তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে
লালন ফকির
আরব বসন্তের সূচনা ২০১১ সালে উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত তিউনিসিয়ায়। একনায়কতন্ত্রী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে এই আন্দোলন জয়যুক্ত হয়েছিল। এর সাফল্যের প্রভাব আরব দুনিয়ার একের পর এক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে সেই তিউনিসিয়ায় সৃষ্টি হয়েছে এক চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। রাষ্ট্রপতি কাইস সৈয়দ সম্প্রতি জাতীয় সংসদ বাতিল করে দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভাকে বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে এক রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর প্রভাব অন্যান্য আরব দেশকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে এর রাজনৈতিক প্রভাব অপরিসীম। এ সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে দেশটির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন।
উত্তর আফ্রিকায় ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত তিউনিসিয়া অতীতে ইতালি ও ফ্রান্সের স্বার্থের সংঘাতের মধ্যে পড়ে শেষ পর্যন্ত ১৮৮১ সালে ফ্রান্সের অধিকারে যায়। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়ী হয়ে ১৯৫৬ সালে দেশটি স্বাধীন হয় এবং ১৯৫৭ সালে প্রজাতন্ত্রী হয়। প্রাচীন কার্থেজ জনগোষ্ঠীর এখানেই বসবাস।
আরব দেশগুলির মধ্যে তিউনিসিয়ায় মহিলাদের অধিকার সর্বাধিক সুরক্ষিত। এখানে মুসলিম মৌলবাদ সেইভাবে বিশেষ মাথাচাড়া দিতে পারেনি। ১৯৮৭ সাল থেকে রাষ্ট্রপতি জিন আল আবিদিন বেন আলি কার্যত একনায়কত্ব চালান। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে আন্দোলনের সূচনা ঘটে, তাকেই ‘আরব বসন্ত’ বলা হয়ে থাকে। এই আন্দোলনের চাপে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐক্যের সরকার। ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে নির্বাচিত হয় গণপরিষদ। ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে নতুন সংবিধানের দ্বিতীয় খসড়া প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।
২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি বেন আলির পদত্যাগের পর প্রায় এক দশক কাল ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই দেশে অসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সময়কালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলিও অবাধ ও নিরপেক্ষতার সাথেই সম্পন্ন হয়েছিল। এনাহডা (Ennahda) পার্টি পরিচালিত তিউনিসিয়ার সরকার আরব দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে প্রথম দেশ যারা নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করেছিল। নির্বাচনে সমস্ত রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছিল।
শাসক এনাহডা পার্টির সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই দলটিই ভোটের উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করতো। একইসাথে এই দল শাসন ক্ষমতা কখনই কেন্দ্রীভূত করত না, যদিও তারা জানত যে, প্রদেশ স্তরে গঠিত আঞ্চলিক দলগুলি মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্দেহের চোখে দেখে। এনাহডা পার্টির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির এই পদক্ষেপকে ‘তিউনিসিয়ার গণতন্ত্র ও তার সংবিধানে’র বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সৈয়দ ফারজানি নামক এক বিরোধী সাংসদ বলেছেন যে, ‘আরব বসন্তের শেষ দ্বীপ শিখাটি নির্বাপিত হলো’। তিউনিসিয়ার সর্ববৃহৎ ট্রেড ইউনিয়ন তিউনিসিয়ান জেনারেল লেবর ইউনিয়ন (ইউজিটিটি)-র সাথে শাসকদল এনাহডা’র মতপার্থক্য থাকলেও উভয়েই একইসাথে রাষ্ট্রপতির পদক্ষেপকে নিন্দা করেছে।
প্রসঙ্গত, তিউনিসিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুড পরিচালিত সরকার তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই এই সরকারের পতন ঘটে। মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিষিদ্ধ করা হয় এবং এদের বহু সমর্থক, কর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। যে সমস্ত দেশে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল যেমন মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া ও লিবিয়া ভিন্ন ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছিল।
পশ্চিমী দুনিয়ার দেশগুলিতে এই অঞ্চলের আরব বসন্তকে ব্যবহার করে আরব দুনিয়ার প্রজাতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে উৎখাত করতে ব্যবহার করেছে যাতে এই অঞ্চলে কোনো দেশ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বিদেশ নীতির অধিকারী না হয়। পশ্চিমী দেশগুলি ও তাদের বশংবদ রক্ষণশীল আরব দেশগুলি বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া সাজানো বিক্ষোভগুলিকে সেই দেশের সরকার পরিবর্তিত লক্ষ্যে ব্যবহার করছে। এর বড়ো উদাহরণ হলো লিবিয়া। লিবিয়ার রাষ্ট্রপতি গদ্দাফির হত্যার পর দেশটি এখন গৃহযুদ্ধের এবং নৈরাজ্যের সম্মুখীন হয়েছে। আরব বসন্তের নেতিবাচক ফলাফল থেকে দেশটি এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি। অন্যদিকে তিউনিসিয়া অপেক্ষাকৃতভাবে শান্তিপূর্ণ পথে অসামরিক শাসনপর্বে উত্তরিত হয়েছে।
কিন্তু তিউনিসিয়ার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। দেশটির অর্থনীতি প্রধানত পর্যটন শিল্পকেন্দ্রিক। রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে পড়ে স্বাভাবিক নিয়মেই পর্যটন শিল্প আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কোভিড সংক্রমণ। অধিকাংশ তিউনিসিয়াবাসীর অভিযোগ যে, একনায়কতন্ত্রী সরকারের উচ্ছেদ ঘটলেও, মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোনও উন্নতি ঘটেনি। এই সময়ের মধ্যে তিউনিসিয়ার জাতীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটেছে। রপ্তানি বাণিজ্যও আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি। একনায়কতন্ত্রী সরকারের পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার পর পূর্বের তুলনায় আর্থিক নীতির পরিবর্তন ঘটেনি। বরং ফান্ডব্যাঙ্কের নির্দেশিত একই আর্থিক নীতি অনুসৃত হচ্ছে। সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ধারণা হলো এই যে, গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে শুধুমাত্র বাক্-স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, অর্থনৈতিক বা অন্য কিছু অর্জিত হয়নি। অর্থাৎ জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে।
এর প্রতিফলন নির্বাচনে প্রতিফলিত হচ্ছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন, কিন্তু ২০১৯ সালে ৪২ শতাংশ ভোটদাতা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তিউনিসিয়ার জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতির জন্য এনাহডা পার্টিকে দায়ী করে।
তিউনিসিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে শাসকদলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী হি চেন মেচেকি এবং জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ র্যাতচিড খানৌচির মধ্যে কেন্দ্রীভূত। খানৌচি এনাহডা পার্টির একজন প্রবীণ নেতা। এই বিরোধের পিছনে রয়েছে রাষ্ট্রপতি, যিনি ২০১৯ সালে নির্বাচিত হয়েছেন। ইনি তৃতীয়বারের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, বর্তমান রাষ্ট্রপতি সৈয়দের সাথে দেশের মূল স্রোতধারার কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক নেই। আরব প্রচারমাধ্যমগুলির মতে তিনি দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাবিদ এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ বলে পরিচিত একজন ব্যক্তিত্ব। তবে তিনি কোনো মূল স্রোতধারার রাজনীতিবিদ না হলেও, এনাহডা সহ প্রায় সমস্ত দলের রাজনৈতিক সমর্থন নিয়েই রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হয়েছিলেন।
কিন্তু বিগত কয়েক মাসের ঘটনাবলীতে দেখা যাচ্ছে যে, রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর অর্পিত ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করছেন। সম্প্রতি মন্ত্রীসভায় নতুন একজনের অন্তর্ভুক্তিতে তিনি আপত্তি করেছেন এবং সাংবিধানিক আদালত গঠনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করেছেন। করোনা অতিমারীর সময় এর প্রতিরোধে সরকারি ব্যর্থতা এবং জনগণের টিকাকরণের অব্যবস্থার প্রতিবাদের ফলে গণবিক্ষোভ সংগঠিত হচ্ছিল, তখন রাষ্ট্রপতি টিকাকরণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই অঞ্চলের দেশগুলির মধ্যে তিউনিসিয়ায় মৃত্যুহার সব থেকে বেশি।
রাষ্ট্রপতি সৈয়দের সাম্প্রতিক ঘোষণার দিন বিপুলসংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হন। রাজনৈতিক সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে সমস্ত মূল ধারার রাজনৈতিক দলের নেতারা তাদের সমর্থকদের সংসদ এলাকা এবং রাজপথ মুক্ত রাখতে আবেদন করেন। জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, সংবিধানের ৮০ নম্বর ধারা অনুযায়ী তিনি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, বাধ্য হয়েই দেশের নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁকে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে।
তিউনিসিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ উভয়েই মনে করেন যে, সংবিধানের ৮০ নম্বর ধারা রাষ্ট্রপতি তখনই প্রয়োগ করতে পারেন যখন সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিপজ্জনক হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। তাঁদের মতে এইরকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামিক দলগুলিও তাদের এই অবস্থানকে সমর্থন করেছে। সংবিধানে এও বলা আছে যে, এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে প্রধানমন্ত্রী ও অধ্যক্ষের সাথে রাষ্ট্রপতির আলোচনা করতে হবে। উভয়েই জানিয়েছেন যে, এই ধরনের কোনো আলোচনা তাঁদের সাথে হয়নি।
তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতি তাঁর এই পদক্ষেপকে কার্যকরী করতে সেনাবাহিনীর উপর ভরসা করছেন। তাঁর ঘোষণার পরই সেনাবাহিনী সংসদ ভবনকে ঘিরে রেখে শাসকদলের বেশ কিছু নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে। আরব দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম আলজাজিরার দপ্তর তালাবন্ধ করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমী দুনিয়া তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতিকে অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করে নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসভা গঠনের জন্য পরামর্শ দিয়েছে।
আরব দুনিয়ার দেশগুলির মধ্যে মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি প্রকাশ্যেই তিউনিসিয়ার রাষ্ট্রপতির পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে। আলজিরিয়ার সরকারি কর্তৃপক্ষ মনে করে যে, এই সাংবিধানিক অভ্যুত্থানের পিছনে মিশর ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ভূমিকা আছে। আগামীদিনে তিউনিসিয়ার ঘটনার প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশ বিশেষত লিবিয়া এবং আলজিরিয়াতে পড়তে বাধ্য। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ইসলামিক মৌলবাদ বিশেষত মুসলিম ব্রাদারহুডের সাহায্যে এই অঞ্চলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে উদ্যোগী হতে পারে। সুতরাং, এই অঞ্চলের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে এর বিরুদ্ধে সংগঠিত উদ্যোগ নিতে হবে।