E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বলিভিয়ায় বামপন্থীদের প্রত্যাবর্তন

লালন ফকির


লাতিন আমেরিকায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ বলিভিয়ার নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন ‘মুভমেন্ট ফর সোশ্যালিজম’(মাস)-এর প্রার্থী লুইস আরস। তিনি পেয়েছেন ৫৫.১০ শতাংশ ভোট। দেশের নির্বাচনী বিধি অনুযায়ী প্রথম দফার নির্বাচনে কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেলে তাকেই জয়ী ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের প্রয়োজন হয় না।

বলিভিয়ার এবারের নির্বাচনের পটভূমি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালের নির্বাচনে মাস-এর প্রার্থী ইভো মোরালেস জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু সেই ফলাফল মানতে অস্বীকার করে দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি। এর পিছনে মদত জোগায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ফলে দেশজুড়ে তৈরি হয় ব্যাপক অশান্তির আশঙ্কা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়াবার জন্য ইভো মোরালেস আবার নির্বাচন করতে রাজি হন। কিন্তু সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তাঁকে অপসারিত করা হয়। তিনি আর্জেন্টিনায় বুয়েন্স আয়ার্সে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন।

গত নির্বাচনে পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে ছিল ‘অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস’। এই সংগঠনটি নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছিল। কিন্তু এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও অভিযোগ তারা প্রমাণ করতে পারেনি। এখন তারা তা স্বীকারও করছে। ইভো মোরালেসকে সরকার গঠন করতে না দিয়ে তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো জনগণ মেনে নিতে পারে নি - এবারের নির্বাচনী ফলাফল তার প্রমাণ।

এবারের নির্বাচনে বিরোধী প্রার্থী কার্লোস মেসা ৩১.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ‘উই বিলিভ’ জোটের প্রার্থী লুইস ফার্নান্দো কামাচো পেয়েছেন ১৪.১ শতাংশ ভোট। দক্ষিণপন্থীরা এই ফলাফল মেনে নেবে কিনা বা এর বিরুদ্ধে সংঘর্ষ শুরু করবে কিনা এই আশঙ্কা রাজনৈতিক মহলে ছিল। কিন্তু নির্বাচনে মাস-এর বিপুল জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে অশান্তি তৈরি করতে তারা উৎসাহী হয়নি। এমনকি বিগত একবছর ধরে যারা বলিভিয়ায় অশান্তি সৃষ্টির মূল কারিগর ছিল সেই ‘ওএএস’ও এবারের নির্বাচনকে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বলে ঘোষণা করেছে।

বিরোধীদের অভ্যুত্থানের পর যিনি অন্তর্বর্তী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সেই জেনিন অ্যানেজ এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস পাননি। তিনিও ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর লুইস আরসের জয়কে স্বীকার করে নিয়েছেন। আর্জেন্টিনা থেকে ইভো মোরালেস জয়ের সংবাদ জানিয়ে বলেছেনঃ “আমরা আমাদের আত্মা ফিরে পেয়েছি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি, সর্বোপরি আশার পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছি। সমস্ত বলিভিয়ানের জন্য সরকার চালাব আমরা। দেশকে ঐক্যবদ্ধ করব।’’ ইভো মোরালেস ২০০৬ সাল থেকে বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন ছিলেন। বলিভিয়ার আদি অধিবাসী জনগোষ্ঠী থেকে তিনি ছিলেন প্রথম রাষ্ট্রপতি। তিনি যেহেতু দেশের শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ মানুষের নেতা ছিলেন সেজন্য তিনি দেশকে বাম অভিমুখী নীতিতে পরিচালনায় সক্ষম হয়েছিলেন। বলিভিয়ায় ইভো মোরালেসের এইসব সিদ্ধান্তে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এসবের মধ্যে দিয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার খিড়কি দুয়ার বলে পরিচিত লাতিন আমেরিকায় বেশ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন দেশে এই ধরনের সরকারগুলির পরিবর্তন ঘটাতে তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইকুয়েডরে লেনিন মারানো, আর্জেন্টিনায় মেরিসো ম্যাক্রি, ব্রাজিলের জাইর বলসোনারো ক্ষমতাসীন হওয়ায় এই ধারা কিছুটা ভিন্নমুখী হয়ে পড়ে। কোনো কোনো মহল থেকে একথাও প্রচার করা শুরু হয়, লাতিন আমেরিকায় ‘বামপন্থীদের দিন শেষ’। এইসব ঘটনায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উৎসাহিত হয়। কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ জোরদার করা হয় এবং ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কঠোর হয়।

বলিভিয়ায় বামপন্থী সরকারের পরিবর্তন করে দক্ষিণপন্থী সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত করুণ। কারণ, ২০০৬ সাল থেকেই ইভো মোরালেস সরকারের কর্মসূচিগুলিকে দক্ষিণপন্থী সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরই পরিবর্তন করতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, অর্ধেক বলিভিয়াবাসী রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সাহায্য পেত। এতে তাদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষাপ্রদানের ব্যবস্থা করা, বয়স্কদের স্বাস্থ্য রক্ষা, শিশুমৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতিদের স্বাস্থ্যরক্ষা এবং তাদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্যকে মজবুত করা প্রভৃতি একাধিক জনকল্যাণকর বিষয়ে বলিভিয়ার অগ্রগতি ঘটেছিল। প্রবীণ নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। এই সমস্ত সিদ্ধান্তের পিছনে কিউবান ডাক্তারদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার এইসব ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। শুধু তাই নয়, কিউবার ডাক্তারদের ক্রমশ ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাদের ওপর অনেক সময় সরকার আশ্রিত গুন্ডাদের আক্রমণ হয়েছে। এরফলে চিকিৎসার অভাবে বহু মানুষ কোভিড সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন।

মোরালেস সরকারের আমলে রান্নার গ্যাস, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ক্ষেত্রে যে ভরতুকির ব্যবস্থা করা হয়েছিল, অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আসা সরকার তা বাতিল করে দেয়। এর ফলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়, বেকারির হার ৩.৯ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ১১.৮ শতাংশে পৌঁছায়। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারও ৬ শতাংশ-বিন্দু হ্রাস পায়।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, দেশের অমূল্য খনিজ সম্পদ লিথিয়ামের খনিগুলির জাতীয়করণ আটকাতে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মোরালেস সরকারের পতন ঘটানো হয়। লিথিয়াম খনির ওপর বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির দখল অব্যাহত রাখতেই এই অভ্যুত্থানের প্রয়োজন ছিল। আইএমএফ এবং মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলে মোরালেস-পরবর্তী সরকার অন্যান্য খনিগুলিরও বেসরকারিকরণ শুরু করে। বেসরকারিকরণ অভিযান দ্রুত এবং মসৃণ করতে এই সরকার গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর নির্মম আক্রমণ নামিয়ে নিয়ে আসে। এই লক্ষ্যে সামরিকবাহিনীকে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী করে তোলা হয়। সাংবাদিক, বিরোধীদল মাস-এর কর্মী-সংগঠক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপরও ব্যাপক দমনপীড়ন নামিয়ে আনা হয়। মাস-এর শক্ত ঘাঁটিগুলি বিশেষ করে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়। সরকারি তথ্য অনুযায়ী সশস্ত্রবাহিনীর আক্রমণে অন্তত ৩৬ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। সহস্রাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জনজাতিগোষ্ঠী, শ্রমিকশ্রেণি এবং দরিদ্র কৃষক সম্প্রদায়, যারা প্রধানত ইভো মোরালেস এবং মাস-এর প্রধান গণভিত্তি তারাই এই সরকারের আক্রমণের শিকার হয়েছে। দেশীয় জনগণ এবং তাদের নেতৃত্ব প্রধানত আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। তাদের পতাকা, সংস্কৃতির প্রতীক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আর এই ধ্বংসলীলার নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি অ্যানেজ।

কিন্তু বলিভিয়ার সাধারণ মানুষ এইসব অত্যাচার উৎপীড়নের বিরুদ্ধে পথে নেমে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। এই সব আন্দোলনের দাবিসনদে ছিল, গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসা সরকারের নীতির পরিবর্তন সাধন। জনগণের এই সব আন্দোলনের সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাসের নেতা-সাংসদরা। এই আন্দোলনের চাপে সরকার রাস্তা থেকে সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে পুনরায় সামরিক বাহিনীকে রাস্তায় নামালে জনগণ পুনরায় প্রতিরোধে অবতীর্ণ হয়। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে সরকার নতুন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পথে অগ্রসর হয়। এর আগে দু’বার করে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে বাতিল করা হয়, কিন্তু এবার আর তা করতে সাহস পায়নি।

বিভিন্ন জনমত সমীক্ষায় দেখা যায়, মোরালেস সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অপসারিত করা হলেও তার গণভিত্তি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি। এইসব সমীক্ষায় বলা হয়েছিল নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক না কেন, মাস পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করবে। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যম এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সাহায্যে জনমত তৈরি করার চেষ্টা করে যে, তারাই ক্ষমতায় ফিরবে। কিন্তু বলাই বাহুল্য মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। মাস যাতে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে না পারে দক্ষিণপন্থীদের পক্ষ থেকে সেই প্রচেষ্টাও হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মাস-এর প্রার্থী ছিলেন লুইস আরস এবং উপরাষ্ট্রপতিপদে প্রার্থী ছিলেন ডেভিড চোকেহুয়াঙ্কা। মোরালেস সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন লুইস আরস। তাঁর আমলেই বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কর্মসূচিগুলি গৃহীত হয়েছিল। নির্বাচনী প্রচারে মাস-এর পক্ষ থেকে এই সব কর্মসূচির উল্লেখ করে পুনরায় তা কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সমগ্র নির্বাচনী প্রচারপর্বে আরস বলেন, তারা ক্ষমতায় এসে নতুন করনীতি ঘোষণা করবেন। এই নীতির মূল বিষয় হবে, দেশের সম্পত্তিবানদের ওপর বর্ধিতহারে কর আরোপ। লিথিয়াম সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের বেসরকারিকরণ বন্ধ করা হবে। বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রগুলিকে হস্তান্তর করা হবে না। নির্বাচনী প্রচারে কিউবা, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে উন্নত সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এই সমগ্র কালপর্বে মোরালেসকে নির্বাসনে রাখলেও তিনি প্রতিনিয়তই পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছিলেন।

মাস-এর সাফল্যের প্রভাব লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পড়তে বাধ্য। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা এবং মেক্সিকোর প্রগতিশীল সরকারগুলি যে জনস্বার্থবাহী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তা রূপায়ণে এই সাফল্য বাড়তি উৎসাহ জোগাবে। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী বোলসোনারো সরকারের নীতির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছে, এই জয় তাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। ইতিমধ্যেই চিলির গণভোটে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পিনোচেতের সামরিক শাসনকালে গৃহীত কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার সংবিধান বাতিল হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বিশ্বায়নবিরোধী সংগ্রামেও এই জয় নতুন মাত্রা যুক্ত করবে। অর্থাৎ সমস্ত দিক থেকেই বলিভিয়ার নির্বাচনী ফলাফল সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যপূর্ণ এবিষয়ে সন্দেহ নেই।