প্যালেস্তাইনের বিলুপ্তি চায় ইজরায়েল
অঞ্জন বেরা
চলতি বছরে আন্তর্জাতিক প্যালেস্তাইন সংহতি দিবস (২৯ নভেম্বর) উপলক্ষে রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস প্যালেস্তাইনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং পরিস্থিতি যে আশাব্যঞ্জক নয় সেকথা স্পষ্টই স্বীকার করেছেন। কোনো সন্দেহ নেই রাষ্ট্রসংঘ এই পরিস্থিতির দায় এড়াতে পারে না। একের পর এক প্যালেস্তাইন সংহতি দিবস পার হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ক্রমশ জটিল হচ্ছে প্যালেস্তাইন পরিস্থিতি। আমেরিকা এবং তার জায়নবাদী দোসর ইজরায়েল কোনো তোয়াক্কাই করছে না রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবের।
ইজরায়েলঃ জন্মসূত্রে দখলদার
সকলেই জানেন আন্তর্জাতিক প্যালেস্তাইন সংহতি দিবস পালনের জন্য ২৯ নভেম্বর তারিখকে বেছে নেওয়ার কারণ ১৯৪৭ সালে এই তারিখেই রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব (১৮১ নং প্রস্তাব) অনুযায়ী প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে পৃথক প্যালেস্তাইন ও ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংহতি দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রসংঘ আসলে সেই প্রস্তাবের রূপায়ণের গুরুত্ব তুলে ধরতে চায়।
ইতিহাস দেখিয়ে দিয়েছে, জন্মসূত্রেই ইজরায়েল একটি দখলদার রাষ্ট্র। কট্টর জায়নবাদী গোষ্ঠীগুলির দীর্ঘ কয়েক দশকের তৎপরতার পরিণতিতে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে জবরদস্তি একটি ধর্মগোষ্ঠীভিত্তিক ইজরায়েলি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় খোদ রাষ্ট্রসংঘ। প্যালেস্তাইনের মূল বাসিন্দাদের প্রতি চূড়ান্ত বৈষম্যমূলকভাবে তাদের ভূখণ্ডে এই রাষ্ট্রসংঘ চাপিয়ে দিয়েছিল। প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে মোট এলাকার ৪২.৮৮ এলাকা বরাদ্দ করা হয় প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের জন্য। যদিও ওই এলাকার ৯৩ শতাংশ অধিবাসী ছিলেন খ্রিস্টান ও মুসলিম। আর ইজরায়েলের জন্য বরাদ্দ হয় ৫৬.৭৪ শতাংশ জমি। যদিও তখন সেই এলাকার মাত্র ৭ শতাংশ ছিল ইহুদি মালিকানায়।
মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমি-মার্কিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিশ্বস্ত দোসর হিসেবেই জন্মলগ্ন থেকে সক্রিয় থেকেছে ইজরায়েলের শাসক গোষ্ঠী। বিনিময়ে আরব দেশগুলির বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যাবতীয় হামলাবাজি ও দখলদারির প্রতি পশ্চিমি-মার্কিনি সমর্থন থেকেছে সুনিশ্চিত।
জন্মলগ্ন থেকেই প্যালেস্তাইনের রাষ্ট্রসংঘ-নির্ধারিত ভূখণ্ড দখল করাই ছিল ইজরায়েল সামরিক বাহিনীর নিয়মিত কর্মসূচি। পরিকল্পিতভাবে লাগাতার তারা রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবকে লঙ্ঘন করে প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডের দখলদারি বাড়িয়েছে। এখনকার হিসেবে, রাষ্ট্রসংঘ-নির্ধারিত প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ ভূখণ্ড ইজরায়েল সেনাবাহিনী জবরদস্তি দখল করে নিয়েছে। প্যালেস্তাইন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের সমস্ত সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে।
ইজরায়েলের গাজোয়ারিপনার জঘন্য নজির ১৯৬৭-র জুন মাসের যুদ্ধ। সেইসময় ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা উপত্যকার বড়ো অংশ ইজরায়েল দখল করে নেয়। পূর্ব জেরুজালেমও দখল করে নেয় ইজরায়েলি বাহিনী। তবে কার্যক্ষেত্রে কিছু না করতে পারলেও রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৬৭-র ২৭ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব (২৪২ নং প্রস্তাব) সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। সেই প্রস্তাবেই বলা হয়, যুদ্ধে অধিকৃত সমস্ত এলাকার দখল ইজরায়েলকে ছেড়ে দিতে হবে এবং সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে হবে। বলাবাহুল্য, ইজরায়েল রাষ্ট্রসংঘের কোনো সিদ্ধান্তই মানেনি। উলটে ১৯৮০ সালে পূর্ব জেরুজালেমকে তারা ইজরায়েলের ‘অন্তর্ভুক্ত’ করে নেয়।
প্যালেস্তাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও; প্রতিষ্ঠা ১৯৬৪)সহ মুক্তিকামী প্যালেস্তাইন সংগঠনগুলির কেউই দীর্ঘদিন প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইজরায়েলি রাষ্ট্রকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত মানেনি। আরব দেশগুলিও তখন এ সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি।
অসলো চুক্তি
১৯৮৮ সালের নভেম্বরে পিএলও নেতা ইয়াসের আরাফত স্বাধীন প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র ঘোষণা করেন এবং প্যালেস্তাইন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাবগুলির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। এর অর্থ, ইজরায়েল ও প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের সহাবস্থানকে মেনে নেওয়া। পিএলও-র তরফ থেকে তা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। বলা যেতে পারে, এরই ভিত্তিতে ১৯৯৩ সালে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের উদ্যোগে পিএলও এবং ইজরায়েল সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যাতে উভয় পক্ষই স্বাধীন প্যালেস্তাইন ও স্বাধীন ইজরায়েল রাষ্ট্রের সহাবস্থান এবং প্যালেস্তাইন সংক্রান্ত রাষ্ট্রসংঘের সিদ্ধান্তগুলি মেনে চলার পক্ষে মত দেন। চুক্তির মাধ্যমে ইজরায়েল এবং পিএলও পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়। পরের বছর অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি প্রশাসন গঠিত হয়। সাতাশ বছরের নির্বাসন শেষ করে আরাফত প্যালেস্তাইনে ফেরেন।
এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য, রাষ্ট্রসংঘ সহ আন্তঃরাষ্ট্রীয় মঞ্চগুলিতে প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করে পিএলও। প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি নয়। প্যালেস্তাইন ন্যাশনাল অথরিটি প্রশাসন প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে নির্বাচিত হয়। প্যালেস্তাইন লেজিসলেটিভ কাউন্সিল গঠন করে।
অভিজ্ঞতা বলছে, রাষ্ট্রসংঘের প্রস্তাব তো দূরের কথা ইজরায়েলের কট্টর জায়নবাদী রাজনৈতিক মহল অসলো চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষায় বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। কার্যক্ষেত্রে অসলো চুক্তিকে তারা জীর্ণ বস্ত্রের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। ইজরায়েলের দক্ষিণপন্থী শাসক শ্রেণির মূল রাজনীতি প্যালেস্তাইন-বিরোধিতা।
অসলো চুক্তি প্যালেস্তাইন সমস্যা নিরসনে প্রত্যাশিত সাফল্য না আনায় অসুবিধায় পড়েছে পিএলও। পিএলও অসুবিধায় পড়ায়, হামাসের মতো ইসলামিক ব্রাদারহুড মদতপুষ্ট শক্তি প্যালেস্তাইনের ঘরোয়া রাজনীতিতে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। বাস্তবে ইজরায়েলিরা এখন হামাস নিয়ে যে কথাই বলুক, প্যালেস্তাইন মুক্তি আন্দোলনকে দুর্বল করতে হামাসের মতো সংগঠনগুলিকে মদত দিয়েছে জায়নবাদীরাই। ১৯৮৭ সালে হামাসের প্রতিষ্ঠা আকাশ ফুঁড়ে হয়নি।
২০০৪ সালে ইয়াসের আরাফতের মৃত্যুর পর পরিস্থিতির অবনতি হয়। প্যালেস্তাইন এখন কার্যত দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। পিএলও-র নেতৃত্ব কার্যকর ওয়েস্টব্যাঙ্ক অঞ্চলে। গাজা ভূখণ্ড ২০০৭ সাল থেকে কার্যত হামাস-নিয়ন্ত্রিত। ২০০৬ সালের পর প্যালেস্তাইন অথরিটির আইনসভার নির্বাচন হয়নি। প্যালেস্তাইন সমস্যার নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পিএলও-র নেতৃত্বে সব পক্ষের ঐক্য খুবই জরুরি।
গণহত্যা বিনা অজুহাতে
তবে গণহত্যা-মত্ত ইজরায়েলি দখলদারদের কোনো অজুহাত লাগে না। জায়নবাদ এযুগের বর্ণবাদ। প্যালেস্তাইন ভূখণ্ডে ইজরায়েলি বর্বরতা কোনো অজুহাতের অপেক্ষা করেনি কোনো দিন। প্যালেস্তাইনের সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এমনকী ইজরায়েলের বিরাট অংশের মানুষের মতামতকেও জায়নবাদী সরকার উপেক্ষা করে চলেছে। গত কয়েক বছর যাবত ইজরায়েলের সরকারগুলি রাষ্ট্রীয় বর্বরতার অতীতের সব নজির ভেঙে ফেলেছে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ওয়াশিংটনের ইজরায়েল নীতি ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। ডেমোক্র্যাট রাষ্ট্রপতি বাইডেন তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই দখলদার ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর যাবতীয় বর্বরতার সমর্থনে সক্রিয়। ইজরায়েলের ‘আত্মরক্ষা’র অধিকারের পক্ষে তিনি বেশ সরব। হোয়াইট হাউস থেকে রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সরে গেলেও ওয়াশিংটনের ইজরায়েল-নীতি যথা পূর্বং।
গাজায় জায়নবাদী বর্বরতার চরম হিংস্ররূপ দেখছে বিশ্বব্যাপী। গত কয়েক বছর ধরে। এমনকী করোনার সময়ও তারা রেহাই দেয়নি। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী যা চালাচ্ছে তাকে বলা যায় গণহত্যা। সাধারণ নাগরিকদের উপর আক্রমণই ইজরায়েলি দখলদার বাহিনীর লক্ষ্য। জনগণের মনোবল ভাঙা। যদিও সেকাজে ইজরায়েল সফল নয়। স্বাধীন সার্বভৌম প্যালেস্তাইন রাষ্ট্র গঠনে প্যালেস্তিনীয় জনতা যেকোনো আত্মত্যাগে কখনও পিছপা নয়।