পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে
লালন ফকির
ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনীতি বিপর্যস্ত ভয়াবহ বন্যার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইমরান খানের ওপর আক্রমণ। এটা সকলেই জানেন ইমরান খান পদচ্যুত হওয়ার পর আবার ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে দেশব্যাপী পদযাত্রার কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। সেই রকমই একটি পদযাত্রার কর্মসূচি ছিল ২৮ অক্টোবর লাহোর থেকে যাত্রা শুরু করে ৩ নভেম্বর ইসলামাবাদ পর্যন্ত ৩৮০ কিলোমিটার অতিক্রম করা। এই কর্মসূচি শুরুর পর্বেই জনৈক আততায়ীর গুলিতে ইমরান খান আহত হন। সমাজ মাধ্যমে এক সাংবাদিকের পেশ করা ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে যে, আততায়ী হিসাবে সন্দেহভাজন ব্যক্তি বলছেন, দেশের মানুষকে ভুল পথে চালনা করার চেষ্টা করছেন ইমরান। তাই তিনি এই ঘটনা ঘটিয়েছেন। প্রসঙ্গত,কদিন আগেই জাপানের নির্বাচনে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আততায়ী কেপশুয়া ধরা পড়ার পর জানিয়েছিলেন যে, শিনজো আবের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি তার কোনো বিরাগ নেই, রাগ মানুষটির ওপরে। আসলে রাজনীতি যখন অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে তখন আদর্শের বদলে জায়গা নেয় ভ্রান্ত কিছু কার্যকলাপ, ব্যক্তি হত্যা যার অন্যতম। অনেক সময়ে রাজনৈতিক নেতানেত্রীর একনায়কতন্ত্রই শাসনের মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে। তখন বিরোধীদের অনুগামীদের রাগ কেন্দ্রীভূত হতে পারে সেই ‘একমেবাদ্বিতীয়ম্’ শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর। বিগত কয়েক দশকে এই উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও তা অনেকটাই সত্য।
অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে রাজনৈতিক দল পিটিআই (পাকিস্তান তাহেরিক-ই-ইনসাফ)-এর নেতা ইমরান খানকে সাংসদ পদ থেকে পদচ্যুত করার নির্দেশ দেয় পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি যে উপহার পেয়েছেন তা সরকারি তোসাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন এবং উপহার সংক্রান্ত তথ্য নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া তথ্যে গোপন করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, পাকিস্তানের পূর্বতন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পানামা পেপারসে বর্ণিত দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হয়েছিলেন। তারপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পাকিস্তানি ‘ডিপ স্টেট’ বলে পরিচিত সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের দুই প্রধান দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ শরিফ) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির বিকল্প হিসাবে ইমরান খানকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করে। অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক প্রধান জেনারেল কামার বাজোয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে ঘোষণা করেছিলেন,পাক রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী আর হস্তক্ষেপ করবে না। এরপরে সকলেরই ধারণা হয়েছিল যে, পাক রাজনীতিতে এবারে একটা স্থিতিশীলতা আসবে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা এই ধারণায় আঘাত করেছে। এই ঘটনার পর ইমরান খান এবং তাঁর দল রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। এই বিক্ষোভ কর্মসূচির অন্যতম অংশ ছিল রাজ্যজুড়ে লংমার্চ। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর তিনি এরজন্য সামরিক বাহিনীর একাংশ, দেশের কোনো কোনো শিল্পপতি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে দায়ী করেছেন। যদিও তাঁর এই মতামতের সপক্ষে তিনি কোনো তথ্য বা দলিল হাজির করতে পারেননি।
ইমরান খানের ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া তার দেশের অভ্যন্তরে এবং ভারত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপরে কিছু সামান্য ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত। ইমরানের বিদায়ের পর সেদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শাহবাজ শরিফ। তিনি পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই। নওয়াজ শরিফের কারাবাসের সময়ে তাঁর দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) চালিয়েছিলেন শাহিদ খাকান আব্বাসি। এর পরের নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসেন ইমরান। এরমধ্যে জামিন নিয়ে লন্ডনে গেছিলেন নওয়াজ। ইমরানের সময়ে দেশে ফিরলে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হতো। এখন অবশ্য পরিস্থিতির বদল হয়েছে। অনেকে মনে করেন ইমরান যতটা মৌলবাদী এবং কাশ্মীর নিয়ে যতটা অসহিষ্ণু তার তুলনায় যথেষ্ট উদারবাদী নওয়াজ শরিফ এবং তাঁর দল।
সম্প্রতি দেশের পূর্বতন সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া অবসর গ্রহণ করেছেন এবং নতুন সেনা প্রধান নিযুক্ত হয়েছেন আসিম মনীর আহমেদ। তিনি নওয়াজের ঘনিষ্ঠ। অবসর গ্রহণের পর পূর্বতন সেনা প্রধান বাজওয়া রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন কিনা তা দেখার বিষয়। পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী সামনের বছর সেখানে সাধারণ নির্বাচন হবার কথা। তবে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে অন্য বিষয়।
ইমরানের ক্ষেত্রে সরাসরি দুর্নীতির অভিযোগ আসেনি ঠিক। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে সঠিক লড়াইটা যে তিনি করছেন না তা জনগণের একটা অংশ এবং তার জোটসঙ্গীদের ধারণা। নির্বাচন হলে ব্রাজিলের লুলার মতোই ইমরান ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারেন। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল পিটিআই’র অনুকূলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাস নানান ঘটনার ঘাত প্রতিঘাতে পাক রাজনীতিতে শোরগোল হতে পারে।
পাক গণতন্ত্র যে পিছিয়ে রয়েছে তার প্রধান কারণ রাজনৈতিক দলগুলির অবিমৃশ্যকারিতা এবং সামরিক শাসনের জাঁতাকল।
দেশের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়েছে। দেশের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার দ্রুত ক্ষয় পাচ্ছে, অন্যদিকে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি দারুণ সংকট। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আইএমএফ’র নির্দেশে বিদ্যুতের ভরতুকি তুলে দেওয়া প্রভৃতি জনবিরোধী সিদ্ধান্ত। মুদ্রাস্ফীতির হার ২৩ শতাংশ।প্রবল বেকার সমস্যা এবং অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের মানুষের দুর্দশা চরমসীমায় নিয়ে গেছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২-২৩ আর্থিক বর্ষে বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বন্যায় সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলগুলির পরিস্থিতি ভয়ঙ্করভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাব দৃশ্যমান। মনে করা হচ্ছে দারিদ্র্যের হার ২.৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশ হতে চলেছে, যার ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৫৮ লক্ষ থেকে বেড়ে ৯০ লক্ষ হবে। ক্ষুধা সূচকে পাকিস্তানের স্থান ১২১টি দেশের মধ্যে ৯৯তম। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে অনেকে ‘ডুবন্ত নৌকা’র সঙ্গে তুলনা করছেন।
পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতও উদ্বেগের সঙ্গে পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে।