E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বামমুখী লাতিন আমেরিকা

শান্তনু দে


মার্কিন মদতে, উগ্র দক্ষিণপন্থীদের সমর্থনে যে চিলি (১৯৭৩), পেরু (১৯৯২), হন্ডুরাস (২০০৯) এবং বলিভিয়া (২০১৯) একসময় সেনা অভ্যুত্থানের সাক্ষী, এখন সেখানে ক্ষমতায় বামপন্থীরা।

গত দশকের গোড়ায় লাতিন আমেরিকা জুড়ে ‘গোলাপী স্রোতে’র যে উত্থান দেখা গিয়েছিল, তার ফিরে আসার লক্ষণ স্পষ্ট। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলি দেখেছে বামপন্থীদের তাক লাগিয়ে দেওয়া জয়। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষকের বৃহত্তর জোট, আর শহরের গরির-মধ্যবিত্তের তুমুল লড়াই-সংগ্রাম থেকে এসেছে একের পর এক এই তাৎপর্যপূর্ণ জয়। বর্ষশেষে ওয়াশিংট পোস্টের মতো পত্রিকাও তাদের ‘আজকের বিশ্ববীক্ষা’য় দেখেছে এই শতকের প্রথম দশকের ‘গোলাপী স্রোতে’র ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। সংবাদ সংস্থা এএফপি’র শিরোনামঃ ‘লাতিন আমেরিকার ভোটারদের চাহিদা হলো পরিবর্তন’।

ডাচ বহুজাতিক ব্যাঙ্ক আইএনজি’র গবেষণাপত্রের অকপট বিশ্লেষণঃ ‘২০২১ সালে, লাতিন আমেরিকার রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেখেছে বামপন্থার প্রতি এক নির্ণায়ক পরিবর্তন।’ কলম্বিয়া এবং ব্রাজিলের নির্বাচনের কথা মনে রেখে সঙ্গে ২০২২ সালের জন্য পূর্বাভাস, ‘এটি হতে চলেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বছর’ এবং ‘হারতে চলেছে শাসক দক্ষিণপন্থী দলগুলি’।

২০২১। মাসতিনেক আগে বলিভিয়ার জয়ের উত্তাপ দিয়ে বছরের শুরু। সেনা অভ্যুত্থান থেকে গণ অভ্যুত্থান। প্রতি চব্বিশ ঘণ্টায় চোয়ালচাপা লড়াই। শেষে এক দুর্দান্ত জয়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বলিভিয়া ফিরেছে বামপন্থায়। সেদিন এই জয় শুধু বলিভিয়ার জন্য নয়, গোটা লাতিন আমেরিকার জন্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একইসঙ্গে, এই অঞ্চলে উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থানের সাম্প্রতিক প্রবণতার জন্য এক বড়ো ধাক্কা। নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে এক সপাটে আঘাত।

পেরু

বছরের মাঝে এসে জুলাইয়ে ২০০-বছরের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে এই প্রথম পেরুতে নির্বাচিত একজন বামপন্থী রাষ্ট্রপতি। এই প্রথম পেরু নির্বাচিত করে আন্দিজের প্রত্যন্ত গ্রামের এক নিরক্ষর হতদরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তানকে। গ্রামের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিও সেকারণে শুধু দেশের প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতিই নন, প্রথম কৃষক রাষ্ট্রপতি-ও। একসময় রাজধানী লিমায় কাগজ ফিরি করতেন। কখনও বিক্রি করতেন আইসক্রিম। আবার কখনও হোটেলের শৌচাগার সাফাইয়ের কাজ। কাস্তিও বলেছেন, তাঁর নতুন কৃষি বিপ্লবের অংশ হবে ভূমি সংস্কার। যা ক্ষুদ্র কৃষকের শোষণের অবসান ঘটাবে। ‘আজ থেকে সরকার হবে ক্ষুদ্র কৃষকদের, তাঁরা দখলে নেবেন সেই জমি, যেখানে তাঁদের থাকা উচিত’। সংসদে তাঁর দলের গরিষ্ঠতা না থাকার কারণে বিরোধীরা প্রথম দিন থেকেই অন্তর্ঘাতের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কাস্তিও’র সামনে তাই কঠিন চ্যালেঞ্জ। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে দর কষাকষির চ্যালেঞ্জ। ‘নতুন দেশ’ হিসেবে পেরুর পুনর্জন্মের জন্য কাস্তিওকে প্রতিদিন লড়তে হচ্ছে গেঁড়ে বসা শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রযন্ত্রে তাদের বিভিন্ন শাখার বিরুদ্ধে। লড়তে হচ্ছে মিডিয়ার একপেশে কুৎসা প্রচারের বিরুদ্ধে। কাস্তিও’র কাছে চ্যালেঞ্জ ব্যবসা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যাদের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে আতঙ্ক। রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্তারা, যাঁরা বিদ্রোহের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। এইসব চ্যালেঞ্জের মুখে কাস্তিও ও তাঁর দল নিজেদের অবস্থান অটুট রেখে কতদিন তা মোকাবিলা করতে পারবে, সেটা বলতে পারে একমাত্র ভবিষ্যৎ।

গ্যাব্রিয়েল বোরিক

হন্ডুরাস

নভেম্বরে মুক্ত হন্ডুরাস! ফিরেছে বামপন্থায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক ভোটে জয়ী বামপন্থী প্রার্থী জিয়োমারা কাস্ত্রো। দেশের প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি। ৬২-বছরের কাস্ত্রোর স্বামী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ম্যানুয়েল জেলায়া। বারো-বছর আগে মার্কিন মদতে সামরিক অভ্যুত্থানে যাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। স্বামী প্রতিবেশী দেশ কোস্টারিকায় নির্বাসনে থাকার সময়ই তিনি রাজনীতির প্রচারের আলোয় আসেন। ন্যাশনাল ফ্রন্ট ফর পপুলার রেজিস্ট্রেনসের ব্যানারে দেশজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন। অভ্যুত্থানের পর নিরাপত্তাবাহিনীর দমনপীড়নের বিরুদ্ধে হয়ে ওঠেন প্রতিরোধের মুখ। অভ্যুত্থানের নেপথ্যে প্রকাশ্যে সমর্থন ছিল ওবামা-প্রশাসনের। অভ্যুত্থানের চারমাস বাদে জালিয়াতির ভোটকে মদত দিয়েছিলেন সেসময়ের মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন। ‘লেডি কাস্ত্রো’র জয়ে বারো-বছরের রক্ষণশীল, উগ্র দক্ষিণপন্থী মাদক-স্বৈরাচারী জমানার অবসান। সংসদে কাস্ত্রোর লিবার্টি অ্যান্ড রিফাউন্ডেশন পার্টি (লিবরে) ও তাঁর ছোটো শরিকদের রয়েছে গরিষ্ঠতা। রাজধানী তেগুচিগালপা-সহ দেশের প্রধান শহরগুলিতে মেয়র পদে জয়ী হয়েছে লিবরে পার্টি। মানুষের প্রতিরোধে এই নির্বাচনে কারচুপি করতে ব্যর্থ হয় শাসক দক্ষিণপন্থী দল ন্যাশনাল পার্টি। নির্বাচনী প্রচারে কাস্ত্রো দিয়েছেন অতীতের সরকারের নয়া উদারনীতির বিপরীত পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি। বলেছেন নতুন সংবিধানের খসড়া লিখতে গঠন করা হবে নতুন গণপরিষদ। মুক্তি দেওয়া হবে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের। জয়ের পর ওয়াশিংটনের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আশাকরি, বাইডেন প্রশাসন এ থেকে শিক্ষা নেবে, আমাদের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হবে।’ কাস্ত্রোর জয় লাতিন আমেরিকায় মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় এক জোরালো আঘাত। হন্ডুরাসে এক নতুন যুগের সূচনা।

ভেনেজুয়েলায় মাদুরোর সমর্থকদের মিছিল

ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া

এই সময়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পাশাপাশি ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেও ব্যর্থ হয়েছে ওয়াশিংটন। নভেম্বরে নিকারাগুয়াতে বিপুল ভোটে জয়ী মার্কসবাদী সান্দিনিস্তা সরকার। ৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থবারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন একসময়ের গেরিলা, ফিদেলের বিশ্বস্ত অনুগামী সান্দিনিস্তা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতা দানিয়েল ওর্তেগা। অন্যদিকে, রাজধানী কারাকাসের মেয়র-সহ ভেনেজুয়েলার ২৩টি প্রদেশের ১৭টিতেই গভর্নর পদে জয়ী হয়েছে সাভেজের দল পিএসইউভি। ৩৩৫টি শহরের মধ্যে ২০৫টিতে জয়ী হয়েছেন সাভেজপন্থী ‘সাভিস্তা’রা। ২০০৭ সালের পর এই প্রথম বিরোধী দলগুলির অধিকাংশ, এমনকী মার্কিন মদতপুষ্ট দলগুলিও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। নির্বাচন প্রক্রিয়া দেখতে উপস্থিত ছিলেন ৩০টি দেশের তিনশ জনের বেশি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক। এদিকে বাইডেন প্রশাসন আবারও ভেনেজুয়েলার ‘স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি’ হুয়ান গুয়াইদোকে সমর্থন জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ‘গণতন্ত্র বৈঠকে’ ভেনেজুয়েলার প্রতিনিধি হিসেবে গুয়াইদোকে (নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মাদুরোকে নয়) আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আর্জেন্টিনায়, রাষ্ট্রপতি আলবার্তো ফার্নান্ডেজের বাম-মধ্য জোট (এভরিওয়ানস’ ফ্রন্ট) বুয়েনস আয়ার্স এবং লা পাম্পা শহরের সঙ্গে ৪০-বছরে প্রথমবারের জন্য সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের গরিষ্ঠতা হারালেও, নিম্নকক্ষ প্রতিনিধিসভার গরিষ্ঠতা রাখতে সফল হয়েছে।

জিয়োমারা কাস্ত্রো

চিলি

বছরশেষে ডিসেম্বরে নব্য ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে চিলিতে জয় বামপন্থার। ‘চিলির বোলসোনারো’ উগ্র দক্ষিণপন্থী নয়া নাৎসি প্রার্থী আন্তোনিও কাস্ত’কে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি’র প্রার্থী গ্যাব্রিয়েল বোরিক। ১৯ নভেম্বর, প্রথমদফার ভোটে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন কাস্ত। সমর্থনের হার ছিল ২৭.৯ শতাংশ। বোরিক পেয়েছিলেন ২৫.৮ শতাংশ। শেষে ১৯ ডিসেম্বর, চূড়ান্ত পর্বের ভোটে বোরিক পেয়েছেন ৫৫.৮৭ শতাংশ ভোট। বিপরীতে কাস্ত ৪৪.১৩ শতাংশ। ১৯৯০, পিনোচেতের জমানার অবসানের পর থেকে শাসকশ্রেণির প্রধান দুই রাজনৈতিক দল - ইনডিপেন্ডেন্ট ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (আইডিইউ) এবং সোশ্যালিস্ট পার্টি’র (সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, অর্থনীতির প্রশ্নে যাদের মধ্যে ছিল না তেমন কোনো পার্থক্য, নয়া উদারবাদের প্রতিই ছিল আনুগত্য) - নাম ছিল না ব্যালটে, কারণ দু’টি দলই প্রথম রাউন্ডে হেরে গিয়েছিল। নয়া উদারনীতির প্রথম পরীক্ষা চিলিতে। বছর পঁয়ত্রিশের বোরিক বলেছেন, ‘চিলি যদি নয়া উদারবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে থাকে, এবার তা হবে নয়া উদারবাদের কবরস্থান।’

ইভো মোরালেস

ব্রাজিল, কলম্বিয়া

এবছর মে’তে কলম্বিয়ায়, অক্টোবরে ব্রাজিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ব্রাজিলে লুলা দ্য সিলভার জয় একরকম নিশ্চিত। নজিরবিহীনভাবে তৃতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন লুলা। ওয়াশিংটনের বহুদিনের মিত্র দেশ কলম্বিয়াতে রক্ষণশীল রাষ্ট্রপতি ইভান দুকের নয়া উদারনীতি, পরিবেশের ধ্বংসযজ্ঞ, পুলিশি বর্বরতা এবং বেপরোয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ বেড়েই চলেছে। ডিসেম্বরের গোড়ায় দুকের বিরুদ্ধে অসন্তোষের হার ৬৯.৭ শতাংশ, যেখানে একবছর আগে ছিল ৫১.৯ শতাংশ, দু’মাস আগেও ছিল ৬৭.৬ শতাংশ। অন্যদিকে দুকের পক্ষে সমর্থনের হার আগস্টে যেখানে ছিল ২৯.৩ শতাংশ, নভেম্বর মাসে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫.১ শতাংশ। বিপরীতে, বাড়ছে বামপন্থী প্রার্থী গুস্তাভো পেত্রোর প্রতি জনসমর্থন। একসময়ের গেরিলা যোদ্ধা, রাজধানী বোগোতা শহরের প্রাক্তন মেয়র পেত্রো গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে। পেয়েছিলেন ৮০ লক্ষের বেশি ভোট, প্রায় ৪৩ শতাংশ। কলম্বিয়ার সেনেটের সদস্য পেত্রো এখন রাষ্ট্রপতির দৌড়ে সবার চেয়ে এগিয়ে।

চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে রয়েছে একটি সত্যিকারের সম্ভাবনা। নয়া উদারবাদের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে বিকল্প নির্মাণ। যদিও কাজটা সহজ নয়। দু’টি ভিন্নধর্মী রাজনৈতিক মডেলের সংঘাত অনিবার্য। একদিকে নয়া উদারবাদ, অল্প কিছু মানুষের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীভবন, সামাজিক খাতে বরাদ্দে তাচ্ছিল্য, অন্যদিকে প্রগতিশীল কর্মসূচি, যেখানে উন্নয়নের কেন্দ্রে জনগণ। আর এই চ্যালেঞ্জের মুখে ঐক্য নির্মাণে ব্রতী লাতিন আমেরিকা।

বামপন্থী শক্তিগুলি আবারও তাদের আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে সংহত করার কাজ শুরু করেছে। যেমন সেলাক। ২০১০ সালে তৈরি এই ব্লকটিতে ধীরে হলেও রাজনৈতিক ঐক্য নির্মাণের প্রয়াস শুরু হয়েছে। যার অন্যতম নেতা মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি লোপেজ ওব্রাডোর মার্কিন নিয়ন্ত্রিত অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)-র পরিবর্তে সেলাককে শক্তিশালী করার কথা বলেছেন। সম্প্রতি হাভানায় আলবা’র বৈঠকে রাষ্ট্রপ্রধানরা ঐক্য জোরদারে অঙ্গীকার করেছেন।