প্যালেস্তাইনের প্রতি সংহতি আর ইজরায়েলকে ধিক্কার জানাচ্ছেন নানা দেশের মানুষ
অর্ণব ভট্টাচার্য
ইজরায়েলের দখলদারি ও ভয়ংকর হামলার বিরুদ্ধে বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে। ইজরায়েলের ভয়ংকর হামলার শিকার প্যালেস্তাইনের মানুষ আজ একা নন। বিশ্বের দেশে দেশে অগণিত মানুষ তাদের পাশে আছেন, ইজরায়েলের নারকীয় হানাদারির বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। বিশেষ করে গাজার আল আহলি হাসপাতালে ইজরায়েল বোমাবর্ষণ করে শত শত শিশু হত্যার পর এই প্রতিবাদ তীব্রতর হয়েছে। জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ মানুষ। মরক্কো, বাহরিনের রাস্তায় যেমন প্যালেস্তাইনের মানুষের সমর্থনে জনতা পথে নেমেছেন, তেমনই বিক্ষোভ হয়েছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া সহ বিভিন্ন দেশে। গাজার হাসপাতালে ইজরায়েলি হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে তেহরানেও।
ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় ইজরায়েলের নারকীয় হানাদারির বিরুদ্ধে বহু মানুষ রাজপথে নেমে সরব হন। সেখানকার মার্কিন দূতাবাসের বাইরে হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতিকৃতি ও ইজরায়েলি পতাকা পোড়ান।
দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে প্যালেস্তাইনের পতাকা হাতে নিয়ে ইজরায়েল বিরোধী বিক্ষোভ করেন বহু মানুষ। স্লোগান ওঠে ‘ইজরায়েল গণহত্যা বন্ধ করো’। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে মার্কিন দূতাবাসের বাইরে বিক্ষোভ দেখান বহু মানুষ। বিক্ষোভকারীরা ইজরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগের ছবি এবং সেদেশের পতাকা পোড়ান।
লেবাননে প্যালেস্তাইনের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বেইরুতের তারিক আল-জাদিদা এলাকায় বিক্ষোভ করেন হাজারো মানুষ। প্যালেস্তাইনের শিশুদের রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবি নিয়ে অনেক নারী অংশ নেন। ইজরায়েলি আগ্রাসন বন্ধের দাবিতে বিক্ষোভ হয়েছে ইয়েমেনে। এতে অংশ নেন কয়েক লাখ মানুষ। ইজরায়েল যুদ্ধ নয়, গণহত্যা চালাচ্ছে - এই অভিযোগ তুলে অবিলম্বে গাজায় হামলা বন্ধের আহ্বান জানায় তিউনিশিয়ার হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা। গাজায় নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বিক্ষোভকারীরা ভাঙচুর চালালে তাদের দমন করতে টিয়ারগ্যাস ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। ইজরায়েলি দূতাবাস লক্ষ্য করে আতশবাজি ছোড়ে বিক্ষুব্ধরা। কলম্বিয়ার রাজধানীতেও বিক্ষোভে নামে কয়েক হাজার মানুষ।
এমনকী খোদ মার্কিন মুলুকে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে হাজার হাজার মানুষ প্যালেস্তিনীয়দের ‘‘প্রতিরোধ’’কে সমর্থন ও ইজরায়েলকে ধিক্কার জানিয়ে প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হয়েছেন। গত তিন সপ্তাহ ধরেই নিউ ইয়র্কে ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছে। ‘টাইমস অফ ইজরায়েল’ পত্রিকায় অভিযোগের সুরে মন্তব্য করা হয়েছে যে, ইজরায়েলের বামপন্থীরা এই সমস্ত বিক্ষোভের মূল উদ্যোক্তা। ম্যানহাটানে প্যালেস্তাইনের প্রতি ইজরায়েল সরকারের চরম অমানবিক ও হিংসাত্মক নীতির বিরুদ্ধে এক বিশাল বিক্ষোভ চলাকালীন পুলিশ কয়েকশো মানুষকে গ্রেপ্তার করে। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে বিরাট সংখ্যক নিউ ইয়র্কবাসী ইহুদি ছিলেন, যাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হন।
স্পেনের মাদ্রিদেও হাজার হাজার জনতা ‘ফ্রি প্যালেস্তাইন’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নামেন। ইজরায়েল বিরোধী বিক্ষোভে আলোড়িত হয়েছে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের রাজপথ। গ্রিসের কমিউনিস্ট পার্টি কেকেই’র নেতৃত্ব, কর্মীরা সহ হাজার হাজার সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ মিছিলে শামিল হন এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্যালেস্তাইন-ইজরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে গ্রিসের সরকারের ভোটদান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই মিছিলে প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির রাষ্ট্রদূত ইউসুফ দোরচম শামিল হন। ফ্রান্সে সরকার প্যালেস্তাইনের সপক্ষে সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও ইজরায়েলকে ধিক্কার জানিয়ে লিয়ঁ, মার্সেই শহরে পথে নামেন। একইভাবে সুইৎজারল্যান্ড ও পোল্যান্ডে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের অবসানের দাবি জানিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ সংগঠিত হয়েছে।
তবে গাজায় গণহত্যাকারী ইজরায়েলকে ধিক্কার জানিয়ে সর্ববৃহৎ মিছিল ও সমাবেশগুলি অনুষ্ঠিত হচ্ছে লন্ডনে। একের পর এক বিক্ষোভ সমাবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের ইজরায়েল তোষণ, ইজরায়েলকে সামরিক সাহায্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সরকারি নীতি পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন। শান্তিকামী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জনতা ধিক্কার জানাচ্ছে লেবার পার্টির বর্তমান নেতৃত্বকেও যারা ব্রিটিশ সরকারের অমানবিক নীতিকে সমর্থন করছেন। এই যুদ্ধবিরোধী এবং প্যালেস্তাইনের মুক্তির দাবিতে সংগঠিত সমাবেশগুলির কয়েকটিতে লেবার পার্টির প্রাক্তন সর্বোচ্চ নেতা জেরেমি করবিন দখলদার ইজরায়েলের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন। করবিনকে ইহুদি বিদ্বেষী বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রয়াসের বিরোধিতা করেছে বিভিন্ন বামপন্থী ইহুদি সংগঠন এবং তারা সক্রিয়ভাবে প্যালেস্তাইনের পক্ষে সমাবেশে অংশগ্রহণ করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবী জানাচ্ছে। আমাদের দেশেও নানা স্থানে শান্তিকামী মানুষ, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও সংগঠনের কর্মীরা প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলের বর্বর হামলার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন।
এদিকে এখনও পর্যন্ত ইজরায়েলের আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৮৪০০ প্যালেস্তিনীয়র যার মধ্যে তিন হাজারেরও বেশি শিশু। প্যালেস্তাইনের উদ্বাস্তুদের ত্রাণ ও উন্নয়নের জন্য গঠিত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সংস্থা UNRWA-র প্রধান ফিলিপ লাজারিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে জানিয়েছেন যে, গাজায় ইজরায়েল ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে অভূতপূর্ব ধ্বংস ঘটিয়েছে। তা সত্ত্বেও ইজরায়েল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পূর্ণ সমর্থন পুষ্ট হয়ে প্যালেস্তাইনের ওপর হামলা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পক্ষে যে প্রস্তাব পাশ হয়েছে তাকে বলবৎ করার জন্য বিশ্বজুড়ে জনমত সংগঠিত হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। প্যালেস্তাইনের মুক্তি এবং ইজরায়েলের চরম হিংস্র আক্রমণ ও দখলদারির বিরুদ্ধে নানা দেশে সংগঠিত বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশগুলি সেই লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।