থেকে ফিরিয়ে আনতে মার্কিন প্রশাসনের সাহায্য গ্রহণ করে। কারণ তালিবানরা আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব মার্কিনিরা গ্রহণ করেছিল। এই প্রশ্নে ভারত সরকার কিছুটা সংযত আচরণ করে। যদিও ভারত সরকারের মূল পরিচালক আরএসএস ঘোষণা করেছে যে, তালিবানরা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার সামনে এক বড়ো বিপদ। আসলে ভারতেও আরএসএস সহ হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি তালিবানদের আফগান দখলকে সামনে রেখে ভারতে তাদের মেরুকরণের রাজনীতিকে জোরদার করতে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টির একজন ৯২ বছর বয়সী সাংসদকে দেশদ্রোহিতার চার্জে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর অপরাধ (!) মার্কিনিদের কবল থেকে আফগানিস্তানকে মুক্ত করতে তালিবানদের তিনি সমর্থন করেছেন। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে, আগামী বছর উত্তরপ্রদেশ সহ যে পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে এই বিষয়কে রাজনৈতিক ইস্যু করা হবে। হিন্দুত্ববাদীদের এই অপপ্রয়াসকে মোকাবিলা করার নামে ভারতে উগ্র মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলির সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে।
এখানেই শেষ নয়। আফগানিস্তানে তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠার পরিণতিতে এই অঞ্চলে আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে পারে। তাছাড়া তালিবানদের সাথে রাশিয়া, চীনের সম্পর্ক কী দাঁড়ায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমী দেশগুলি কী অবস্থান গ্রহণ করে এ সমস্ত প্রসঙ্গ অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। কারণ এ সমস্ত বিষয় আফগানিস্তান ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে।
(পরবর্তী সংখ্যায়)