চিলির সাম্প্রতিক গণভোট প্রসঙ্গে
লালন ফকির
দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে চিলি। এখানকার জনগণ এক নতুন নজির স্থাপন করলেন গত ২১ অক্টোবর। ওই দিন এক গণভোটে ৪ দশকের পুরনো সংবিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গণভোটের সিদ্ধান্ত আরও আগে নেওয়া হলেও কোভিড ১৯ পরিস্থিতির জন্য তা স্থগিত হয়ে যায় এবং অবশেষে গত ২১ অক্টোবর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে ছিল দু’টি ব্যালট। প্রথম ব্যালটটি ছিল ১৯৮০ সালের সামরিক জুন্টা অগাস্টো পিনোচেতের আমলে গৃহীত সংবিধান চালু থাকবে কিনা তা যাচাই করা। ৭৫,২০,৫২৫টি বৈধ ব্যালটের মধ্যে ৫৮,৮৬,৪২১ (৭৮.২৭ শতাংশ) ছিল নতুন সংবিধান রচনার পক্ষে। চিলির শাসকদলের অনুগামী দেশের দক্ষিণপন্থী শক্তি গণভোটের আগে প্রচার করেছিল যে, নতুন সংবিধান যদি রচনা করতে হয় তবে তা দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিয়েই করা উচিত। জনপ্রতিনিধি তথা রাজনৈতিক নেতারা এই কাজের যোগ্য নন। দক্ষিণপন্থীদের এই বক্তব্য গণভোটে বাতিল হয়ে যায়। ৭৮.৯১ শতাংশ মতদাতা বলেছেন, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা নন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নির্মাণ করবেন নতুন সংবিধান। রাজনৈতিক মহলের ধারণা, নতুন সংবিধান ২০২২ সাল থেকে কার্যকর হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সমাপ্ত করতে হবে। যারা সংবিধানের খসড়া তৈরি করবেন তাঁদের নির্বাচিত হতে হবে। রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনগুলি আগামী দু’মাসের মধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন করবে। আগামী বছরের এপ্রিল নাগাদ নাগরিকরা ভোট দিয়ে ১২৫ জনের সাংবিধানিক সভা গঠন করবে। এই সাংবিধানিক সভায় লিঙ্গসমতা রক্ষা করা হবে। এক বছরের মধ্যে সাংবিধানিক সভা নতুন সংবিধান রচনা করবে। তারপর সংবিধান গণভোটে অনুমোদিত হবে। চিলির মতো একটি দেশ যেখানে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে সামরিক জুন্টার শাসন চলেছে, সেখানে নির্মম অত্যাচারের মধ্যে দক্ষিণপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে পিনোচেত সরকারের কাছ থেকে গণতন্ত্র ছিনিয়ে আনার ইতিহাস তৈরি করেছেন চিলির জনগণ।
এই জয়ের রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করার আগে চিলির ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু আলোচনা প্রয়োজন। উত্তরে পেরু ও বলিভিয়া এবং দক্ষিণে হর্ন অন্তরীপের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডে চিলির অবস্থান। উত্তর -দক্ষিণে লম্বা আর পূর্ব-পশ্চিমে সরু এই দেশটি প্রাকৃতিক দিক থেকে বৈচিত্র্যময়। উত্তরের আটলান্টা মরুভূমি বিশ্বের সবচেয়ে শুষ্ক অঞ্চল, আবার দক্ষিণে কিছু অংশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। দেশটির একদিকে যেমন রয়েছে সুউচ্চ আন্দিজ পর্বত তেমনই রয়েছে ছোটোছোটো পাহাড়। দেশের মধ্যাঞ্চলে নদীবিধৌত সমতলভূমিতে সবচেয়ে বেশি জনবসতি গড়ে উঠেছে। দক্ষিণ চিলির সৌন্দর্য অসাধারণ।
ইনকা সভ্যতার অংশ চিলি স্পেনের অধীনে আসে ১৬শ শতাব্দীতে। চিলি স্বাধীনতা লাভ করে ১৮১০ সালে। দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম দেশ হলো চিলি যেখানে ১৯৭০ সালে সালভাদোর আলেন্দের নেতৃত্বে বামপন্থী সরকার গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র উদ্যোগে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে এই সরকারের পতন ঘটানো হয়। এই সময়ে প্রচুর মানুষ খুন এবং নিখোঁজ হন। গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘে পিনোচেত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ১৯৮৮ সালে গণভোটে পিনোচেত পরাজিত হন এবং ১৯৯০ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
চিলির গণভোটে যে সংবিধান বাতিল করা হয়েছে তা ১৯৮০ সালে একটি জাল গণভোটে অনুমোদন করিয়েছিল পিনোচেত সরকার। আলেন্দের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ে সাধারণ মানুষকে হত্যার পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সহ বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছিল। আসলে এই সময়কার চিলির ইতিহাস হলো হিংসা আর নানান ভয়ঙ্কর অত্যাচারের ইতিহাস।
এই সময়ে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মিল্টন ফ্রিডম্যানকে পিনোচেতের উপদেষ্টা করে পাঠায় মার্কিন প্রশাসন। ফ্রিডম্যান ছিলেন উদারনৈতিক পুঁজিবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা। তাঁর নেতৃত্বে ‘শিকাগো বয়েজ’এর উদ্যোগে চিলি হয়ে ওঠে নব্য-উদারবাদের গর্ভগৃহ। এই সময়েই ১৯৮০ সালে বিতর্কিত গণভোটে পাশ হয় আলোচ্য সংবিধান। সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয় - দেশ চলবে বেসরকারিকরণ ও মুক্ত বাজার নীতিতে, রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে যৎসামান্য। এর সূত্র ধরে চলতে থাকে অবাধে বেসরকারিকরণ। এরজন্য মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। এই কাজে পিনোচেতের দক্ষিণহস্ত ছিলেন হাইসে গুজম্যান। চিলিতে উদারবাদী অর্থনীতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি ১৯৮০ সালে পিনোচেতের শাসনে দেওয়া হলেও পরবর্তী সরকারগুলি তার কোনো পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি। বরং ২০০৫ সালে জনমত উপেক্ষা করেই উদারবাদের নীতিকে পুনরায় অনুমোদনের ব্যবস্থা করা হয়। সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়, নয়া-উদারবাদ চিলির অর্থনীতিতে যথেষ্ট উন্নতি ঘটিয়েছে। এর কল্যাণে মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু মূল যে বিষয়টি এরা এড়িয়ে চলেন, তাহলো চিলিতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক ধনবৈষম্য। গতবছর ইউনাইটেড নেশনস ইকনমিক কমিশন ফর ল্যাটিন আমেরিকার হিসাব অনুযায়ী চিলির জাতীয় আয়ের ২৫শতাংশ কুক্ষিগত করেছে চিলির ধনবানরা, বিপরীতে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপকভাবে। ব্যয় নির্বাহের জন্য নব্য-উদারবাদের দাওয়াই হলো প্রথমে ধার করো পরে তা শোধ করো। ফলে দেশে ঋণগ্রস্তদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। চিলির কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী গার্হস্থ্য আয়ের তিন চতুর্থাংশ পুরনো ঋণ শোধ করতে চলে যায়। দেশের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা চরম শোচনীয়। শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। পেনশন ব্যবস্থা নেই বা কোথাও থাকলে তা অতি নগণ্য। এই কারণে বহু মানুষকে অবসরগ্রহণের পরও কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
এই দুরাবস্থা যে পিনোচেতের আমলে গৃহীত আর্থিক নীতির ফল এবং তা সংবিধানস্বীকৃত করানো হয়েছে তা সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে থাকে। চিলির বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার জোট সঙ্গী ‘ইউনিট ফর চিলি’ রয়েছে। এরা ক্রমাগত আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকে। এইসব আন্দোলনের গতিমুখ ছিল নির্দিষ্ট। অর্থাৎ, যে উদারনীতির জন্য চিলির সমাজে ব্যাপক ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে তার দূরীকরণে উদারনীতিকে বাতিল করতে হবে। অর্থাৎ, বিশেষ ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দল নয়, নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল চিলির জনগণ।
চিলির রাজনীতিতে সক্রিয় দলগুলির মধ্যে দেশের সংবিধান পরিবর্তনের প্রশ্নে মতবিরোধ ছিল। এই সংবিধানের পরিবর্তন করতে দক্ষিণপন্থী দলগুলি গররাজি ছিল। তারা সংবিধানের পরিবর্তনের লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এবং বেড়ে চলা আন্দোলনগুলিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে চিহ্নিত করত। অবশ্য মানুষের চেতনা ক্রমশই পরিবর্তনের পক্ষে আবর্তিত হচ্ছিল, কারণ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল। পথে নেমে আন্দোলন করা ছাড়া তাদের সামনে কোনো বিকল্প পথ ছিল না। গত বছর থেকেই চিলিতে গণ আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হতে শুরু করে। স্থানীয় ভাষায় এই আন্দোলনকে ‘এস্তানিদো’ বলে বিশেষিত করা হতো। ‘ইউনিট ফর চেঞ্জ’ সব সময়েই এসব আন্দোলনে পাশে থাকত। চিলিতে ‘গ্রিন ইকোলজিস্ট পার্টি’, ‘হিউম্যানিস্ট পার্টি’ প্রভৃতি দল গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। গণআন্দোলনের চাপেই শেষপর্যন্ত সংসদের উভয়কক্ষে পিনোচেতের আমলের সংবিধান পরিবর্তন করার জন্য গণভোটের দাবি তোলা হয়। গণআন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধির সংকেতে রাষ্ট্রপতি পিনেরার অস্বস্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। অর্থাৎ, একদিকে সংসদের অভ্যন্তরে গণভোটের দাবির পক্ষে তীব্র চাপ এবং অন্যদিকে বাইরের বিপুল আন্দোলন - এই উভয় চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে তিনি বাধ্য হন।
প্রকৃত প্রস্তাবে চিলির গণভোটে নব্য-উদারবাদী নীতির প্রবক্তারাই পরাজিত হয়েছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, লিবারাল বুর্জোয়ারা বৈষম্য সৃষ্টিকারী নব্য-উদারবাদকে একদমই পছন্দ করে নি। চিলির কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্যদের নিয়ে ‘ইউনিটি ফর চেঞ্জ’ গড়ে উঠেছিল। ‘প্রোগ্রেসিভ কনভার্জেন্স’ এবং ‘ব্রড ফ্রন্ট’-এর মতো দলও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। মতের দিক থেকে এইসব দল দক্ষিণপন্থী হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে এরা নব্য-উদারবাদের বিরুদ্ধে। এই সব দক্ষিণপন্থী দল নতুন সংবিধানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। নব্য-উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করার মধ্যেই এর কারণ নিহিত রয়েছে। এছাড়া চিলিতে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থাও এক্ষেত্রে সাহায্য করেছে।
নব্য-উদারবাদের বিরুদ্ধে চিলির জনগণকে রাজনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে। লগ্নিপুঁজির আগ্রাসী চরিত্র চিলির জনগণ সম্যক উপলব্ধি করেছে। আসলে পুঁজিবাদের শাসনে রাষ্ট্র সব সময়েই পুঁজিপতিদের স্বার্থকে মান্যতা দিয়ে থাকে। লগ্নিপুঁজির আগের পর্বে পুঁজিবাদের আক্রমণে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থেও রাষ্ট্র কিছু কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু লগ্নিপুঁজির শাসনে রাষ্ট্র পুঁজির স্বার্থেই কাজ করে শুধু তা নয়, রাষ্ট্র এই সময়ে পুঁজির নির্দেশ মেনে কাজ করতে বাধ্য হয়। এই বাধ্যতা থেকেই এমন সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা কার্যকর করে, যার পরিণতিতে পুঁজিবাদী ব্যাধিগুলি, যেমন, দারিদ্র্য, কর্মসংকোচন, বেকারি প্রভৃতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে সমাজের মধ্যে সৃষ্টি হয় বিপুল আয় ও ধনবৈষম্য। শিক্ষা, স্বাস্হ্য, পরিবেশ সবকিছুতেই লগ্নিপুঁজির মুনাফার ক্ষেত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ফলে জনস্বাস্থ্য, জনশিক্ষা প্রভৃতি বিষয়গুলি অবহেলিত হয়ে পড়ে এবং তা ক্রমশ মানুষের আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। ঠিক এরকম পরিস্থিতি চিলিতে তৈরি হয়েছিল। সাধারণ মানুষ সংবিধানের পরিবর্তন করে নতুন সংবিধান রচনার যে রায় দিয়েছেন আসলে তা লগ্নিপুঁজি-সৃষ্ট নীতির বিরুদ্ধেই রায়। আগামীদিনে চিলির জনগণকে সংগ্রামের এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।