E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রুশ-মার্কিন বিরোধ

লালন ফকির


পূর্ব ইয়োরোপের অন্যতম দেশ ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দুনিয়ার মধ্যে বিরোধ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। অবশ্য রাশিয়া ঘোষণা করেছে যে, ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটানোর কোনোরকম উদ্দেশ্য তাদের নেই, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে যে, এই সামরিক হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী, কারণ ইউক্রেনের পক্ষ থেকে ক্রিমিয়া এবং ডনবাসের উপর তাদের অধিকার দাবি করেছে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দুনিয়ায় ২০১৪ সালে সংগঠিত ‘ময়দান বিপ্লব’-এর পর থেকে যে বিরোধ চলে আসছিল, সম্প্রতি তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এ সম্পর্কে তাঁর পূর্বসূরির থেকেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যাতে রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেনের সরকার কঠিন অবস্থান গ্রহণ করে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের শাসনকালে ইউক্রেনকে আধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ম্যাভলিন ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র। এই ধরনের সমরাস্ত্র সাধারণভাবে সামরিক জোট, ন্যাটো ভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে দেওয়া হয়ে থাকে।

রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেন কর্তৃক সংগৃহীত তুরস্কের বেরাক্তার কমপ্যাট ড্রোনস সংগ্রহে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। এর সফল প্রয়োগ সাম্প্রতিক নাগোরনো কারবাখ যুদ্ধে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্মেনীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে এই সামরিক ড্রোনগুলি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন এবং ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেঙ্কসির বৈঠকের পূর্বে ইউক্রেনকে ছয় কোটি ডলার সামরিক সাহায্য প্রদান করে মার্কিন প্রশাসন। ২০১৪ সালে বিরোধের পর মার্কিন প্রশাসন ইউক্রেনকে ২৪০ কোটি ডলার সামরিক অনুদান প্রদানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ইউক্রেন মোট যে বিদেশি সাহায্য পেয়ে থাকে তার ৯০ শতাংশই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সামরিক সাহায্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায়শই রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনীত ইউক্রেনের সমস্ত অভিযোগকে সমর্থন করে থাকে। যদিও রাশিয়া বারে বারে তার বিরুদ্ধে আক্রমণের এই অভিযোগকে অস্বীকার করছে। বিপ্রতীপে আক্রমণের উদ্দেশে ইউক্রেনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ওঠার প্রশ্নে রাশিয়া বারে বারে সমালোচনা করেছে। তাছাড়া ইউক্রেন বারে বারে ঘোষণা করেছে যে, ডনবাসের দখল বিরোধীদের কাছ থেকে তারা ছিনিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। ক্রিমিয়ার উপর রাশিয়ার কর্তৃত্ব স্থাপনকেও তারা মেনে নিতে পারছে না।

ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের সাথে যৌথ বৈঠকের পর রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলিই উৎসাহিত হচ্ছে। বস্তুতপক্ষে, বিগত কয়েক মাস যাবত ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের বর্তমান পরিস্থিতির একটি পটভূমিকা রয়েছে যা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। ইউক্রেনের অবস্থান রাশিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে। ইউক্রেন ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর রুশ অধীনতা থেকে মুক্তি পেলেও ১৯২১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েতের পতন হলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ফের আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন।

২০০৪ সালে অর্থনৈতিক সংস্কারপন্থী নেতা ভিক্টর ইউশেঙ্কোর নেতৃত্বে ‘অরেঞ্জ বিপ্লব’ সংগঠিত হয়। এর পরবর্তীকালে অনেক রাজনৈতিক পালাবদলের পর ২০১২ সালে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে এক গণভোটে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের মানুষ রাশিয়ার সাথে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট দেয়। ১৮ মার্চ রাশিয়া এক চুক্তিতে ক্রিমিয়া ও বন্দর শহর সেবাস্তোপোলকে অন্তর্ভুক্ত করে। ২০১৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি পেড্রো পেরোশাঙ্কো ক্রিমিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে কিন্তু তারপরেও ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান ঘটেনি।

গত নভেম্বর মাসে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন হুঁশিয়ারির সুরে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন যে, ইউক্রেনের লক্ষ্মণরেখা যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতিক্রম না করে। এই লক্ষ্মণরেখার অন্যতম বিষয় হলো ইউক্রেনে মার্কিন সেনা নিয়োগ ও সমরাস্ত্রের প্রয়োগ। এই লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করলে রুশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে যে, তারা ন্যাটো যুদ্ধ জোটে ইউক্রেনের যুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে এবং একইসাথে ন্যাটো যুদ্ধ জোটের রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত সম্প্রসারণের তারা বিরোধী।

একটি ব্যবসায়ী সংস্থার সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে পুতিন বলেছেন যে, ন্যাটো যুদ্ধ জোট অবস্থানের পরিবর্তন করা সত্ত্বেও কেন মার্কিন প্রশাসন তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করছে না। এই পরিস্থিতিতে অর্থাৎ সীমান্ত এলাকায় সামরিক হুমকির মোকাবিলায় তাদের সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। পুতিন ব‍‌লেছেন, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমী দেশগুলির কাছ থেকে এই মর্মে মার্কিনি নিশ্চয়তা চান যে, ন্যাটোর উপস্থিতি পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত করছে। কারণ রাশিয়া সীমান্তে ন্যাটোর উপস্থিতিতে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ন্যাটো তার বিভিন্ন সামরিক নৌ মহড়া বাল্টিক সাগরে সংগঠিত করছে এবং বাল্টিক রাষ্ট্রগুলিতে মার্কিন সেনাবাহিনীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি, সাম্প্রতিক উত্তেজনা সৃষ্টির আর একটি কারণ। এ ব্যাপারে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, রাশিয়ার সীমানা বরাবর মার্কিন বিমানবাহিনীর তৎপরতা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন পূর্ব এবং পশ্চিম উভয় দিক থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র নিক্ষেপ করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন উভয় রাষ্ট্রই ২০০৮ সাল থেকে চেষ্টা গ্রহণ করে আসছে যাতে ইউক্রেনকে ন্যাটোয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সম্প্রতি ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেন্স স্টোলেনবার্গ বলেছেন যে, জার্মানিতে স্থাপিত পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্রগুলির অভিমুখের পুনর্বিন্যাস করে তা রাশিয়াযর সীমান্তবর্তী পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলির অভিমুখী কীভাবে করা যায় তা বিবেচনা করা হবে। ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে তিনি বলেছেন যে, এ ব্যাপারে ন্যাটোভুক্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলিই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তাঁর মতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির উপর প্রভাব সৃষ্টি বা প্রভাবিত করার কোনো অধিকার রাশিয়ার নেই।

ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে রাশিয়া ও মার্কিন বিদেশ সচিব হিমোথে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। এই বৈঠকের পর উভয় দেশের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই আশা প্রকাশ করা হয়েছে যে, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে উভয় দে‍‌শের মধ্যে চলতে থাকা বিতণ্ডার অবসান ঘটানো হচ্ছে।

মার্কিন বিদেশ সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন যে, রুশ প্রধানমন্ত্রী এবং মার্কিন রাষ্ট্রপতি এই বিষয়টি নিয়ে সরাসরি আলোচনায় বসবেন। তবে বৈঠক শেষে রুশ বিদেশমন্ত্রী কিছুটা হুঁশি‌য়ারির সুরে বলেছেন যে, ইউক্রেনকে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে চায়, তাহলে তার ফল ভাল হবে না। রুশ প্রধানমন্ত্রীর সূত্র উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন যে, রাশিয়া তার পশ্চিম সীমান্ত বরাবর দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তা চায়।

গত নভেম্বর মাসে রাশিয়ায় ন্যাটো সদর দপ্তরে কূটনৈতিক কার্যকলাপ সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে এবং একইসাথে দেশের ন্যাটোর দপ্তরকে বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ এর পূর্বে ন্যাটো সদর দপ্তরে অবস্থানরত বেশ কয়েকজন রাশিয়ান কূটনীতিবিদকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এর পাশাপাশি ইউক্রেনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে যে, তাদের দেশের সীমানা বরাবর রাশিয়া ৯০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। এর লক্ষ্য হলো, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান সংগঠিত করা। এর বিপ্রতীপে রাশি‌য়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, নিজ ভূখণ্ডে সেনা মোতায়েন করার অধিকার রাশিয়ার রয়েছে। স্টকহোম বৈঠকে মার্কিন বিদেশ সচিব অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন যে, রাশি‌য়া যদি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর। তিনি আরও বলেন যে, ২০১৫ সালে মিনস্ক শহ‍‌রে স্বাক্ষরিত চুক্তি রাশি‌য়া এবং ইউক্রেন উভয় দেশকেই মান্যতা দিতে হবে। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল পশ্চিমী মদতপুষ্ট ইউক্রেনের সরকার এবং ডনবাস অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির প্রতিনিধি।

মার্কিন বিদেশ সচিবের এই হুমকি আসলে বাইডেন প্রশাসনের ধারণা যে, রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেন আক্রমণ করারই সম্প্রসারিত রূপ। মিনস্ক চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে, ডনবাস অঞ্চলকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ইউক্রেন সরকার মিনস্ক প্রস্তাব অস্বীকার করে সামরিক সমাধানের উপর জোর দিয়েছে। রাশি‌য়া কিন্তু বারে বারে বলেছে যে, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে তারা কোনো সামরিক অভিযান সংগঠিত করবে না।

সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার (একে ইউক্রেনীয় সরকার স্বাধীনতা দিবস বলে থাকে) ৩০তম বার্ষিকীতে ইউক্রেনীয় সরকার বলেছে যে, ক্রিমিয়া এবং পূর্ব ডনবাস অঞ্চলে যা ২০১৪ সালে তারা হারিয়েছে তা পুনরুদ্ধার করাই হলো তাদের প্রধান কাজ। দেশের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত দলিলেও একথা বলা হয়েছে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান তখনই হতে পারে যখন পশ্চিমী দুনিয়া রাশিয়া র অবস্থানকে গ্রহণ করবে। ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা তখনই রক্ষিত হতে পারে যখন ইউক্রেন নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করবে। ইউক্রেনকে একটি বাফার স্টেট হিসাবে মেনে নিতে রাশিয়ার কোনো অসুবিধা নেই। অবশ্যই ইউক্রেন যেন কোনো দেশ বা সামরিক জোটের পুতুলে পরিণত না হয়।