E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ও মার্কিন-চীন সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব

লালন ফকির


মার্কিন প্রতিনিধি সভার অধ্যক্ষ ন্যান্সি পেলোসির গত আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে তাইওয়ান সফর চীন-মার্কিন সম্পর্ককে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটি হলো মার্কিন প্রশাসনের কয়েক দশকের ‘ওয়ান চায়না’ (‘এক চীন’) নীতির পরিবর্তনের ইঙ্গিত কী এর মধ্য দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে? চীন সরকারের প্রেক্ষিতে ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি’কে (পিএলএ) তাইওয়ান প্রণালীতে পাঁচদিনের নৌমহড়ার নির্দেশ দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গত কয়েকমাস যাবত চীন সরকার বলে আসছে তাইওয়ানে মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের এই রকম সফর কার্যত ‘এক চীন’ নীতি থেকে অপসরণ এবং তা অনিবার্য ভাবেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালে মার্কিন প্রতিনিধিসভার অধ্যক্ষ, রিপাবলিকান পার্টির সদস্য নিউট গিংগ্রিচ তাইওয়ান সফর করেছিলেন। অবশ্য রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে উভয় সফরের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমত, তখন মার্কিন প্রেসিডন্ট ছিলেন বিল ক্লিন্টন এবং মার্কিন-চীন সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। পেলোসির সফর এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন চীনের ওপর মার্কিন সরকার একাধিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দ্বিতীয়ত, নিউট তাঁর চীন সফরের মধ্যে মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য তাইওয়ানে ছিলেন, কিন্তু পেলোসি সেক্ষেত্রে তাইওয়ানে রাত্রি যাপন করেন এবং তাইওয়ানের রাষ্ট্রপতি সাই ইংগ-ওয়েন ও চীনবিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এবং চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকংয়ের বিভেদকামীদের সঙ্গেও দেখা করেন।

১৯৭৯ সালে জিমি কার্টারের সময়ে মার্কিন প্রশাসন চীনকে স্বীকৃতি দেয়। একই সঙ্গে ‘এক চীন’ নীতি কার্যকর করে। আবার মার্কিন কংগ্রেসে ওই সময়েই তাইওয়ান রিলেশন অ্যাক্ট পাশ হয়। ওই আইনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান সরকারের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারবে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি অবশ্য সবসময়েই বলে এসেছে শান্তিপূর্ণ উপায়েই চীন-তাইওয়ানের সংযুক্তি ঘটবে। চীন যখন শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং নিজস্ব উদ্যোগে একটি মহাশক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে উঠছে তখনই তাইওয়ানের বিষয়কে সামনে আনা হয়। প্রথমত,বারাক ওবামার রাষ্ট্রপতি শাসনের দ্বিতীয়বারের মেয়াদে ‘প্রাচ্যের মিলিটারি ভরকেন্দ্র’ হিসাবে চীনবিরোধী প্রচার শুরু হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রচারে ভারত সহ বিভিন্ন দেশকে জড়িয়ে নেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর প্রচারে ‘এক চীন নীতি’র বিরোধিতা করেন। যদিও ট্রাম্প অতিদ্রুত তাঁর অবস্থান পরিবর্তন করে এক চীন নীতির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর মেয়াদের শেষ দিকে ঘোষণা করেন, চীনের সঙ্গে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতাই করতে হবে। এই লক্ষ্যে তিনি ‘তাইওয়ান ট্রাভেল অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন। এই আইনে বলা হয় মার্কিন প্রশাসনের বিদেশমন্ত্রক, বাণিজ্যমন্ত্রক এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রকের উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা তাইওয়ান সফর করতে পারবেন। ট্রাম্পের বিদেশ সচিব মাইক পম্পিও ২০২০ সালে ঘোষণা করেছিলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সহযোগিতার দিন শেষ।

বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের কঠোর বিদেশনীতি অব্যাহত রেখেছে। এর মধ্যে আছে কিউবা ও ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ। চীনের ক্ষেত্রে জো বাইডেন ট্রাম্পের থেকেও একধাপ এগিয়ে গিয়ে তাইওয়ানের মুখ্য প্রতিনিধিকে (কার্যত রাষ্ট্রদূত) তাঁর শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করেন। তাইওয়ানের শাসকদল ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেস পার্টি উৎসাহিত হয়ে এই ঘটনাকে ‘৪২ বছরের অচলাবস্থা ভেঙে বেরনো’ বলে উল্লেখ করেন। রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য পেলোসির সফর মার্কিন রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছাড়া কখনই হতে পারে না এবং চীনকে বার্তা দেবার জন্যই এই সফরকে বেছে নেওয়া হয়েছে।

পেলোসির তাইওয়ান সফর এপ্রিলে নির্দিষ্ট ছিল। কিন্তু কোভিড মহামারীর জন্য তা পিছিয়ে দিতে হয়। চীনও যে তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকার প্রতিক্রিয়া কঠোরভাবে দিতে প্রস্তুত তা বোঝা গেছে। পিএলএ-র মহড়া কোনো ফাঁকা আওয়াজ নয়। এই মহড়ায় ১০০-র বেশি সামরিক বিমান ব্যবহার করা হয়েছিল। বিমানগুলি ছিল অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত। পশ্চিমি সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে ওই মহড়াকে তাইওয়ান আক্রমণের মহড়া বলা যেতে পারে। পিএলএ এই মহড়াতে দেখিয়ে দিয়েছে মার্কিন মদতপুষ্ট তাইওয়ান বাহিনীকে দ্রুততার সঙ্গে মোকাবিলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব।

সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন রুশ-ইউক্রেন সংঘাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন ইউক্রেনকে শিখণ্ডি করে ‘প্রক্সি ওয়ার’-এ অবতীর্ণ হয়েছে তেমনই তাইওয়ানকে দিয়ে কী চীনের বিরুদ্ধে অপর একটি ফ্রন্ট খুলতে চাইছে? বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীন এবং রাশিয়ার বিরোধিতার নীতি মার্কিন প্রশাসন গ্রহণ করেছে। সামান্য অজুহাত পেলেই তারা বিরোধী প্রচার করছে। ইতিমধ্যে ‘আসিয়ান’ দেশগুলির বিদেশমন্ত্রীদের সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকার সমালোচনা করেছে চীন এবং অন্য আসিয়ান দেশগুলিকেও প্রতিবাদ করতে আহ্বান করেছে। এই প্রসঙ্গে ভারতের ভূমিকার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ‘এক চীন’ নীতির স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারতের অবস্থান ছিল একদম প্রথমে। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার পর ভারতের দীর্ঘকালের এই নীতিকে লঘু করে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয়। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার সময়ে তাইওয়ানের প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের যাতায়াতও শুরু হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বিদেশনীতির মূল বিষয় বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। এর অন্যতম কেন্দ্রীয় বিষয় হলো রুশ এবং চীন বিরোধিতা। তাইওয়ানের প্রশ্নে চীন একাধিকবার শান্তিপূর্ণ উপায়ে উভয় দেশের পুনর্মিলনের ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু চীন বিরোধিতার অবস্থান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করার চেষ্টা করছে। রুশ-ইউক্রেন সংঘাতেও তাদের একই অবস্থান।

এই পরিস্থিতিতে সঠিকভাবেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক প্রস্তাবে ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিকে সংহত করো’ শিরোনামে উল্লেখ করেছে,“আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সিপিআই(এম) সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সকল রকমের লড়াইয়ে সংহতি প্রসারিত করবে।... পৃথিবীর সমস্ত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইকে একসূত্রে ঐক্যবদ্ধ করতে মানুষের বিভিন্ন ধারার লড়াইকে একত্রিত করতে সিপিআই(এম) উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এই ঘোষণাকে সামনে রেখেই আগামীদিনে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।’’