করোনায় আক্রান্ত ব্রাজিল
লালন ফকির
লাতিন আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ ব্রাজিল বর্তমানে ব্যাপকভাবে করোনা ভাইরাস বা কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত। জুলাই মাসের দু’তারিখের তথ্য অনুযায়ী আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যার নিরিখে বিশ্বে ব্রাজিলের স্থান দ্বিতীয়। এখানে এ পর্যন্ত ১৪ লক্ষ ৭৬ হাজার ৮৮৪ জন মানুষ আক্রান্ত এবং ৬১হাজার ৩১৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রথম স্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এখানে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে ২৮ লক্ষ ১৪ হাজার ২৮৯ এবং ১লক্ষ ৩১হাজার ২৩৩ জন। লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের সংক্রমণের প্রাবল্য ব্রাজিলের তুলনায় অনেক কম। এমনকি চলতি শতাব্দীর শুরু থেকে বিগত দুই দশকে অর্থাৎ ওয়ার্কার্স পার্টির শাসনকালে ব্রাজিলের জনগণ অন্য কোনো মহামারী বা অতিমারীতে এইভাবে আক্রান্ত হয়নি। ব্রাজিলবাসীর এক বড় অংশ মনে করেন সাম্প্রতিক অতিমারীর জন্য রাষ্ট্রপতি জাইরে বোলসোনারোর নীতি ও কার্যকলাপ দায়ী। সম্প্রতি জানা গেছে ব্রজিলের রাষ্ট্রপতি জাইরে বোলসোনারো করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
ব্রাজিলের প্রথম করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ফেব্রুয়ারি মাসে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের চরম দক্ষিণপন্থী শাসক রাষ্ট্রপতি বোলসোনারো বিষয়টিতে আদৌ গুরুত্ব প্রদানে রাজি হননি। একে ছোটো মাপের ফ্লু এবং ঠান্ডাজনিত অসুখ বলে চিহ্নিত করে নির্লিপ্ত থাকেন। একটি ব্যাপারে দেশের প্রচার মাধ্যমের প্রচারকে ভণ্ডামি বলে তিনি আখ্যা দেন। এমনকি বিভিন্ন তথ্য পরিসংখ্যানগুলি চেপে রাখতেও তিনি সমানভাবে ছিলেন সক্রিয়। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে নির্দেশিকা জারি করেছিল ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি তা কার্যকর করতে অস্বীকার করেন। এসব নির্দেশিকার মধ্যে ছিল পরীক্ষা করা, রোগগ্রস্তদের সংস্পর্শে না আসা, শারীরিক দূরত্ব রক্ষা, এবং রোগগ্রস্তদের পৃথকভাবে রাখা প্রভৃতি। অধিকাংশ দেশই সেসব নির্দেশ অনুসরণ করলেও ব্রাজিল তা করেনি, উপরন্তু বোলসোনারো স্বাস্থ্যবিধি অস্বীকার করে তাঁর দলীয় সমর্থকদের নিয়ে জমায়েত, মিছিল প্রভৃতি কর্মসূচি পালন করেছেন। এই জনবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি বিরোধিতা করে যেসব প্রাদেশিক গভর্নর আক্রান্তদের পৃথকবাসের ব্যবস্থা করেছেন বোলসোনারো তাদের সক্রিয় বিরোধিতা করেছেন। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের জাতিবিরোধী বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ন্যায় বোলসোনারো একজন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের মতো নিরাময়ের জন্য ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নামে ওষুধ সুপারিশ করেন। এটা ঠিক কোথাও কোথাও এই ওষুধ ব্যবহৃত হয়েছে, কিন্তু তার সাফল্য যে একশো ভাগ তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কিন্তু বোলসোনারো এসব কর্ণপাত করেননি। বস্তুত, তাঁর কোভিড ১৯ মোকাবিলার পদ্ধতি প্রকরণের সাথে ঐকমত্য না হয়ে ইতিমধ্যে একমাসের মধ্যেই দু’জন স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এরা দু’জনেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এদের অন্যতম লুইস হেনরিক ম্যানডেট শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ও অস্থিবিশারদ। তিনি শারীরিক দূরত্ব রেখে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করায় রাষ্ট্রপতি তাঁকে বরখাস্ত করেন। অপরজন নেলসন টেক একজন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ। এইসব চিকিৎসকদের বরখাস্ত করে সেখানে নিয়োগ করা হয়েছে এদুয়ার্দো পাঞ্জেলো নামে একজন সামরিক জেনারেলকে। এই ব্যক্তি ব্রাজিল অলিম্পিকে নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। চিকিৎসা সংক্রান্তে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। তার যোগ্যতা একটিই - তিনি বোলসোনারোর অনুগত।
ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম কোভিড ১৯ সংক্রমিত রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলেও ব্রাজিল সরকার প্রথম জুন মাসে সরকারি ওয়েবসাইটে তা প্রচার করেন। পরের দিন যখন ওয়েবসাইটটি আবার প্রদর্শিত হয় তখন দেখা যায় পুরনো রেকর্ড সব উধাও হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আক্রান্ত, নিরাময় এবং মৃত্যুর সংখ্যার মতো প্রয়োজনীয় কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। বিরোধীরা করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচনা করেছেন। রডরিগো মাইয়া নামে একজন সরকারবিরোধী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতা ট্যুইটবার্তায় লিখেছেন, স্বাস্থ্যদপ্তর সূর্যের আলো একটা ছাঁকনি দিয়ে আটকাতে চাইছে। তাদের দায়িত্ব সরকারি তথ্য-পরিসংখ্যানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা। এরফলে সরকারি তথ্য ঠিকরকম প্রকাশ করতে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়।
সাও পাওলো মেডিক্যাল স্কুলের সমীক্ষা অনুযায়ী, কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সরকারি তথ্যের অন্তত ১৫গুণ বেশি। বোলসোনারো দেশের সামরিক বাহিনী পরিচালিত ওষুধ কারখানায় বিপুল পরিমাণে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন উৎপাদন করতে দিয়েছেন। এর কাঁচামাল বিপুল পরিমাণে ভারত থেকে আমদানি করা হয়। সংক্রমণ বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে দেশের বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ, যে সমস্ত ওষুধ বিশ্ব জুড়ে এখনও স্বীকৃতি লাভ করেনি তার উৎপাদনে এত ব্যয় সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বোলসোনারো পৃথকবাস এবং শারীরিক দূরত্ববিধি অনুসরণ করার চরম বিরোধী। এসব স্বাস্থ্যবিধির বিরোধিতা করে তিনি তাঁর সমর্থকদের সাধারণ জীবনযাত্রা পরিচালনা করতে পরামর্শ দিয়েছেন। এক বিবৃতিতে কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এই মৃত্যু সকলের স্বাভাবিক পাওনা। যাই হোক শেষপর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। এর পরিণতিতেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোভিড সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রকাশ করা শুরু করেন। সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক গিলমার মেন্ডেল বলেছেন, তথ্যের চালাকি হলো “এক ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিফলন।” ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বোলসোনারোর বেপরোয়া মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেছেন লুলা ডি সিলভা। সাও পাওলোতে তাঁর বাসস্থান থেকে সিএনএন-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি রাষ্ট্রপতিকে দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অপদার্থ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভুল তথ্য দেওয়ার জন্য বোলসোনারোর কঠোর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন এবং তা হলো ‘‘ভর্ৎসনা’’ বা ‘‘ইমপিচমেন্ট’’ করা।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে কোভিড ১৯-কে কেন্দ্র করে ব্রাজিলীয় সমাজের মধ্যে দু’টি প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর একটি হলো, গোটা দেশটাই এখন দক্ষিণপন্থী এবং বামপন্থী এই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। রাষ্ট্রপতি বোলসোনারো প্রকাশ্যে বলে থাকেন, তিনি দেশের সংবিধানকে উপেক্ষা করে ব্রাজিলে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার বিরোধী। অবশ্য এব্যাপারে তিনি কতটা আন্তরিক তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, তিনি তাঁর মন্ত্রিসভার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সামরিক বাহিনীর পূর্বতন জেনারেলদের নিযুক্ত করেছেন। এছাড়া ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ব্রাজিলে যে সামরিক শাসন ছিল তিনি তার ঘোরতর সমর্থক। ব্রাজিলের বর্তমান সংবিধান সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠার বিরোধী। কিন্তু উপরাষ্ট্রপতি জেনারেল হ্যামিল্টন মৌরাও প্রকাশ্যেই সামরিক শাসনের পক্ষে ওকালতি করেন। এর বিপরীত দিকে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃত্বে বামপন্হীরা এব্যাপারে তাদের শক্তিকে সংহত করছে। কোভিড ১৯ মোকাবিলায় বোলসোনারোর ব্যর্থতাকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে তারা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করছে। ফলে মানুষকে তারা আন্দোলনমুখী করতে সক্ষম হয়েছে।
ব্রাজিলীয় সমাজে দ্বিতীয় প্রবণতা হলো, ব্রাজিলে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি এবং তাকে কেন্দ্র করে জনগণের লড়াই। একই সাথে দুর্নীতি ও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতাকে কেন্দ্র করে জনগণের ক্রমবর্ধমান আন্দোলন শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব তৈরি করছে। বোলসোনারো এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে তদন্ত চলছে। সম্প্রতি বোলসোনারোর প্রাক্তন আইনমন্ত্রী, যিনি একসময়ে লুনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, সরকারি উকিলের সাথে আট ঘণ্টাব্যাপী সাক্ষাৎকারে বোলসোনারোর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ জমা দিয়েছেন। এই সংবাদ প্রকাশিত হবার পর একে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। জনগণের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ সংগঠিত হতে থাকে। বিরোধীরা দাবি করে “ফোরা বোলসোনারো’’ অর্থাৎ বোলসোনারো হঠাও। বর্তমানে ব্রাজিলে এই স্লোগানটি দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর পরিণতিতে শেষ পর্যন্ত বোলসোনারোকে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।