চিলি - নয়া ইতিহাসের সূচনা
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
দক্ষিণ আমেরিকার অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ চিলিতে গণভোটে জনতা সম্মতি দিল সংবিধান বদলের। স্বৈরাচারী শাসক জেনারেল অগাস্টো পিনোচেত-এর সামরিক জমানায় যে বৈষম্যে ভরা সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৯৮০ সালে, তা বদলে দেবার দাবিতে বছরব্যাপী গণআন্দোলন সাফল্য পেল প্রথম ধাপে। নতুন সংবিধান পেতে অবশ্য আরও বছর দু’য়েক অপেক্ষা করতে হবে চিলিকে। লাতিন আমেরিকার নয়া-উদারবাদের সফল পরীক্ষাগার এই দেশে দক্ষিণপন্থী শাসকদলের জমানায় এমন বেআক্কেলে ঘটনায় বেকুব পুঁজিবাদের ভাই-বেরাদাররা। ২৫ অক্টোবর গৃহীত গণভোটে এই সংবিধান পাল্টানোর রায় কার্যত দক্ষিণপন্থী শাসনের উল্টো গুনতি শুরু করে দিয়েছে বলেই পর্যবেক্ষণ পুঁজিবাদের থানে নিয়মিত ফুল চড়াতে অভ্যস্ত সংবাদমাধ্যমের গরিষ্ঠ অংশের। কমিউনিস্ট-সহ প্রগতিশীলদের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরিতে সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মঞ্চকেই বেছে নিয়েছেন চিলির জনগণ।
কী ছিল পিনোচেত জমানার ওই সংবিধানে যা কার্যত মুমূর্ষু নয়া-উদারবাদের ডানা ছেঁটে দিল? জেনারেল পিনোচেত-এর স্যাঙাত জাইমে গুজমেন এই সংবিধান তৈরি করেছিলেন ৩০ বছর আগে ১৯৮০ সালে। যা ১৯৯০ সালে সামরিক জমানা শেষ হবার পরেও দক্ষিণপন্থী শাসকরাও বিনা প্রশ্নে চালিয়েছে এ পর্যন্ত। ওই সংবিধানে মানুষের বিভিন্ন মৌলিক এবং সামাজিক অধিকার রক্ষার নামগন্ধ নেই, অধিকার সংকুচিত বিশেষত আদিবাসী অংশের মানুষের। বিভিন্ন আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের অংশগ্রহণ একেবারেই নেই তাই সামাজিক দায় বহন করবার ‘সুযোগ’ নেই সরকারের। জীবন-জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে খরচ বড্ড বেশি। রমরমা বেসরকারিকরণের। পেনশন, কাজের অধিকার, উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা সবকিছুই চরম উপেক্ষিত। অসহনীয় চিলির ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশের জীবনধারণ। এইসব না পাওয়া দাবিগুলির সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি জুড়ে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকেই নয়া সংবিধানের দাবিতে সংগঠিতভাবে গড়ে ওঠে গণ আন্দোলন। আন্দোলন দমাতে সেনা নামিয়েও শেষরক্ষা হয়নি রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরার। তবু জরুরি অবস্থার ভ্রূকুটি উড়িয়ে এক রাজধানী সান্তিয়াগোতেই রাজপথে নামেন ১২ লক্ষ মানুষ। বাকি দেশে রাস্তায় আরও ৮ লক্ষ। অগত্যা গণভোটের দাবিতে সায় দিতে বাধ্য হন পিনোচেতের উত্তরসূরি।
আন্দোলন শুরু হয় তিরিশ পেসো মেট্রো ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবরে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের তরুণ এবং শ্রমজীবী সহ গরিষ্ঠ অংশের মানুষ তাতে শামিল হন। তারপর মজুরি বৃদ্ধি, সহ সব জ্বলন্ত সমস্যা সংক্রান্ত দাবিদাওয়াগুলি সওয়ার হয় নয়া সংবিধানের দাবিতে গণ আন্দোলনের বহমান ধারায়। এই প্রেক্ষিতেই দেশের ভোটারদের প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অর্থাৎ, সাড়ে সাত মিলিয়ন ভোটার প্রয়োগ করেছেন ভোটাধিকার।
চিলির বৈষম্যের ছবি স্পষ্ট সম্পদের মেরুকরণের প্রবণতা থেকে। মুষ্টিমেয় এক শতাংশের হাতে রয়েছে দেশের সম্পদের ২৬.৫ শতাংশ, আর ১০ শতাংশের হাতে ৬৬.৫ শতাংশ। বিপরীতে, হতদরিদ্র ৫০ শতাংশের মাত্র ২.১ শতাংশ। জিডিপি বৃদ্ধির হার গত বছর ছিল ১.১ শতাংশ, যেখানে বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির মুনাফা বেড়েছে ১০-গুণের বেশি। যে চিলিতে গড় মাথাপিছু আয় বছরে ২৫ হাজার ডলার, সেখানে অর্ধেক শ্রমিকের বেতন মাসে ৫৫০ ডলারের কম। কী কারণে এই প্রকট ব্যবধান, তা ধরে ফেলতে অসুবিধা হয়নি চিলির জনগণের। তাঁরা দেখেছেন, জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্য, ওষুধ, পরিবহণ, শিক্ষার দেদার বেসরকারিকরণ। এমনকি হিমবাহেরও বেসরকারিকরণ!
এই মেরুকরণের স্বাভাবিক পরিণতিতেই অবাধ্যতার ঢেউ ওঠে চিলির রাস্তাজুড়ে। রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরা সেসব রুখতে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন, রাস্তায় সেনা নামিয়েছেন। তবু সাধারণ মানুষ থেকেছেন অনড়। প্রতিদিন বিক্ষোভের আয়তন বেড়েছে আর চড়েছে প্রতিরোধের মেজাজ। মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্টে প্রকাশ, সরকারের সেনা লেলিয়ে দেবার পরিণতিতে নিহত ২০, জখম ১,১৩২, আটক ৩,৫৩৫ জন। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো, আটক থাকার সময় সশস্ত্রবাহিনীর হাতে অত্যাচারিত হয়েছে ৪৩টি শিশু। ঘটেছে যৌন হিংসার ঘটনা, এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত।
মেট্রোর ভাড়া পিনেরা ৩.৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেবার পর গত বছরের ১৮ অক্টোবর, সান্তিয়াগোর মেট্রোরেলের ১৪৬টি স্টেশনের ঝাঁপ বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। স্বতঃস্ফূর্ত এই প্রতিবাদ থেকেই সরকারের উদারনীতির বিরুদ্ধে রোখা মেজাজে দেশজোড়া মানুষ পথে। জেনারেল পিনোচেতের স্বৈরাচারী জমানার পর এই প্রথম। ১৯৮৩ সালে পিনোচেত রাস্তায় নামিয়েছিলেন ১৮ হাজার সেনা। সাঁজোয়া গাড়ি সহ ৯,৫০০ সেনা রাস্তায় নামিয়ে এবারে পিনেরা জারি করেন কারফিউ। প্রসঙ্গত, সান্তিয়াগোতে শেষবার কারফিউ জারি করা হয়েছিল ১৯৮৭-তে। অবস্থা বেগতিক বুঝে ১৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি পিনেরা টেলিভিশন ভাষণে বলেন, ‘আমি দেশবাসীর কণ্ঠস্বর শুনেছি।’ ভাড়াবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখেন তিনি। আশ্বাস দেন, ‘আমি জনগণের কথা শুনব, তবে আগে প্রতিবাদ থামাতে হবে।’ জনগণ স্রেফ পাত্তা দেয়নি তাঁর এই ঘুরিয়ে হুমকি দেওয়াকে। ওয়ার্কার্স ইউনাইটেড সেন্টার বা সিইউটি-সহ বাইশটি সংগঠনের ডাকে ২৩ ও ২৪ অক্টোবর ৪৮ঘণ্টার সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘটে স্তব্ধ হয় চিলি। ধর্মঘটের প্রথম দিনে এক বিবৃতিতে চিলির কমিউনিস্ট পার্টি অবিলম্বে জরুরি অবস্থার অবসানের এবং বর্বর দমনপীড়ন বন্ধ করার দাবি জানায়।
তবু অসহিষ্ণু প্রশাসন বেয়নেট উঁচিয়ে রাখে। রাষ্ট্রপতির চোখরাঙানি উড়িয়ে ২৫ অক্টোবর পিনেরাকে কটাক্ষ করে ‘আমরা এখন যুদ্ধে!’ প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নামেন লক্ষ-লক্ষ মানুষ। অভূতপূর্ব এই সমাবেশ দেখে বিশিষ্ট মার্কিন মুক্তচিন্তক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, গত চারদশক ধরে যে নয়া-উদারবাদের আস্ফালন চলছে, তাতে এই পরিণতি প্রত্যাশিতই ছিল।
প্রতিবাদে শামিল হয় সিইউটি সহ ছাত্র, নারীবাদী এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা। স্লোগান ওঠে, নিছক ‘৩০-পেসো নয়, ৩০-বছরের অসাম্যের অবসান।’ তাঁরা চান রাষ্ট্রপতি পিনেরার অবিলম্বে পদত্যাগ। তাঁরা চান নয়া-উদারবাদের বিকল্পনীতিবাহী একটি নতুন সরকার। তাঁরা চান মজুরিবৃদ্ধি এবং ৪৫ নয়, সপ্তাহে ৪০-ঘণ্টা কাজ। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, যৌথ দর কষাকষির নিশ্চয়তা, নাগরিক পরিষেবাসহ স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। বেসরকারি পেনশন তহবিলের অবসান। ছাত্রদের ঋণমকুব। জলের কর ব্যবস্থার অবসান। চান প্রগতিশীল কর-কাঠামোর পাশাপাশি একটি নয়া অভিবাসী নীতি।
তবে নতুন সংবিধান চাই এই দাবি প্রতিষ্ঠা পেলেও সেই নয়া সংবিধান নির্মাণের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের নির্বাচিত হতে হবে জনপ্রতিনিধি হিসেবে, যা ২০২১-এ সম্ভব। জানা গেছে, ওই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তার পরেও এক বছর ধরে খসড়া সংবিধান তৈরি করবেন। যা গৃহীত হবার জন্য আবার গণভোট হবে। অর্থাৎ চিলির সাধারণ মানুষের অপেক্ষার অবসান হবে ২০২২ সালে।
২০২০ সালের বসন্তে অর্থাৎ এপ্রিল মাসেই প্রথমে গণভোট হবার কথা ছিল। কোভিড ১৯ মহামারীর কারণে তা পিছিয়ে যায়। সংক্রমণ এড়াতে চিলির প্রশাসন ভোটারদের প্রত্যেককে নিজেদের পেন নিয়ে আসতে বলেন ভোটকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য। পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ চিলির জনগণ নিজেদের পেন ব্যবহার করেই লিখলেন নয়া ইতিহাস। বিলম্বিত বসন্ত অবশেষে মূর্ত হলো তাঁদের বিজয় উৎসবে। সেখান থেকে তাঁরা বার্তা দিয়েছেন পিনোচেতের উদ্দেশ্যেও। প্রতীকি সেই বার্তায় তাঁরা বলেছেন, ‘গুড বাই জেনারেল! ইরেজিং ইওর লিগ্যাসি ইজ আওয়ার লিগ্যাসি’। তর্জমায় যা দাঁড়ায়, বিদায় সেনাপ্রধান। তোমার উত্তরাধিকার মুছে ফেলাই হবে আমাদের উত্তরাধিকার।