করোনায় আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
লালন ফকির
কোভিড ১৯ ভাইরাসে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর হারের দিক থেকে অন্যান্য দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক এগিয়ে। এমনকি তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডার অবস্থাও অনেক ভাল। শুরুর পর্বের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ৩ মার্চ এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২২ জন এবং মৃত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ৭ জন। কিন্তু ১৪ দিন পর অর্থাৎ ১৭ মার্চ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭,৭৮৬ জন এবং মৃতের সংখ্যা ১১৮ জন। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকৃত সংখ্যা উভয় ক্ষেত্রেই অনেক বেশি। মার্চ মাসের শেষে মৃত এবং আক্রান্ত উভয়ের সংখ্যাই ব্যাপক বৃদ্ধি পায়।
সেই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা নীতির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ বলে পরিচিত এবং কমনওয়েলথ ফান্ডের সভাপতি ডেভিড ব্লুমেন বোটাল বলেছিলেনঃ “আমি জানি না এই ভাইরাসের দাপটে আমরা হয়তো ইতালি বা চীনের হুবেইকে অতিক্রম করে যাব কিনা।’’ দেশের সার্জেন জেনারেল জেরোম অ্যাডামস প্রায় একই সুরে মার্কিন প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাট সংখ্যক নাগরিক স্বাস্হ্য সুরক্ষা বিধির আওতার বাইরে রয়েছেন। তাছাড়া যাঁরা এই আওতার মধ্যে আছেন তাঁদের পরিপূর্ণ চিকিৎসা পরিষেবা প্রদানের মতো স্বাস্হ্য পরিকাঠামো দেশে নেই। এক তথ্যে দেখা যায়, চীনে যত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছেন তাদের ৫ শতাংশের প্রয়োজন ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসা ব্যবস্থা। চীনে বর্তমানে ৯৪,০০০ আইসিইউ বেড আছে। এর এক তৃতীয়াংশ বেড খালি। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় মাথাপিছু বেডের পরিমাণ বেশি থাকলেও মাথাপিছু আইসিইউ বেড ইতালি প্রভৃতি দেশের তুলনায় অনেক কম। ভেন্টিলেটর বা চিকিৎসা কর্মীর সংখ্যার ক্ষেত্রেও এই অপ্রতুলতা রয়েছে। এক তথ্যে দেখা যায়, ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসকের সংখ্যা ৫০,০০০ এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সের সংখ্যাও ৭০,০০০-এর কাছাকাছি ।
সর্বশেষ তথ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৮,৬৫,১২২ অতিক্রম করে গেছে। মৃতের সংখ্যা ১,৪৩,১৩৬-এর বেশি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ব্রাজিল এবং তৃতীয় স্থানে ভারত। প্রসঙ্গত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম থেকেই আক্রান্ত এবং মৃতের নিরিখে তালিকার প্রথম দিকে রয়েছে। এই প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তর থেকে বারে বারে রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তিনি এই ভয়ঙ্কর সমস্যার সমাধানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন নি। তাঁর একটিই বক্তব্য ছিল, নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বেই এই অতিমারীকে প্রতিহত করা সম্ভব হবে। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য, ফ্লোরিডা থেকে ক্যালিফোর্নিয়া - যেভাবে আক্রান্তের সংখ্যা ছড়িয়ে পড়ছে তা ৪০ লক্ষ অতিক্রম করে যাবে।
ডঃ অ্যান্টনি ফাউচি যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে রয়েছেন, তিনি একই সাথে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যালার্জির শীর্ষে রয়েছেন, তাঁর মত হলো, আগামীদিনে দৈনিক ১ লক্ষ করে মার্কিন নাগরিক যদি আক্রান্ত হন তাহলে আশ্চর্যের কিছু হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এপিসেন্টার হয়ে উঠেছে ফ্লোরিডা। জুলাই মাসের প্রথম দিকে এখানে একদিনে ১১,৪৫৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ফ্লোরিডায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা চীনকেও অতিক্রম করে যাবে। মিয়ামি বিচের মেয়র ফক্স প্রচার মাধ্যমে বলেছেনঃ ‘‘আমাদের শহরে এই মুহূর্ত ১,৪০০-র বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। আমাদের ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, ভেন্টিলেশনগুলি যথাযথ ব্যবহৃত হচ্ছে।’’ ফ্লোরিডা কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়েছে, জুলাই মাসের প্রথম দিকে ৯০ শতাংশ ভেন্টিলেটর ব্যবহৃত হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের বড়ো অংশের অভিমত হলো, শুরু থেকেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনা প্রতিরোধে যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন না। তিনি জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে এই আক্রমণের খবর পান। কিন্তু তাঁর মত ছিল, এই রোগ প্রতিরোধে অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। ফলে মার্কিন নাগরিকদের আশঙ্কার কোনো কারণ নেই। এছাড়াও তাঁর আরও দু’টি বক্তব্যের মধ্য দিয়ে নেতিবাচক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। প্রথমত, ট্রাম্প এই সংক্রমণের জন্য চীনকে দায়ী করেন। যদিও তাঁর এই বক্তব্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা খারিজ করে দেয়। সাথে সাথে তিনি আক্রমণের তীর ঘুরিয়ে দেন বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থার দিকে। দ্বিতীয়ত, তিনি সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিপুল পরিমাণ টেস্টিংকে দায়ী করেন । কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে টেস্টিং করতেই হবে, যদিও টেস্টিংয়ের সাথে সাথে আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসার ব্যবস্থা যদি না করা হয়, তাহলে রোগ বৃদ্ধি আটকানো যাবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে সমস্ত প্রদেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে সেগুলিতে প্রধানত শাসক দল রিপাব্লিকান পার্টি শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে আরিজোনা, ফ্লোরিডা, টেক্সাস প্রভৃতি। এর মধ্যে ফ্লোরিডার গভর্নর রন ডে স্যান্টিস, যিনি ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বলে মার্কিন রাজনীতিতে পরিচিত, তিনি করোনা সংক্রমণ সত্ত্বেও মার্কিন অর্থনীতি আরও মুক্ত করার পক্ষে সওয়াল করেছেন। ডে স্যান্টিস এবং অন্যান্য প্রাদেশিক রিপাব্লিকান গভর্নর ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ-এর নির্দেশাবলী লঘু করে দেখেছেন, এমনকি সংক্রমণ প্রতিরোধের সরকারি নির্দেশাবলীকে সরাসরি নস্যাৎ করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় দফায় করোনা সংক্রমণের যে ঢেউ তৈরি হয় তার সূত্রপাত ঘটে প্রধানত রিপাব্লিকান শাসিত প্রদেশগুলি থেকে। এই সব প্রদেশের নাগরিকদের, বিশেষত, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বের নাগরিকদের মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। এমনকি সর্বত্র শারীরিক দূরত্ব বিধি মান্য করা হয়নি। স্যানিটাইজেশনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। ৫০ টির মধ্যে মাত্র ১৭ টি প্রদেশে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি নিয়মিত মাস্ক পরিধান করেন না। এসবের পরিবর্তে বারংবার জনগণের মধ্যে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ (herd immunity) তৈরির কথা বলা হয়েছিল। অথচ হার্ড ইমিউনিটির শর্ত হলো নাগরিকদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের সংক্রমণ হতে হবে। ইনস্টিটিউট অফ হেলথ-এর পক্ষ থেকে এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ যদি নিয়মিত মাস্ক পরিধান করতেন, তাহলে জুলাই থেকে ১ অক্টোবরের মধ্যে ৩০,০০০-এর বেশি মানুষের জীবন রক্ষা করা যেত।
আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজ জয় নিশ্চিত করতে ট্রাম্প করোনা সংক্রমণকে ব্যবহার করে চলেছেন। শেয়ার বাজারের তেজী ভাব বা বেকারদের কর্মসংস্হানের সামান্য সুযোগকেও এই লক্ষ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কিছুটা হলেও তাকে হতাশ করেছে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা। নির্বাচনের পূর্বে যেসব আর্থিক সূচকগুলো প্রকাশিত হয়ে চলেছে তাদের চরিত্র কিন্তু ট্রাম্পের স্যাঙাতদের হতাশ করেছে। তবে কোভিড সংক্রমণের বাইরে বেশ কিছু প্রসঙ্গ নির্বাচনী প্রচারকে উত্তপ্ত করেছে। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বর্ণবিদ্বেষবাদবিরোধী আন্দোলন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, সমগ্র ইয়োরোপ তথা বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। এর সাথে রয়েছে বিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কট যার প্রভাবে মার্কিন অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বেকারি, দারিদ্র্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যেই বেকারির হার ৩.৪ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে এবং তা ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন খুবই উত্তেজনাময় হয়ে উঠেছে।