মার্কিন সামরিক ব্যবস্থা এখন ইরাকে প্রধান লক্ষ্যবস্তু
লালন ফকির
বিগত কয়েক মাসের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের এক বড়ো অংশ মনে করছেন ইরাকের মাটিতে এখন আর মার্কিন সেনাবাহিনী নিরাপদ নয়। বেশ কয়েকবছর ধরে ইরাকের জনগণ দাবি করে আসছিলেন তাদের ভূখণ্ড থেকে মার্কিন সেনাসহ সমস্ত বিদেশি সেনা প্রত্যাহৃত হোক। কিন্তু ইরাকে অবস্থিত পালের গোদা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে এই প্রশ্নে তেমন কোনো সদর্থক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরাকীয় জনগণের মার্কিন বিরোধী ক্ষোভ মার্কিন সেনাদের ওপর আক্রমণে পরিণত হচ্ছে।
কয়েকমাস পূর্বে সামরিক কর্তা মেজর জেনারেল কাসিম সোলেইমানি মার্কিন প্রশাসনের চক্রান্তে নিহত হওয়ার পর ব্যাপক বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এর পূর্বে মার্কিন সেনাদের আক্রমণের সম্মুখীন হয় কাতিব হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর সদস্যরা। এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীর পাঁচটি শিবিরের ওপর মার্কিন সেনাবাহিনীর আক্রমণের ফলে ২৫ জন নিহত এবং ৫০ জন আহত হয়। এই শিবিরে মিলিশিয়ারা ছাড়াও ইরাকি সেনাবাহিনীর কিছু সেনা ছিল।
এই নৃশংস হামলার পক্ষে যুক্তি হিসাবে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় আত্মরক্ষার লক্ষ্যে এই আক্রমণ। কারণ, এইসব ক্যাম্প থেকে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ সংগঠিত করার পরিকল্পনা ছিল, যা বানচাল করতেই এই আক্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু ইরাকি প্রশাসন মনে করে যে, এই অভিযোগ ছিল সবৈব অসত্য এবং কল্পনাপ্রসূত। এই আক্রমণের মধ্য দিয়ে ইরাকি সার্বভৌমত্বকেই আক্রমণ করা হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, ইরাকি শিবিরের উপর আক্রমণের মাত্র আধঘণ্টা পূর্বে মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব মার্ক এসপার ইরাকি প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল্লাহ মাহদিকে এর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। ইরাকি প্রধানমন্ত্রী এর তীব্র সমালোচনা করে এই ধরনের আক্রমণ ঘিরে মার্কিন প্রশাসনকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন তাতে কর্ণপাত করেনি। এই ধরনের হীন আক্রমণ সম্পর্কে ইরাকি প্রশাসন এবং মার্কিন প্রশাসনের ইয়োরোপীয় সহযোগীরা কেউই ওয়াকিবহাল ছিল না।
কাতিব হিজবুল্লাহদের পাঁচটি শিবিরের উপর আক্রমণের যুক্তি হিসাবে এদের আত্মরক্ষায় কয়েকজন মার্কিন সেনা (একজন সামরিক ঠিকাদারসহ) নিহত হওয়ার ঘটনাকে তুলে ধরে। কাতিব হিজবুল্লাহদের পক্ষ থেকে অনেক পূর্বেই এর তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয় এবং এই হত্যাকাণ্ডের সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই, তাও জানিয়ে দেওয়া হয়। আসলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এই ঘটনার জন্য প্রকৃত দায়ী ছিল ইরাকের কুর্দিশ বাহিনী। ইরাকের সরকার এদের নিয়ন্ত্রণ থেকে কিরবুক অঞ্চলের দখল নেওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। এছাড়া ইরাকে আইএস’র নিয়ন্ত্রণ থেকে কিরবুক অঞ্চলের দখল নেওয়াকে মেনে নিতে পারেনি। এছাড়া ইরাকে আইএস জঙ্গিদের প্রভাব হ্রাস পেলেও, তাদের অস্তিত্ব একেবারে বিলোপ হয়নি। ফলে মার্কিনীদের উপর আক্রমণে এদের ভূমিকা একেবারেই অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের এতসব গভীর বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ নেই। কাতিব হিজবুল্লাহের উপর আক্রমণের অব্যবহিত পরেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিদেশসচিব মাইক পম্পিও এক বিবৃতিতে মার্কিন সামরিক ঠিকদারের মৃত্যুর ‘উপযুক্ত জবাব’ দেওয়া হয়েছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। কাতিব হিজবুল্লাহদের যে পাঁচটি ঘাঁটির উপর মার্কিনী আক্রমণ সংগঠিত হয়েছে, তার তিনটি ইরাকে এবং বাকি দুইটি সিরিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। শেষোক্ত ঘাঁটিগুলি ঘন জনবসতি এলাকায় রয়েছে। ইরাকে অবস্থিত আইএস জঙ্গি ঘাঁটিগুলি নির্মূল করতেই এরা ব্যস্ত।
প্রসঙ্গত, কাতিব হিজবুল্লাহ হলো ‘পপুলার মবিলাইজেশন গ্রুপ’ (পিএমজি)’র অংশ এবং ইরানের দ্বারা প্রশিক্ষিত। এই অঞ্চল থেকে আইএস জঙ্গিদের উৎখাত করাই এদের প্রধান উদ্দেশ্য। লেবাননে বিগত চার দশক ধরে যে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, তাদের সাথে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। কাতিব হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী পিএমজি’র অংশ, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরাক থেকে আইএস জঙ্গিদের দূর করতে সক্রিয়। বর্তমানে ইরাক এবং সিরিয়ার এক-তৃতীয়াংশ আইএস জঙ্গিদের দখলে রয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, স্বাধীনভাবে ইরাকি সেনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত আল-কায়ুম- আল বুকামির-এর উপর মার্কিন সেনা সামরিক অভিযান চালিয়েছে। অন্যান্য সীমান্ত ঘাঁটিগুলিতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে। অন্যান্য সীমান্ত ঘাঁটিগুলিতেও ইজরায়েলি হানা চলছে। ইরাকি জনগণ মনে করেন যে, ইরানের কোনো সামরিক অস্ত্র সরঞ্জাম যাতে ইরাকে পৌঁছাতে না পারে তা আটকাতেই ইরাকে মার্কিন সেনা রয়েছে। বর্তমানে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন সেনাবাহিনীর সংখ্যা ৫২০০-র বেশি। এই মার্কিন সেনাবাহিনীর আর একটি ‘দায়িত্ব’ হলো ইরাক-সিরিয়া সীমানা অতিক্রম করে ইরানি অস্ত্র যাতে লেবানন পৌঁছাতে না পারে, তা তদারকি করা। লেবাননের হিজবুল্লাহ মিলিশিয়াদের ক্রমাগত আক্রমণ থেকে ইজরায়েলকে রক্ষা করতেই ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিন-সেনারা সক্রিয় বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা। গত বছর আগস্ট মাসে তৎকালীন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেছিলেন যে, ইরান যাতে ইরাকে তাদের সামরিক শক্তি সংহত করতে না পারে, তার জন্য ইজরায়েল তৎপর রয়েছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইরাকের উপর যে সমস্ত ইজরায়েলি সামরিক আক্রমণগুলি সংগঠিত হয় তাতে মার্কিন সমর্থন হয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে মানটুনে মার্কিন প্যারা মিলিটারি বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের পর উভয় দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাস্তবতা আছে বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন না। পিএমজি’র আসল নেতা আবু মাহদি অল মুহান্দিস তার বাহিনীর ২৫ জন সদস্যের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা করেছেন। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীও মার্কিন বাহিনীর এই আক্রমণের কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে তিনি এই আক্রমণকে ইরাকের সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ বলে আখ্যা দিয়েছেন। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি তিনদিন জাতীয় শোক প্রতিপালনের আহ্বান জানান।
কাতিব হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর ঘাঁটিগুলির উপর সামরিক আক্রমণের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রশাসন কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছে। জনগণের সৃষ্ট বিক্ষোভকে বেপথু করতে মার্কিন প্রশাসন ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিনবিরোধী ইরাকি জনগণের বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশ্যে এক ট্যুইট বার্তায় বলেছেন যে, ইরাকি জনগণের উচিত মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত না করে, ইরাকের রাজনীতিতে ইরানের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ প্রদর্শনে শামিল হওয়া। কিন্তু মার্কিন চালাকি যে কার্যকর হয়েছে তা বলা যায় না। কারণ, মানুষের মার্কিনবিরোধী ক্ষোভ প্রতিদিনই বেড়েই চলেছে।
ইরাকে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস বিশ্বের মধ্যে বৃহত্তম। ১০০ একর জমির উপর এর অবস্থান। প্রতিদিনই হাজার হাজার ইরাকি জনগণ তাদের দেশ থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে সেখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছে। ট্রাম্প সম্প্রতি দূতাবাসের পাহারা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত ৭৫০ নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্ত করেছে।
পূর্বোক্ত প্রেক্ষাপটে এটা বলা চলে যে, মার্কিন প্রশাসন বিশেষত মার্কিন সেনাবাহিনী এখন ইরাকি জনগণের চরম শত্রু এবং ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরে অনুষ্ঠেয় মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রূপে উপস্থিত হয়েছে - এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।