E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

গভীর সংকটে পাকিস্তানের অর্থনীতি

বাদল দত্ত


পাকিস্তানে সরকারি উদ্যোগে খাদ্যদ্রব্য বিলিতে হাজার হাজার মানুষের লাইন।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সংকট সমাধানের জন্য নয়া-উদারনীতি কোনো কার্যকর ব্যবস্থা হয়ে উঠতে পারেনি। বরং মুনাফা সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্য সংকটকে আরও তীব্রতর করে তুলেছে। নয়া-উদারনীতিতে অর্থনীতি ক্রমাগত ভোগ্যপণ্য উৎপাদন থেকে আর্থিকীকরণের দিকে সরে গেছে। টাকার বিনিময়ে পণ্য নয়, টাকার বিনিময়ে টাকা রোজগারের ফাটকা কারবার প্রসারিত হচ্ছে। ১৯২৯-এর বিশ্ব মন্দার পর ২০০৮-এর বিশ্ব আর্থিক সংকটের ধাক্কা এখনও সামলানো যায়নি। এখনও ছোটো বড়ো অনেক ব্যাঙ্ক সহ আর্থিক সংস্থা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক (এসভিবি) বা সিগনেচার ব্যাঙ্কের মতো ব্যাঙ্ক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ধাক্কা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের আর্থিক ব্যবস্থায়। বিশ্ব আর্থিক সংকটের সাথে যুক্ত হয়েছে অতিমারীজনিত বিপর্যয় ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি। ফলে বেকারি, দারিদ্র্য, বৈষম্য, ক্ষুধা, বঞ্চনা বেড়েই চলেছে । এরকম এক বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারত উপমহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ পাকিস্তান গভীর আর্থিক সংকটে ডুবে যাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে পাকিস্তানের আর্থিক পরিস্থিতি ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (পিবিএস)-এর হিসেব অনুযায়ী এবছর মার্চের শেষে মূল্যস্ফীতির হার রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে হয়েছে ৩৫.৩৭ শতাংশ। আগের বছরের এই সময়ের তুলনায় তা বেড়েছে ২৭.২৬ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে বেশি। শহরে ৪৭.১ শতাংশ এবং গ্রামে ৫০.২ শতাংশ। আটা, চিনি, ভোজ্য তেলের দাম বেড়েই চলেছে। এর ফলে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে পড়েছে। অবস্থা এতটা খারাপ যে, সরকারের খাদ্যদ্রব্য বণ্টন কেন্দ্রে খাবার নিতে উপচে পড়ছে ভিড়। সম্প্রতি একটি সরকারি খাদ্য বণ্টন কেন্দ্রে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন অন্তত ১৬ জন মানুষ। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে আর্থিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সুদের হার বৃদ্ধি, অত্যাবশ্যক খাদ্যপণ্যের উপরে আমদানি শুল্ক হ্রাস করার মতো পদক্ষেপ। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনো কাজ হচ্ছে না। পাকিস্তানি মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটেছে তীব্রভাবে। এক মার্কিন ডলারের মূল্য পাকিস্তান মুদ্রায় ২৮৮ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার নেমে এসেছে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা দিয়ে পাকিস্তানের এক মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে না। স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তান, ডেট পলিসি কো-অর্ডিনেশন অফিসের হিসেব অনুযায়ী ২০২২-এর মার্চে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ২৮ হাজার ৭৬ বিলিয়ন টাকা, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১৬ হাজার ২৯০ বিলিয়ন টাকা অর্থাৎ মোট ঋণের পরিমাণ ৪৪ হাজার ৩৬৬ বিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে। বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ঘাটতি ৫৫.৫ শতাংশ বেড়ে সর্বকালীন রেকর্ড ৩০.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। বিপুল পরিমাণ ঘাটতি মেটানোর জন্য পাকিস্তান আবার শরণাপন্ন হয়েছে আইএমএফ-এর। ইতিপূর্বে ১৪ বার আইএমএফ-এর দ্বারস্থ হয়েছে পাকিস্তান।

আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির স্বার্থরক্ষার্থে নয়া-উদারনীতির অভিযানকে সফল করবার জন্য আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার, বিশ্বব্যাঙ্ক ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এই ত্রয়ী একযোগে কাজ করে। বিশ্বব্যাঙ্কের মতো আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কার্যকরী পরিষদ একই নীতিতে পরিচালিত। যৌথ মূলধনী কোম্পানির মতো শেয়ারের অনুপাতে ভোট। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারে ১৯০টি সদস্য দেশের মধ্যে আমেরিকার একার শেয়ার ১৭.৪৬শতাংশ। জি-৭ ভুক্ত দেশগুলির শেয়ার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারকে নিয়ন্ত্রণ করে এরাই। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার উন্নয়নমূলক বা প্রকল্পভিত্তিক ঋণ দেয় না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেন-দেন সংকট সমাধানের জন্য সদস্য দেশগুলিকে ঋণ দেয়। ঋণের সঙ্গে থাকে অবশ্য পালনীয় একগুচ্ছ শর্ত। নয়া-উদারনীতির কর্মসূচি রূপায়ণের জন্য তৈরি গুচ্ছ কর্মসূচিকে বলা হয় কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি (স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম)। এই কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেঃ
১) বাণিজ্যের উদারিকরণ - দেশীয় শিল্পের জন্য সমস্ত রকমের সংরক্ষণ তুলে দেওয়া,
২) ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণ,
৩) সমস্ত ধরনের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প, বাণিজ্য ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ,
৪) শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি তুলে দেওয়া,
৫) মুদ্রার অবমূল্যায়ন,
৬) ভরতুকি তুলে দেওয়া,
৭) শ্রমিকদের মজুরির হ্রাস,
৮) বাজেট ঘাটতি হ্রাস,
৯) রপ্তানিমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলা,
১০) কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচির ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় তহবিল গঠন এবং
১১) নয়া-উদার অর্থনীতি গড়ে তোলার পথে সমস্ত রকমের বাধাগুলি দূর করা।

১৯৮৮ সালে পাকিস্তান এই কাঠামোগত পূনর্বিন্যাস কর্মসূচি গ্রহণ করে। তারপর বিভিন্ন সরকার ধারাবাহিকভাবে এই কর্মসূচিকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করে।সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের পর ১৯৯১ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমিয়ে আনার অভিযান চলে জোরকদমে। দু’বছরের মধ্যেই পাকিস্তান বেসরকারিকরণের কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়। ৭০ টি ইউনিট বেসরকারিকরণ করে। ১৯৯৩ সালের পর তা কিছুটা ধীরগতিতে চললেও ১৯৯৭-এর মার্চে আবার এই কর্মসূচিকে জোরদার করা হয়। গোড়ার কয়েকটি দশকে পাকিস্তানের অর্থনীতি মূলত বেসরকারি ক্ষেত্রের ওপর দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭০-এর দশকে আর্থিক পরিষেবা, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং পরিবহণের মতো ক্ষেত্রের জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে এসে সেই ক্ষেত্রগুলির বেসরকারিকরণ শুরু হয়। পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য এই কর্মসূচির গতি কখনও ধীরগতিতে কখনও বা জোরকদমে চলে। আইএমএফ এবং অন্যান্য দেশের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে সরকারি প্রচেষ্টায় সামান্য কিছু অগ্রগতি হলেও পাকিস্তানের আর্থিক পরিস্থিতির মৌলিক দুর্বলতা কাটেনি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের সময় কৃষি ছিল উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র, জাতীয় অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫৩ শতাংশ কৃষি থেকেই আসত। ১৯৪৯-৫০ সালে তা বেড়ে হয় ৫৩.২ শতাংশ। পাকিস্তানের শ্রমশক্তির ৬৫ শতাংশ নিয়োজিত ছিল কৃষিতে। কৃষি পণ্যেই হতো দেশের রপ্তানির ৯৯.২ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারের ৯০ শতাংশ আসত কৃষি থেকেই। ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে জিডিপি’র অংশ ছিল ৭.৮ শতাংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রে ছিল ৩০ শতাংশ। সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১০ শতাংশ, দারিদ্র্য সীমার নিচে ৫৫-৬০ শতাংশ। যদিও প্রাকৃতিক গ্যাস, ক্রুড ওয়েল, কয়লা, লাইমস্টোন, মার্বেল সহ খনিজ পদার্থের বিপুল ভাণ্ডার ছিল পাকিস্তানের। পাকিস্তান ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্স (পিবিএস) ও অর্থ মন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী ২০০০ সালে কৃষি, শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্রে জিডিপি-র অংশ দাঁড়ায় যথাক্রমে ২৭.০৮, ১৯.৩১ ও ৫৩.৬১ শতাংশে। ২০২২ সালে তা হয় যথাক্রমে ২২.৬৮, ১৯.১১ ও ৫৮.২৯ শতাংশ। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার ২০১৮ সালে ছিল ১.৮১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৪.৪ শতাংশ। অর্থনৈতিক এই অগ্রগতির সাথে সাথে পাকিস্তানে বৈষম্য বাড়তে থাকে। ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস-এর তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানের সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের হাতে গোটা দেশের সম্পদের এক চতুর্থাংশ, যেখানে নিচের ৫০ শতাংশের হাতে থাকে সম্পদের মাত্র ৫ শতাংশ। এখন সাক্ষরতার হার ৫৮ শতাংশ।

পাকিস্তানের বিশিষ্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মহাবুব উল হক যে ‘মানব উন্নয়ন সূচক’ তৈরি করেন, সেই সূচকে ইউএনডিপি-র মানব উন্নয়ন রিপোর্ট, ২০২২ অনুযায়ী ১৯১টি দেশের মধ্যে পাকিস্তানের স্থান ১৬১। সমস্ত ধরনের আর্থিক সূচকেই পাকিস্তান নিম্ন আয়ের উন্নয়নশীল দেশের শ্রেণিভুক্তই থেকে গেছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতার অজুহাতে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের পলিসি প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করে আর্থিক সংস্কার যথাযথ হয়নি বলে অভিযোগ করা হয়। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস কর্মসূচি বিশ্বের কোনো দেশেরই মৌলিক সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও তা হয়নি। নয়া-উদারনীতি পাকিস্তানের সংকটকে বরং আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে নিরক্ষরতার উচ্চ হার, বেকারি, দারিদ্র্য, অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি, বৈষম্য, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দ্রুত গতিতে হ্রাস পাওয়া ক্রয়ক্ষমতা, দুর্নীতি, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে বৈরিতা, বৈদেশিক ঋণের বিপুল বোঝা এবং চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা পাকিস্তানকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার ফলে জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা এমন স্তরে পৌঁছায় যে ইমরান খানের সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। বিরোধী পক্ষের নেতা শেহবাজ শরিফ নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পরেও পাকিস্তান সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। বরং সংকট ক্রমশ গভীরতর হচ্ছে।

পাকিস্তানের আর্থিক সংকট চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী একমাত্র উদারীকরণের মধ্যে দিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রায় একইসময়ে উদারনীতির পথ অনুসরণ করা সত্ত্বেও পৃথক পৃথক ফলাফল এসেছে বিভিন্ন দেশের। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতির মাধ্যমে মৌলিক মানবসম্পদ বিকাশের কাজ স্থগিত রেখে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মাধ্যমে উন্নয়নের কৌশল ফলপ্রসূ হয়নি। উন্নত মানবসম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ভোগব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি না করে বিনিয়োগকে আকৃষ্ট করাও কঠিন। পাকিস্তানের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জনগণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মৌলিক প্রশ্নগুলিকে পিছনে ফেলে নয়া উদারনীতির পথ ধরে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও উন্নয়নের প্রচেষ্টা দুষ্টচক্রের আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াকেই অবশ্যম্ভাবী করে তুলছে।