E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপ বেইরুট বন্দর


রাজধানী বেইরুটে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর পদত্যাগ করতে বাধ্য হলো লেবাননের হাসান দিয়াবের নেতৃত্বাধীন সরকার। এমনিতেই রাজনৈতিক অস্থিরতা, নড়বড়ে অর্থনীতি আর করোনা অতিমারীর জেরে জেরবার ছিল লেবানন। ৪ আগস্ট ভয়ানক বিস্ফোরণ চাপে ফেলে দেয় হাসান দিয়াবের লেবানন সরকারকে। জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। বিস্ফোরণের দায় মাথায় নিয়ে হাসানের মন্ত্রিসভার সদস্যরা ইস্তফা দিয়েছেন ১০ আগস্ট। হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এবং মিত্রদের সমর্থন নিয়ে গত জানুয়ারিতে লেবাননের মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছিল। দীর্ঘ ১৫ বছরের গৃহযুদ্ধের ফলে আর্থিক মন্দায় বিধ্বস্ত লেবানন। নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গেই জনমানসে সরকারের পদত্যাগের দাবি তীব্রতর হচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে হাসান দিয়াবের মন্ত্রীসভার তিন সদস্য, বিচারমন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী এবং পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর আগেই পদত্যাগ করেছিলেন। লেবাননের নেতাদের বিরুদ্ধে গাফিলতি ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে, এই বিস্ফোরণের জন্য সরকারকে দায়ী করে সরকারের ইস্তফার দাবিতে রাজধানীর রাজপথে লাগাতার বিক্ষোভও শুরু হয়ে গিয়েছিল। সংবাদ সংস্থার খবর, বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি মন্ত্রকে ঢুকে পড়ারও চেষ্টা করে। পুলিশ বিক্ষুব্ধ জনতাকে বাধা দিতে গেলে, দফায় দফায় সংঘর্ষ বেধে যায়। সব মিলিয়ে গৃহযুদ্ধদীর্ণ লেবানন এই মুহূর্তে প্রবল সঙ্কটের সামনে।

জানা গেছে, বেইরুট বন্দরের একটি গুদামঘরে মজুত করে রাখা ২,৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট থেকে বেইরুটে ভয়ানক বিস্ফোরণ ঘটেছে। অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বিস্ফোরক হলেও তা গুদামে রাখার জন্য ন্যূনতম যে সতর্কতা ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল, তা মানা হয়নি। যার জেরে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসে লেবাননের রাজধানীতে। আইনি জটিলতার জেরে জাম্বিয়ার একটি জাহাজ থেকে নামানোর পর ওই বিস্ফোরক অন্যত্র পাঠানো যায়নি বলে খবর।

বিস্ফোরণের তীব্রতায় সংলগ্ন কয়েক বর্গকিমি এলাকায় বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গোটা বন্দর সংলগ্ন এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের অভিঘাত থেকে প্রেসিডেন্টের বাসভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ও রেহাই পায়নি। অসমর্থিত সুত্রের খবর, বেইরুটের এই রাসায়নিক বিস্ফোরণে এপর্যন্ত দু’শোর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি। আহতদের মধ্যে অনেকেরই অবস্থা আশঙ্কাজনক।

প্রাথমিক হিসেবে এই বিস্ফোরণে প্রায় ২লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য পরিষেবা। এমনিতেই করোনা সংক্রমণের জন্য হাসপাতালগুলি উপচে পড়ছিল। সেই সঙ্গে হাজার হাজার মানুষ আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় সংক্রমণ আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আবার বেইরুট বন্দর ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ায় খাদ্যসামগ্রী আমদানি নিয়েও আশঙ্কা। যে শস্যভাণ্ডারে অধিকাংশ খাদ্যশস্য মজুত থাকে, সেগুলি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এক লক্ষেরও বেশি সিরীয় নাগরিক এখন এ দেশে আশ্রিত। ফলে চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কাও রয়েছে। শুধু খাবার নয়, মাথাগোঁজার জায়গাও দরকার।

দেশি বিদেশি মিলিয়ে বহু মানুষ নিখোঁজ বন্দর শহর বেইরুটে। ধ্বংসস্তূপের নিচে তাঁরা চাপা পড়ে রয়েছেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। জানা গিয়েছে, নিখোঁজদের মধ্যে বহু বিদেশি কর্মী এবং লরিচালক রয়েছেন। বিস্ফোরণের পর কয়েক দিন কেটে যাওয়ায়, দেহ উদ্ধারের পরেও আদৌ মৃতদেহগুলি শনাক্ত করা যাবে কি না, তা নিয়ে একটা আশঙ্কা রয়েইছে।

রাজধানী শহরে পানীয় জলের পরিষেবাও এখনও স্বাভাবিক হয়নি। বিপর্যস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবাও। জানা গিয়েছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। বিপর্যয় মোকাবিলায় লেবাননকে ২৫ কোটি ইউরো আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইয়োরোপীয় ইউনিয়ন।

ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য ইজরায়েল বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেয়, এই ঘটনার সঙ্গে কোনও ভাবেই তারা জড়িত নয়। হিজবুল্লাহ-এর পক্ষ থেকেও এই ঘটনার সঙ্গে ইজরায়েলের যুক্ত থাকার দাবি করা হয়নি। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে ইজরায়েল-লেবানন-সিরিয়া সীমান্তে উত্তেজনা চলেছে। তাই বেইরুটের বিস্ফোরণের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের বিষয়টি জড়িত থাকার সম্ভাবনার বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছিল।

লেবাননে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম ক্রমশই বাড়ছিল। চলতি বছরের জিডিপি হ্রাস পায় ১২ শতাংশ। বিস্ফোরণের জেরে দুমড়ে যাওয়া অর্থনীতিকে চলনসই জায়গায় আনতে গেলেও সমস্ত গোষ্ঠীগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাসমুহকেও বেইরুট-এর পাশে দাঁড়াতে হবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঘটনার পরপরই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে হিজবুল্লাহকে বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করা হয়। হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করা হয়। বেইরুট বন্দরে হিজবুল্লাহর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই বলে আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ দৃঢ়ভাবে জানিয়েছে। লেবানিজ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে এই ঘটনার তদন্তের দাবি করা হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। হিজবুল্লাহ ঘটনায় তদন্তসাপেক্ষে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

আমেরিকার পক্ষ থেকে ১৫মিলিয়ন ডলার আপৎকালীন সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করা হলেও বিস্ময়করভাবে ঘটনার প্রেক্ষিতে বিধ্বস্ত লেবাননের ঘাড়ে আর্থিক অবরোধের বোঝা চাপাতে চাইছে ওয়াশিংটন।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রন ইতিমধ্যেই লেবাননে ঘুরে গেছেন। ক্ষয়ক্ষতির প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সাহায্য সম্পর্কে তিনি নিদান দিয়েছেন যে, বেসরকারি এজেন্সির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সাহায্য এবং ত্রাণ বন্টন করতে হবে। ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আখ্যা দিয়ে ম্যাক্রনের এই পদক্ষেপের নিন্দা করেছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ।