E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

গভীর সঙ্কটে আফগানিস্তান

অমিতাভ রায়


কাবুলে বিক্ষোভে মহিলারা।

প্রায় বিনা যুদ্ধে আফগানিস্তানের তখতে আবার তালিবান। স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী পূর্ব নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী দেশে ফিরে গেছে। সরকার গঠনের কাজ শুরু হওয়ার আগেই দেশের চরিত্র এর মধ্যেই বদলে গেছে। ইসলামিক রিপাবলিক অফ আফগানিস্তান এখন অতীত। দেশের স্বাধীনতা দিবস ১৯শে অগস্ট ২০২১ থেকে দেশের নাম হয়েছে ইসলামিক এমিরেট অফ আফগানিস্তান।

ইতিমধ্যে তেত্রিশ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়েছে তালিবানের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়, অনেকের মতে হস্তক্ষেপে, গঠিত মন্ত্রিসভায় কট্টরপন্থী মৌলবাদী সংগঠন ‘রেহবারি সূরা’-র নেতা অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বলে ঘোষণা করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় পাশতুন গোষ্ঠীর প্রাধান্য বজায় আছে। তেত্রিশ জন মন্ত্রীর মধ্যে তিরিশ জন পাশতুন। এই তিরিশ জন আবার কান্দাহার ভিত্তিক হাক্কানি নেটওয়ার্ক-এর সদস্য। এমনকী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের জন্য হাক্কানি নেটওয়ার্ক-এর গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদী হিসেবে সুপরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছিল ৫০ লক্ষ ডলার। পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আই এস আই-এর সঙ্গে হাক্কানি নেটওয়ার্ক-এর বরাবরই সুসম্পর্ক। মন্ত্রিসভা গঠনের কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাবুলে পৌঁছে যান আই এস আই-এর প্রধান। নতুন সরকারে দেশের অন্যান্য গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব কম হওয়ার ফলে আগামী দিনে অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা থেকে গেল বলে অনেকের ধারণা।

আপাতদৃষ্টিতে আধুনিকতম সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত তালিবানের দাপটে দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সশস্ত্র লড়াই সর্বব্যাপী নয়। কোথাও কোথাও তো ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। মার্কিন বাহিনী চলে গেলেও আসরে উপস্থিত পাকিস্তান। পঞ্জশির উপত্যকায় পাকিস্তান সেনা প্রত্যক্ষভাবে তালিবানের হয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবরে প্রকাশ। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেও গোলাগুলি চলছে।

শিক্ষার আঙিনায় ইতিমধ্যেই তালিবানের ফতোয়া জারি হয়েছে। আগামী দিনে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ছেলেরা কতদিন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে তা-ও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। দেশে তো অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মাদির বালাই নেই। কাজ চালানোর মতো লেখাপড়া শেষ করেই প্রথম সুযোগে সকলে দেশান্তরী হতে চায়। আশার কথা, এমন মধ্যযুগীয় ভয়াবহ ফতোয়ার বিরুদ্ধে কাবুলের পথে পথে বিক্ষোভ মিছিলে ছাত্রীরা পা মেলাচ্ছেন। তাঁদের সহপাঠী ছাত্র এবং শিক্ষকরাও সঙ্গে আছেন।

টিভি, রেডিও, টেলিফোন, ব্যাঙ্ক, সংবাদমাধ্যম প্রভৃতি পরিষেবা ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না। প্রথমত, কোনোরকম বিনোদনমূলক বিষয়ে তালিবানের ঘোরতর আপত্তি। দ্বিতীয়ত, পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মীদের অধিকাংশই মহিলা। বাড়ির বাইরে মেয়েদের বেরোনোর ব্যাপারে তালিবান যে সমস্ত শর্ত আরোপ করেছে তার ফলে অনেকের পক্ষেই কর্মজীবন বজায় রাখা কঠিন।

আজকের দিনে ইন্টারনেট, টিভি এবং রেডিও বন্ধ হয়ে গেলে সমাজে তার কী প্রভাব পড়বে তা হয়তো তালিবানের জানা নেই। তবে কর্মীদের বিশেষত, মহিলা কর্মীদের অনুপস্থিতিতে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। তার প্রভাব জনজীবনে পড়তে শুরু করেছে। তালিবান অবিশ্যি নির্বিকার।

অনেকের ধারণা তালিবানের নতুন সংস্করণ অনেক বেশি মার্জিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহিলাদের উপর হামলা ও নৃশংস অত্যাচারের যে সব খবর পাওয়া যাচ্ছে তা-তে কী মনে হচ্ছে তালিবান শুধরে গেছে?

তালিবান সম্পর্কে সেই অন্য রকমের ধারণার বশবর্তী হয়েই হয়তো ইদানীং তালিবানকে সন্ত্রাসী না বলে যোদ্ধা বলা হচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিবৃতিতে তালিবান শব্দটিই বাতিল হয়ে গেছে। ভারতের সভাপতিত্বে আগস্ট মাসে আয়োজিত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভার পর যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে সেখানে তালিবান শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। ভয়ে অথবা ভালোবাসায় আন্তর্জাতিক মঞ্চ এমন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে চাইছে কিনা বলা মুশকিল।

ক্ষমতাসীন তালিবান সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চ অবিশ্যি আফগানিস্তানের নিত্যদিনের সঙ্কট নিরসনে কোনো সিদ্ধান্ত এখনও পর্যন্ত নেয়নি। আফগানিস্তানের হাতে এই মুহূর্তে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের হাজারো মারণাস্ত্র। কিন্তু খাদ্য? দেশের মানুষের পাতে দিনের শেষে রুটি-সবজি-গোস্ত পৌঁছে দেওয়ার বন্দোবস্ত আছে কী?

তালিবান ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু অস্ত্র দিয়ে তো পেট ভরবে না, তার জন্য যথার্থ খাদ্য নীতি তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে তৈরি হয়েছে খাদ্যসঙ্কট। আফগানিস্তানের বাজারে রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে আফগান মুদ্রার দাম। এখনই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের সমস্যা আরও বাড়তে পারে। তাই হাতে বেশি সময় নেই, এখনই যা করার করতে হবে।

আফগানিস্তান মূলত বিদেশের অর্থ সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। সরকারের বাজেটের ৭৫ শতাংশ বিদেশি দান খয়রাতির উপর নির্ভরশীল। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ডি আফগানিস্তান ব্যাঙ্ক বা চলতি কথায় ‘ড্যাব’-এর ৯০০ কোটি ডলার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ নিউ ইয়র্কে গচ্ছিত আছে। আপাতত তা নাগালের বাইরে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার অর্থাৎ আই এম এফ জানিয়ে দিয়েছে তাদের কাছে আফগানিস্তানের যে ৪৫ কোটি ডলার জরুরি পুঁজি জমা আছে তা এখন ব্যবহার করা যাবে না। বিশ্বব্যাঙ্কও সহায়তা বন্ধ করেছে। তালিবানের চরমপন্থা নিয়ন্ত্রণ করতেই হয়তো এমন আর্থিক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে তালিবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান কী ভাবছে তা এখনও জানা যায়নি।

রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায় আফগানিস্তান। এ মাসেই শেষ হতে পারে সঞ্চিত খাদ্য ভাণ্ডার। ইতিমধ্যে আফগানিস্তানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে তিন কোটি ৮০ লক্ষ মানুষের দু’বেলা খাবার জোটানো অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। শীত আসছে। আবহাওয়া প্রতিকূল হবে আরও। অন্য দিকে এই বছর দেশের বেশ কয়েকটি প্রদেশে খরা হয়েছে। সাধারণ মানুষের হাতে অর্থ নেই বললেই চলে, এর ফলেই তৈরি হতে পারে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। শীতের আগে যদি যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক সাহায্য এসে না পৌঁছয়, তা হলে সেপ্টেম্বর শেষ হওয়ার আগেই খাদ্য সংগ্ৰহ সম্ভব হবে না। ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাবে। খাদ্যপণ্যের সহায়তা না পাওয়া গেলে মাস খানেকের মধ্যেই আফগানিস্তানে ফুরোতে পারে সঞ্চিত খাদ্য। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে খাদ্যের মূল্যের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমেছে।

খাদ্যপণ্যের সরবরাহ নেই বলে বাজার অগ্নিমূল্য। দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি সমাসন্ন। সরকারি কর্মচারীদের বেতন এমনিতেই অনিয়মিত। তিন থেকে ছয় মাস অনেকেই মাইনে পাননি। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে জানা নেই। ব্যাঙ্কগুলিতে অর্থের জোগান নেই। ব্যাঙ্কের সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই নাকি সরকারি কর্মচারী। ব্যাঙ্ক খোলা থাকলেও কর্মী ও নগদের অভাবে কোনো কাজই কার্যত হচ্ছে না। এ টি এম’র সামনে মানুষ কাতার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষাই সার। এ টি এম-এ আফগানি ফুরিয়ে গেছে। নতুন করে কখন আফগানি ঢালা হবে কেউ জানে না।

আফগানিস্তানের সম্পন্ন পরিবারের কয়েক হাজার মানুষ হয়তো নিয়ম মেনে দেশান্তরী হয়েছেন। যাঁদের সঙ্গতি নেই? তাঁদের মধ্যে অনেকে হয়তো লুকিয়ে চুরিয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবেন। কিন্তু দু’ বেলা দু’ টুকরো রুটির আশায় কতজন দেশের মধ্যেই বাস্তুহারা হতে চলেছেন তার খবর কে রাখে। এমনিতেই দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে জর্জরিত দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত দেশে অনেকেই বহুকাল ধরে বাস্তুচ্যুত। এখনও পর্যন্ত তাঁদের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়নি। তার উপরে নতুন করে যাঁরা দেশের মধ্যেই বাস্তুহারা হতে চলেছেন তাঁদের জন্য বোধ হয় এতটুকু সহানুভূতিও জুটবে না।

তালিবান ধর্মীয় অনুশাসন নিয়ে ব্যস্ত। কট্টর মৌলবাদী আচরণ বিধি সকলে মেনে চলছেন কিনা তার জন্য সদাসর্বদা নজরদারি বহাল থাকবে। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ নিয়ে তালিবান চিন্তিত এমনটা আগেও বলা যায়নি, এখনও বলার মতো সুযোগ আসেনি।

সরকারের তিন লক্ষ আর তালিবানের নিজের আশি হাজার সৈন্যের নিয়মিত ভরণপোষণ এখন কী করে হবে সেটাও নিশ্চয়ই ভাববার বিষয়। এঁদের প্রত্যেকের হাতে সমরাস্ত্র রয়েছে। নিয়মিত বেতন, ভাতা এবং খাদ্য না পেলে সশস্ত্র বিক্ষোভের সম্ভাবনা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদীদের সংগঠন সেই আলোড়ন সামাল দিতে পারবে তো? তালিবান সদস্যদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে কাবুল, হেরাট সহ বিভিন্ন শহরে মহিলাদের বিক্ষোভ সমাবেশ আয়োজিত হচ্ছে। পাকিস্তান ও তালিবানের বিরুদ্ধে মহিলারা স্লোগান দিচ্ছেন। এই দৃশ্য দেখতে আফগানিস্তান অভ্যস্ত নয়। আগামী দিনে এইসব বিক্ষোভ সমাবেশ বন্ধ করার জন্য তালিবান আবার মধ্যযুগীয় বর্বরতা ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হবে কিনা তা বলা মুশকিল। তবে মহিলাদের দৃঢ়তা প্রমাণ করে দিচ্ছে সে পথ তালিবানের জন্য মোটেও মসৃণ হবে না।