E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

কর্মরত ভারতীয়দের সংখ্যা কমাতে আইন আনছে কুয়েত


কুয়েতের সংসদে সম্প্রতি পেশ করা একটি বিল-কে ঘিরে সেদেশে কর্মরত ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ৬ জুলাই কুয়েতের সংসদ ন্যাশনাল অ্যাসেমব্লিতে ‘জনতাত্ত্বিক অসাম্য’ সংক্রান্ত একটি খসড়া বিল পেশ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এই বিলটিতে কুয়েতে কর্মরত বিদেশীদের সংখ্যা কমানোর জন্য বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছে। সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, এই প্রস্তাবিত বিলটিতে ভারতীয়দের সংখ্যা কুয়েতের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ যেন অতিক্রম না করে সেই লক্ষ্যে কিছু পদ্ধতিগত বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান এবং কর্মসংস্থানের সাম্প্রতিক বেহাল দশা আরও নড়বড়ে হতে পারে বলে আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। কারণ, সামগ্রিকভাবে উপসাগরীয় দেশগুলিতে কর্মরত ভারতীয়দের দেশে ফিরে কাজ পাওয়ার মতো পরিস্থিতি না থাকার দরুন সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তা প্রবল।

প্রসঙ্গত, কুয়েতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৪.৩ মিলিয়ন। যেখানে কর্মরত ভারতীয়দের সংখ্যা ১.৪৫ মিলিয়ন। শুধু ভারতীয়রাই নন, কুয়েতে কর্মরত এবং বসবাসরত বিদেশিদের সংখ্যা প্রায় ৩ মিলিয়ন। যেখানে সংখ্যার দিক থেকে বিদেশিদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন মিশরীয়রা। এই মিশরীয়রা কুয়েতের জনসংখ্যার ১০ শতাংশ। এই খসড়া বিলটি প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হবার পর যদি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আইনে পরিণত হবার বৈধতা পায় তাহলে কুয়েতে কর্মরত ভারতীয়দের একটা বড় অংশই এক লহমায় কর্মহীন হয়ে পড়বেন। আর ভারত হারাবে তার বিদেশি মুদ্রা জোগানের অন্যতম নিশ্চিত উৎসকে। কুয়েতের মুদ্রা দিনার পৃথিবীর সর্বোচ্চ মূল্যের অধিকারী। একটি পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে ভারতে বিদেশি মুদ্রা আসার সর্বোচ্চ উৎস কুয়েতে কর্মরত ভারতীয়দের পাঠানো অর্থ। ডলার মূল্যে যার পরিমাণ প্রায় ৪.৮ বিলিয়ন। কুয়েতের ভারতীয় দূতাবাস নয়া বিল নিয়ে এই মুহূর্তে কোনও মন্তব্য না করলেও পরিস্থিতির ওপর দূতাবাসের পক্ষ থেকে নজর রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে বিলটি চূড়ান্ত হলে সমস্যা বাড়বে।

কুয়েতের প্রধানমন্ত্রী যিনি সাংবিধানিকভাবে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী তিনি বলেছেন দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে বিদেশি শ্রমিক এবং কর্মচারীদের সংখ্যা। করোনা অতিমারী এবং জ্বালানি তেলের দামের সাম্প্রতিক অধোগতি থেকেই কুয়েতের সংসদের চিন্তাভাবনা এই খাতে বইছে - বলা হচ্ছে একথাও। বিশিষ্ট সংবাদপত্র গালফ নিউজ-এ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অবশ্য অন্য ইঙ্গিত বহন করছে। কর্মরত বহিরাগতদের সংখ্যা কমানো নিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোতে এই মুহূর্তে আলাপ-আলোচনা বেড়ে চলেছে বলে সংবাদে প্রকাশ। ভারতের বিদেশমন্ত্রকের পক্ষ থেকে করা একটি মন্তব্য এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে। বলা হয়েছিল কুয়েতে স্থিত ভারতীয়রা ওই দেশের সমস্ত স্তরেই রয়েছেন। অতীতে এমনও দেখা গেছে ভারত এবং কুয়েত দুদেশের দ্বিপাক্ষিক স্তরে যে সমস্ত চুক্তি সম্পাদিত হয় সেগুলিতেও কুয়েতে বসবাসকারী ভারতীয়রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন। সামগ্রিকভাবে কুয়েতে কর্মরত ভারতীয়দের সম্পর্কে ধারণা হলো, তাঁরা অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ কঠোর পরিশ্রমী এবং আইন মেনে চলা বিদেশি নাগরিক। তাই বিদেশি শ্রমিক এবং কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে ভারতীয় এবং অভারতীয় বিদেশিদের সেদেশ থেকে স্বদেশে পাঠানোই হলো বিষয়টির সহজ সমাধান তা এই মুহূর্তে একতরফাভাবে চিহ্নিত করা মুশকিল। তবে কুয়েতের সংসদীয় স্তরে ‘অশিক্ষিত বা কেবলমাত্র নাম সই করার যোগ্যতা সম্পন্ন বিদেশিদের উপস্থিতি’ নিয়েও কটাক্ষ করা হয়েছে। ভারতীয় দূতাবাসের তথ্য হিসেবে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন সমূহে যা উল্লেখ করা হয়েছে সেটা এরকম - ২৮ হাজার ভারতীয় নাগরিক কুয়েতের সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত আছেন। তাদের মধ্যে মূলত রয়েছেন নার্স, প্রযুক্তিবিদ এবং তেল সংস্থায় কর্মরতরা। আর কুয়েতের বেসরকারি সংস্থাগুলিতে ৫.২৩ লক্ষ ভারতীয় কাজ করেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

কুয়েতের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেছেন অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোকে মজবুত করার বিষয়ে তার প্রস্তাবের কথা। তিনি বলেছেন, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্পের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অর্থনীতির অন্যান্য দিকে নজর দিতে হবে। আবার কুয়েতের আইন প্রণেতারা এই মুহূর্তে যে সুসংহত আইনি পরিকল্পনার মাধ্যমে ‘ডেমোগ্রাফিক ইমব্যালেন্স’ বা জনতাত্ত্বিক অসাম্য কমাতে চাইছেন সেটা বিদেশিদের ক্ষেত্রে কোটা নির্ভর ব্যবস্থা হিসেবে গড়ে তোলা হতে পারে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে, বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে চলতি বছরে ৭০ শতাংশ আগামী বছরে ৬৫ শতাংশ এই হারে কমানো হবে সংখ্যা।

এমনিতে বিভিন্ন কারণে কুয়েত থেকে প্রতিবছরই ভারতীয় শ্রমিক এবং কর্মচারীদের অনেককেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়। যাকে পরিভাষায় বলা হয় ডিপোর্টেশন। ২০১৬ সালে ২৯ হাজার এবং ২০১৫ সালে ২৫ হাজার ভারতীয়কে দেশে পাঠানো হয়েছিল।

এদিকে গালফ নিউজ পত্রিকার একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কুয়েতের মহিলা নাগরিক যারা অকুয়েতি কোনো ব্যক্তিকে বিয়ে করেছেন তারা তাদের সন্তানের নাগরিকত্ব চেয়ে একজোট হয়েছেন। কারণ বিবাহ সূত্রে বিদেশি স্বামীর নাগরিকত্ব প্রদান মহিলাদের ক্ষেত্রে কুয়েতে নিষিদ্ধ। কুয়েতি পুরুষরা বিদেশি বিবাহ করলে তার স্ত্রী নাগরিকত্ব পাবেন পাঁচ বছর সংসার করার পর। কারণ জন্মের পর ২১ বছর বয়স পর্যন্ত ওই মহিলাদের সন্তান নাগরিকদের অধিকার ভোগ করলেও তারপর তাদের সে অধিকার থাকে না। বিদেশি নাগরিককে বিবাহ করেছেন এমন কুয়েতি মহিলাদের সন্তানদের সংখ্যা এই মুহূর্তে ৫০ হাজারেরও বেশি। এই বিষয়টি অভিবাসী শ্রমিক আইন এবং নাগরিকত্ব আইন-এর নয়া বয়ানে প্রভাব ফেললে অনেকেই আশ্চর্য হবেন না।

গৃহকর্ম সহ নানা কাজে যুক্ত বিদেশি পরিচারক-পরিচারিকার সংখ্যা যথেষ্ট বেশি। এদের মধ্যে ভারতীয়রা ছাড়াও রয়েছেন ফিলিপিনস, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার নাগরিকরাও। আর পেশা হিসেবে এই ধরনের বিভিন্ন কাজ বেছে নিতে কুয়েতি নাগরিকদের অসম্মতি গোটা দুনিয়া জানে। তাই সে দেশের বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সরকারের এই অবস্থানকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন না, এমন লেখা বেরোচ্ছে। টুইটারেও কুয়েত সরকারের দাবির প্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে নানা মন্তব্য রয়েছে। তবে কর্মসংস্থানের প্রশ্নে যদি এই ভারতীয়রা দেশে ফিরে আসেন, সে ক্ষেত্রে নোটবন্দী জিএসটি চালু ও লকডাউনের জন্য তাদের পক্ষেও অবস্থাটা আরো কঠিনতর হবে। কারণ আমাদের দেশে বেকারির বর্তমান হার গত ৪৫ বছরের তুলনায় রেকর্ড গড়ে নিম্নগামী। তাই সমস্যাটা বহুমুখী। একমাত্রিক সমাধান সম্ভব নয় বলেই ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে।