ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টির ত্রয়োদশ কংগ্রেস
ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি (কমিউনিস্ট পার্টি অব ভিয়েতনাম-সিপিভি)’র ত্রয়োদশ জাতীয় কংগ্রেস ২৬ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি হ্যানয়তে অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে ভিয়েতনামকে সমাজতন্ত্রমুখী উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্য ঘোষিত হয়েছে কংগ্রেসে।
সিপিভি’র ৫১ লক্ষেরও বেশি পার্টি সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১৫৮৭ প্রতিনিধি কংগ্রেসে উপস্থিত ছিলেন। এঁদের মধ্যে ১৯১ জন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য; প্রদেশগুলি, কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত শহরগুলি ও কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত পার্টি সংগঠনগুলি থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি ছিলেন ১৩৮১ জন এবং বিদেশে থাকা পার্টি সংগঠনগুলি থেকে নির্বাচিত ১৫ জন প্রতিনিধি ছিলেন। পুরুষ প্রতিনিধি ১৩৬৫ (৮৬.০১%) এবং মহিলা প্রতিনিধি ২২২ (১৩.৯৯%)। জনজাতি প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল ১৭৫ (১১.০৩%)।
পার্টি কংগ্রেসে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং সেগুলি গৃহীত হয়েছে। গৃহীত দলিলগুলি হলোঃ ১) রাজনৈতিক প্রতিবেদন; ২) ২০১১-২০-১০ বছরের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল ফলাফলের রিপোর্ট, ২০২১-৩০-আগামী ১০ বছরের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কৌশল তৈরি; ৩) ২০১৬-২০ সময়কালে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নের রিপোর্ট এবং পরবর্তী ৫ বছর ২০২১-২৫ সময়পর্বের পরিকল্পনা; ৪) দ্বাদশ সময়পর্বে পার্টি গড়ে তোলা এবং পার্টি সংবিধি রূপায়ণের পর্যালোচনা রিপোর্ট; এবং ৫) দ্বাদশ সময়পর্বে পার্টি নেতৃত্ব এবং পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পরিচালনার পর্যালোচনা রিপোর্ট।
গত পার্টি কংগ্রেসে এবং দশ বছরের উন্নয়ন কৌশল দলিলে নির্ধারিত বহু পরিকল্পনা, লক্ষ্য এবং কাজ পার্টি সাফল্যের সাথে সমাধা করেছে বলে কংগ্রেস অভিমত প্রকাশ করেছে। দইমই (পুনর্নবীকরণ নীতি) রূপায়ণে পার্টি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এই অভিমত তাকেই সূচিত করছে। ‘দইমই’র রূপায়ণ গত ৩৫ বছর ধরে চলছে। কংগ্রেসে বলা হয়েছেঃ এতো সাফল্য সত্ত্বেও কিছু ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েই গেছে। ২০৪৫সালের মধ্যে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ ভিয়েতনামের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে হলে আগামী পাঁচ বছরে এগুলিকে অতিক্রম করতে হবে।
২০২০ সালে যে দশটি দেশ সর্বোচ্চ আর্থিক বিকাশ প্রদর্শন করেছে ভিয়েতনাম তাদের মধ্যে অন্যতম। গত পাঁচ বছরে ভিয়েতনামের জিডিপি বিকাশের গড় হার ৫.৮ শতাংশ। সামাজিক-সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রেও প্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০১৫ সালে ১০ শতাংশ থেকে কমে ২০২০ সালে হয়েছে ৩ শতাংশ। মাথাপিছু গড় আয় যা ১৯৮৬ সালে ছিল ১০০ মার্কিন ডলার, তা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৭৫০ ডলার। দইমই নীতিসমূহের সূচনাও হয়েছিল ওই ১৯৮৬ সালেই।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিয়েতনামের সাফল্য বিস্ময়কর, বিশেষ করে ২০২০ সালে, কোভিড ১৯ অতিমারী বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। এর সাথে ভয়ঙ্কর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় গুরুতর আর্থ-সামাজিক ক্ষতি করেছে। কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ ‘‘মহান সংহতির শক্তি এবং সমাজতান্ত্রিক শাসনের উৎকৃষ্টতা; পার্টির নেতৃত্বে সমগ্র রাজনৈতিক ব্যবস্থার ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ় ও কার্যকরীভাবে যুক্ত হওয়া এবং জনগণের সমর্থনে ভিয়েতনাম আস্তে আস্তে অতিমারীকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। পর্যায়ক্রমে উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করা হয়েছে। জীবনয়াত্রায় সুস্থিরতা ফিরিয়ে আনা হয়। কংগ্রেস সমাপ্ত হয়েছে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে, পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, হোচিমিনের আদর্শের প্রতি আস্থায় স্থির থাকবে এবং প্রতিশ্রুত সমাজতন্ত্রের পথেই এগিয়ে যাবে। এই জন্য পার্টি ‘সত্যের প্রতি ঋজু দৃষ্টি রাখবে, সত্য বলবে’; ‘পুনর্নবীকরণ, অখণ্ডতা ও উন্নয়ন এবং কার্যক্ষেত্রে সংহতি, যৌথ প্রচেষ্ঠা ও ইচ্ছার ঐতিহ্যের’ পথেই থাকবে।
আগামী কয়েক বছরে ভিয়েতনামের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু স্মরণীয় অধ্যায়ের উদ্যাপন হবে। ১৯৭৫ সালে দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্ত হয় এবং উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীকরণ হয়। ২০২৫ সাল সেই ঘটনার ৫০ বছর। ২০৩০ সাল ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। আর ২০৪৫ সাল হবে গণপ্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম, বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক ভিয়েতনাম প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। পার্টি কংগ্রেসে সিদ্ধান্ত হয়েছেঃ ভিয়েতনামের ইতিহাসের এই তিনটি স্মরণীয় অধ্যায়কে মহাসমারোহে উদ্যাপন করা হবে। প্রসঙ্গত, ১৯৩০ সালে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৫ সালে উত্তর ভিয়েতনাম জাপানী সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয় এবং তৈরি হয় গণপ্রজাতন্ত্রী ভিয়েতনাম। ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদকে এবং শেষপর্যন্ত ১৯৭৫ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একীকরণ হয়ে সমাজতন্ত্রী প্রজতন্ত্রী ভিয়েতনামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কংগ্রেসে বিগত সময়ে পার্টি গড়ে তোলার বিষয়ে এবং দ্বাদশ কংগ্রেসে নির্বাচিত নেতৃত্বের ভূমিকার একটি সর্বাঙ্গীণ পর্যালোচনা হয়। একইসাথে আগামীদিনে রাষ্ট্র, পার্টিকে কংগ্রেসে নির্ধারিত পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব যে নেতৃত্বের উপর পড়বে তাঁদের রাজনৈতিক গুণাবলি, বৈপ্লবিক নৈতিকতা, নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা এবং বর্তমান সময়ের উপযোগী জ্ঞান ও মেধার বিষয়ে কংগ্রেসে আলোচনা হয়। পুরো একটা দিন বরাদ্দ করা হয় যাতে প্রতিনিধিরা দলিলসমূহ ভালো করে অধ্যয়ন করতে পারেন এবং নতুন নেতৃত্বের মনোনয়নের ব্যাপারে আলোচনা করতে পারেন। পার্টি কংগ্রেসে প্রতিনিধিরা নেতৃত্ব নির্বাচনে নিজেদের মনোনয়ন নিজেরা জমা দিতে পারেন কিংবা অপরের হয়েও মনোনয়ন জমা দিতে পারেন। সমস্ত পর্যালোচনা ও নিরীক্ষার শেষে ত্রয়োদশ কংগ্রেসের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রার্থীতালিকা প্রকাশ হয় এবং প্রতিনিধিরা ভোটদানে অংশ নেন।
২০০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়, এর মধ্যে ১৮০ জন সরকারি এবং ২০ জন বিকল্প। এই কেন্দ্রীয় কমিটি ১৮ সদস্যের পলিট ব্যুরো, ৫ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি করেছে। নগুয়েন ফু ট্রং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। কংগ্রেস থেকে ১৯ সদস্যের পরিদর্শন কমিশন নির্বাচিত হয়েছে।
১ ফেব্রুয়ারি ৮ দিন ধরে চলা কংগ্রেস সমাপ্ত হয়। কংগ্রেসের সমাপ্তি অধিবেশনে একটি বিশেষ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছেঃ ত্রয়োদশ কংগ্রেসে পেশ করা দলিলে জাতীয় উন্নয়নের অভিমুখ ও আগামী কর্মসূচি সহ দ্বাদশ জাতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তাব; সমাজতন্ত্রের অভিমুখে অতিক্রান্তিকালীন পর্যায়ে জাতীয় নির্মাণ প্রসঙ্গে ১৯৯১ মঞ্চ এবং ২০১১ সালে এর সংযোজনী ও উন্নতিকরণ; ২০১১-২০ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কৌশল এবং দইমই নীতিসমূহের ৩৫ বছরের রূপায়ণের মূলগত মূল্যায়নের সঙ্গে ত্রয়োদশ কংগ্রেস সহমত হয়েছে।
এই প্রস্তাবে আরও বলা হয়েছেঃ ভিয়েতনামে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনোর যে পথ তা এই দেশের বাস্তবতা এবং এ যুগের উন্নয়নের প্রবণতার সাথে খাপ খেয়েছে। এই প্রস্তাবে সামগ্রিক লক্ষ্য এবং ২০২৫, ২০৩০ ও ২০৪৫ সালের লক্ষ্য; ২০২১-২৫ সময়পর্বের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য, ২০২১-২০৩০ সময়পর্বের জাতীয় উন্নয়নের অভিমুখ এবং আগামী পাঁচ বছরের মূল কাজগুলির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে আরও বলা হয়ঃ ‘‘এই কংগ্রেসের সাফল্য সমগ্র পার্টি জনগণ ও সৈন্যবাহিনীকে উৎসাহ জোগাবে, সমস্ত প্রতিকূলতা ও প্রতিস্পর্ধাগুলিকে অতিক্রম করে নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে ও অগ্রসর ঘটাতে সফল হবে এবং এইপথেই শীঘ্রই ভিয়েতনাম উচ্চ আয়সম্পন্ন একটি সমাজতন্ত্রমুখী দেশে পরিণত হবে।’’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৬৭টি রাজনৈতিক দল, ৬টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংগঠন, ১৩০টি রাজনৈতিক-সামাজিক-বন্ধুত্বমূলক ও জনসংগঠন এবং ভিয়েতনামের ২৬টি বিদেশি কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্বমূলক মিশনের মোট ৩৬৮টি ধন্যবাদসূচক বার্তা ও চিঠি ত্রয়োদশ কংগ্রেসে এসেছে।