প্যালেস্তাইনঃ নিজভূমে পরবাসী হায়রে দিনমান!
অরিন্দম মুখোপাধ্যায়
এই মুহূর্তে জ্বলছে প্যালেস্তাইন। রক্তস্নাত প্যালেস্তাইন। পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত প্যালেস্তাইন ভূখণ্ড গাজা। চলছে প্যালেস্তাইনের হামাস গোষ্ঠীকে নির্মূল করার নামে ইজরায়েলের ভয়াবহ আক্রমণ। গত ৭ অক্টোবর থেকে ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত কুড়িদিনে ইজরায়েলি বোমা বর্ষণে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। যার মধ্যে ২৯১৩ জন শিশু। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বিপুল। গাজার ৪৫ শতাংশ বাড়িঘরই ভগ্নস্তূপে পরিণত। এ পর্যন্ত দুই লক্ষের বেশি বাড়ি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।এই বীভৎস সংঘর্ষ, রক্তপাত ও প্রাণহানির পশ্চাতে রয়েছে এক আধিপত্যবাদী আগ্রাসনের দীর্ঘ ইতিহাস।
প্যালেস্তাইন উগ্র জাতিবাদী আগ্রাসনের নির্মম পীড়নে নিষ্পেষিত বিপন্ন মানচিত্রের একটি রাষ্ট্র। নিজভূমে পরবাসী, সম্ভ্রমহীন, অধিকারহীন জাতির ঠিকানা। সেই প্যালেস্তাইনের একটি ছোট্ট ভূখণ্ড গাজা। ভূমধ্যসাগরের পূর্ব প্রান্তের এই ভূখণ্ডের জনসংখ্যা মাত্র ২৩ লক্ষ। যা আমাদের অনেক জেলার জনসংখ্যারও কম। এহেন একটি ভূখণ্ডের নারী-শিশুসহ সর্বস্তরের মানুষ বারবার ইঙ্গ-মার্কিন মদতপুষ্ট মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্র ইজরায়েলের বর্বর ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণে চূড়ান্ত বিপন্নতার শিকার হয়েছে বিগত বহু বছর ধরে। দলে দলে সেখানকার মানুষ হয় রাষ্ট্রসংঘ পরিচালিত শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে নতুবা পার্শ্ববর্তী দেশ মিশরে পালিয়েছে রাফা সীমান্ত পেরিয়ে। আর এইরকম অমানবিক, ভয়ানক আগ্রাসন ও আক্রমণের বীভৎস রূপ দেখেশুনে স্তম্ভিত ও বিচলিত হয়েছে বিশ্বের শান্তিপ্রিয়, স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ।
এই একতরফা বর্বর আক্রমণের প্রেক্ষাপটটা কী? তা হলো জায়নবাদী আধিপত্যবাদ। জায়ন (Zion) কথার অর্থ হলো পবিত্র জেরুজালেম - যিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান। জায়নবাদ হলো ইহুদিদের একটি ভাবাদর্শ। থিওডর হের্জল ছিলেন আধুনিক জায়নবাদী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত তাঁর পুস্তিকা ডের জুডেনস্টাটে তিনি বিংশ শতাব্দীতে একটি ভবিষ্যৎ স্বতন্ত্র ইহুদি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখেন। ইহুদিদের ধর্মের সঙ্গে জায়নবাদকে সম্পৃক্ত করে ১৮৯৭ সাল থেকে জায়নবাদী আন্দোলনের সূচনা হয় ইয়োরোপে। এর লক্ষ্য স্থির করা হয় জেরুজালেম সহ সমগ্র প্যালেস্তাইনকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তারা দাবি করল প্যালেস্তাইনই ছিল সেই ভূমি যেখানে বহু শতাব্দী আগে ইহুদিরা বসবাস করত। কিন্তু এই লক্ষ্য পূরণে বাধ সাধে জনসংখ্যার বিন্যাস। ইহুদিদের তুলনায় আরব জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাধিক্য। তাই ১৯২০ সাল থেকেই ব্রিটিশ অধীনস্ত প্যালেস্তাইনের আরব জনজাতির মানুষদের জমি থেকে উৎখাত করে সেই জমিতে বলপূর্বক ইহুদি বসতি বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু হয়। এই নিয়ে দুই ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও হয় ১৯২১ ও ১৯২৮ সালে। সেই সময়ে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইহুদি ছিল ৬০ হাজার। আরব জনজাতির মানুষ ছিল ৬ লক্ষেরও বেশি। ব্রিটিশ মদতে ১৯৩৬ সালে ইহুদিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪ লক্ষ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সাল নাগাদ ব্রিটিশ-মার্কিন কর্তৃপক্ষ প্যালেস্তাইনে ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তখন ইহুদি জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ লক্ষ ৮ হাজার। উলটোদিকে আরব জনসংখ্যা ১২ লক্ষ ৬৯ হাজার। দ্বিগুণ জনসংখ্যা নিয়েও আরব জনজাতির মানুষদের সেদিন থেকেই নিজভূমে পরবাসী হবার চরম ট্রাজেডিকে মেনে নিতে হলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যের চাপে। ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আলোচনার ভিত্তিতে ১৯৪৮ সালের ১৪মে ইহুদি রাষ্ট্র হিসাবে ইজরায়েলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আর একই সঙ্গে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করে যে, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন দুটি আলাদা রাষ্ট্র হবে। কিন্তু সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল প্যালেস্তাইনের আরব জনজাতির মানুষদের ‘নাকবা’ বা মহাবিপর্যয়। কারণ সেদিন থেকেই শুরু উগ্র জায়নবাদী আগ্রাসনের নির্মম পীড়নে আরব জনজাতির নিষ্পেষিত হওয়া। সেদিন থেকেই নিজভূমে পরবাসী হয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে প্যালেস্তিনীয়রা। আজ পর্যন্ত ইজরায়েল তাদের চূড়ান্ত সীমানা নির্ধারণ করে নি। প্রতিনিয়তই চলছে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে নারীঘাতী, শিশুঘাতী ইজরায়েলের বর্বর আগ্রাসন ও দখলদারি। ইতিমধ্যে সেদেশে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর অতি দক্ষিণপন্থী সরকারের ক্ষমতাসীন হবার ঘটনায় বর্বরতার চেহারা আরও বহুমাত্রায় বেড়ে গেছে।
১৯৪৮ সালে ইজরায়েল গঠনের পরবর্তী বছরগুলিতে মার্কিন মদতে ইজরায়েল তুমুল বিক্রমে প্যালেস্তাইন তথা আরব জনজাতি অধুষ্যিত ভূখণ্ডে বারবার হামলা চালিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে। এই সময়ে ঘটেছে একের পর এক যুদ্ধ। ১৯৪৮ সালে আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ, ১৯৫১ সালে সুয়েজ খালকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ, ১৯৬৭ সালে মিশর ও সিরিয়ার সঙ্গে ইজরায়েলের যুদ্ধ। এই যুদ্ধগুলির পরিণতিতে কয়েক লক্ষ প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তু হলো। ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর নামে প্যালেস্তাইনের পাশে থেকে অন্য আরব দেশগুলির লড়াইয়ে অংশগ্রহণ তারপরে আর ঘটেনি। কারণটা অবশ্যই ‘পেট্রো ডলার’-এর প্রভাব। অর্থাৎ মার্কিন দেশকে চটিয়ে আরব দুনিয়ার অমূল্য সম্পদ পেট্রোলিয়ামের বিনিময়ে অর্জিত বিপুল পরিমাণ মার্কিন ডলারের পুঞ্জিভবনে তৈরি অর্থ ভাণ্ডার হারাতে চায় নি তারা। ইতিমধ্যেই ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে ১৯৬৪ সালে গঠিত হলো ‘প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পিএলও)। ১৯৮৮ সালের ১৫ নভেম্বর আলজিয়ার্সে ৪০টি দেশের স্বীকৃতিতে আরাফতের স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র ঘোষণা। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় ‘অসলো’ চুক্তির মধ্য দিয়ে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের সহাবস্থানের ঘোষণা স্বাক্ষরিত হলো। গঠিত হয় ‘প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি’ (পিএনএ)। আরাফত ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতারা প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকৃত হয়। সেই সময়েই অপেক্ষাকৃত উদার মনোভাবের তৎকালীন ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন জায়নবাদী উগ্রপন্থীদের হাতে খুন হয়ে যান। দক্ষিণপন্থী উগ্রপন্থীরা ‘অসলো’ চুক্তির মর্মবস্তুকে মেনে নিতে পারেনি। যাইহোক, বিশ্ব জনমতের চাপে ইজরায়েল গাজা ও জর্ডন নদীর পশ্চিম প্রান্তে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ভূখণ্ডের ওপর প্যালেস্তিনীয়দের সীমিত স্বাধিকার মেনে নেয়। ১৯৯৬ সালে আরাফত প্যালেস্তাইনের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন।
২০০৪ সালে ইয়াসের আরাফতের জীবনাবসান হয়। ২০০৬ সালে বিপুল জনউন্মাদনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ‘প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি’র নির্বাচন। এই নির্বাচনে আরাফত প্রতিষ্ঠিত ফাতাহ্ পার্টিকে পরাস্ত করে জয়লাভ অর্জন করে হামাস গোষ্ঠী। ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতা ব্রিটিশ-মার্কিন কর্তারা হামাসকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করে এই সরকারকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। কিন্তু ইজরায়েল যে শতগুণ বেশি সন্ত্রাসবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ সে কথা চাপা পড়ে যায়। ফলে প্যালেস্তাইন পরিস্থিতি আবার ঘোরালো হয়ে ওঠে।
হামাস কি সত্যিই সন্ত্রাসবাদী? এর উত্তরে বলা যায় যে, হামাস কট্টরবাদী সংগঠন, তারা প্যালেস্তাইনের বুকে ইহুদি রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে এবং তাদের দাবি পশ্চিমে ভূমধ্য সাগর থেকে পূর্বে জর্ডন নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এক এবং একমাত্র প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠন। পরবর্তী সময়ে প্যালেস্তাইনের দুই প্রধান শক্তি হামাস ও ফাতাহ্ নিজেদের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে বোঝাপড়া করে যথাক্রমে গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ও নিজেদের দপ্তর স্থাপন করে। ২০০৮ সাল থেকে ইজরায়েল হামাসকে উৎখাত করার লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে গাজা আক্রমণ শুরু করে। বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের বারংবার আক্রমণে বিগত বছরগুলিতে নারী-শিশু সহ কয়েকশ’ প্যালেস্তিনীয় মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে ইজরায়েল। উদ্বাস্তু করেছে আরও কয়েকগুণ বেশি মানুষকে। এমনকী ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও তারা আগ্রাসন চালিয়ে ইহুদি বসতি বিস্তার ও গুন্ডামি করে চলেছে। রাষ্ট্রসংঘের সিদ্ধান্তও তারা মানছে না। এইভাবে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত চলছে কখনও সংঘর্ষ, কখনও সংঘর্ষ বিরতি।
বছরের পর বছর নিজেদের দেশের মাটি থেকে উৎখাত হওয়া অত্যাচারিত, আক্রান্ত প্যালেস্তিনীয়রা গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে সীমাবদ্ধ হয়েও ইজরায়েলের আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। পূর্ব জেরুজালেমে তাদের রাজধানী করার দাবিতেও কর্ণপাত করেনি ইজরায়েল ও তাদের মদতদাতারা। বরং উলটে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরিত করা হয়েছে। এমতাবস্থায় একান্ত নিরুপায় হয়েই হামাসকে হঠকারী আক্রমণের পথে যেতে হয়েছে। যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু দখলদার ইজরায়েলের কাছে ৭৫ বছর ধরে মার খেয়ে তাদের সামনে রাস্তা কী ছিল? আর এই সুযোগে তাদের পুরোপুরি সন্ত্রাসবাদী দেগে দিয়ে বীভৎস প্রতি আক্রমণে গাজাকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে মহাপরাক্রমশালী ইজরায়েল তাদের ইঙ্গ-মার্কিন প্রভুদের অস্ত্র সাহায্যে। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতো রেস-এর সাম্প্রতিক বিবৃতিতেও এই ঘটনারই প্রতিফলন দেখা গেছে - ‘‘৭ অক্টোবরের ঘটনা শূন্য থেকে ঘটেনি। ৫৬ বছর ধরে প্যালেস্তিনীয়দের বঞ্চনার ফলেই এমন হয়েছে।’’ তিনি ১৯৬৭ থেকে পরবর্তী সময় পর্বটি ধরে এই মন্তব্য করেছেন। কারণ ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইনের মধ্যে সীমানা নিয়ে সমঝোতা হয়েছিল। বর্তমান সময়ে ইজরায়েলের নারকীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াজুড়ে জনমত সোচ্চার। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংঘটিত হচ্ছে প্রতিবাদ। খোদ মার্কিন মুলুক সহ চেকোস্লোভাকিয়া, পর্তুগাল, মরক্কো, গ্রিস প্রভৃতি দেশে অসংখ্য নরনারী প্রতিবাদে শামিল। কিন্তু আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সংসদে বা কোথাও কোনো আলোচনা ছাড়াই নির্লজ্জভাবে ইজরায়েলের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর পাশে থাকার ঘোষণা করেছেন। ভারতের স্বাধীন বিদেশনীতিকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন আমাদের দীর্ঘদিনের মিত্র প্যালেস্তাইনকে দূরে ঠেলে দিয়ে। ভারত সরকারেরই তো দায়িত্ব ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে দুই দেশের বিরোধ মীমাংসায় উদ্যোগী হওয়া! তা না করে নরেন্দ্র মোদির বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বর্বরতার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন, এমনকী রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাবে ভোট না দেওয়া আসলে দু’জনের মতাদর্শগত নৈকট্যের প্রমাণ। জায়নবাদীদের সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের মিল রয়েছে। ইজরায়েলের জায়নবাদীরা প্যালেস্তাইন বিরোধী, আরব বিরোধী, মুসলিম বিরোধী। কেবল তাই নয়, তারা খ্রিস্টানদেরও নির্মূল করতে চায়। এইখানেই ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে তাদের মিল। কারণ ভারতের হিন্দুত্ববাদীরাও মুসলিম ও খ্রিস্টানদের এই দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চায় অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখতে চায়। তাই তো হিন্দুত্ববাদী নেতা সাভারকর মন্তব্য করেছিলেন, কীভাবে মুসলিমদের মোকাবিলা করতে হয় ইজরায়েলের কাছে শেখা উচিত। জায়নবাদীরা মনে করে প্যালেস্তাইনের মাটিতে ইসলামের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো প্যালেস্তাইনের জেরুজালেমে খ্রিস্টান, ইসলাম ও ইহুদি ধর্মের সব ধারা এসে মিশেছিল।
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দম্ভভরে ঘোষণা করেছেন গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক সহ সমগ্র প্যালেস্তাইনকে ইজরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করে ‘বৃহত্তর ইজরায়েল’ গঠন করা ও পশ্চিম এশিয়ার মানচিত্র বদলে দেবার। এই দম্ভের পিছনের শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ইয়োরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলি। ইতিমধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক ইজরায়েল সফরে এসে নেতানিয়াহুকে আশকারা দিয়ে গেছেন। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিপরীতে তাদের আনা ‘ইজরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার’ স্বীকার করে কিছুক্ষণের জন্য সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাব ভোটাভুটির আগেই আটকে দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। প্রসঙ্গত, ১৯৫৪ সাল থেকে ইজরায়েলের পক্ষে ৩৪ বার ভেটো দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর লেবানন ও সিরিয়ার গোলাম হাইটস্-এ ইজরায়েলের দখলদারির পক্ষে দেওয়া ভেটো ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৬ বার। আসলে মাটির তলায় বিপুল তৈল ভাণ্ডার সমৃদ্ধ আরব দেশগুলির ওপর কর্তৃত্ব ও নজরদারির স্বার্থে ইজরায়েলকে প্রহরীর ভূমিকায় মোতায়েন রাখার জন্যই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সহ পশ্চিমের দেশগুলির ইজরায়েলের প্রতি এই নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব। কিন্তু প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে - এই কথাকে সত্য প্রমাণিত করে আরব দেশগুলির বিদেশমন্ত্রীরা এক যৌথ বিবৃতিতে গাজার নাগরিকদের ওপর আক্রমণ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের নিন্দা করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, গাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। আত্মরক্ষার অধিকারের অর্থ এই নয় যে, আইন লঙ্ঘন ও প্যালেস্তিনীয়দের অধিকার লঙ্ঘন করা যাবে। দেশগুলির মধ্যে রয়েছে বাহরিন, মিশর, জর্ডন, কুয়েত, মরক্কো, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি।
নিরীহ মানুষের মৃত্যুমিছিল বন্ধ করতে বিশ্বজুড়ে জনমত সংগঠিত হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নতুন করে যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাইছে পশ্চিম এশিয়া জুড়ে। বিশ্ব শান্তি পরিষদ (ডব্লিউপিসি) দাবি জানিয়েছে রাষ্ট্রসংঘকে বলিষ্ঠতার সঙ্গে প্যালেস্তাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করতে হবে এবং সাম্প্রতিক হিংসা ও সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে শান্তি স্থাপনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। এই প্রক্রিয়ার ভিত্তিবর্ষ হবে ১৯৬৭ সাল। ওই বছর পর্যন্ত দুই দেশের সীমানা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফেরানোর শর্তে যাবতীয় আলাপ-আলোচনা সংঘটিত হোক। এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য কয়েকবছর আগে রাষ্ট্রসংঘে প্রদত্ত প্যালেস্তাইনের রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মালকির ভাষণ - ‘‘জেরুজালেম বিক্রির জন্য নয়। আমাদের শিকড় গভীরে। জেরুজালেম থেকেই যুদ্ধ ও শান্তি তৈরি হয়। প্যালেস্তাইনের স্বাধীনতাই শান্তির একমাত্র পথ।’’
তাই এই মুহূর্তে প্যালেস্তাইনকে স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াই শান্তির একমাত্র পথ।