মার্কিন সংসদে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা
বিশেষ প্রতিবেদনঃ ৭ জানুয়ারি নজিরবিহীন ঘটনা ঘটল আমেরিকায়। নিজের দেশের রাষ্ট্রপতির মদতেই ঘটল এই ঘটনা। ওই দিন মার্কিন সংসদ ভবন ক্যাপিটলে হানা দেয় ট্রাম্প সমর্থকদের উগ্র বাহিনী। দুনিয়া জুড়ে দাদাগিরিতে মদত দিতে অভ্যস্ত মার্কিন দেশের সংসদ ছেড়ে তাই সাময়িক ভাবে পালাতে হলো পুঁজিবাদের পাহারাদার সাংসদদের। এখন কার্যত মুখ লুকানোর জায়গায় নেই এই তথাকথিত গণতন্ত্রের পূজারীদের।
মার্কিন সংসদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী বাইডেনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ঘোষণা করার কর্মসূচি ছিল ওই দিন। প্রথা মতো সাংসদরা জড়ো হয়েছিলেন সংসদ ভবনে। সেই অনুষ্ঠানকে বানচাল করে দেবার লক্ষ্যে ট্রাম্প আগেই তাঁর সমর্থকদের উস্কে দিয়েছিলেন সংসদ ভবনে হানা দেওয়ার জন্য। ট্রাম্প বলেছিলেন, নির্বাচনে জোচ্চুরি হয়েছে। অতএব লড়ে নিতে হবে জয়। তারপরই হামলা সংসদ ভবনে। আক্রমণের পরই নিরাপত্তার স্বার্থে স্থগিত হয়ে যায় অনুমোদন দেবার অনুষ্ঠান। সরিয়ে নেওয়া হয় সাংসদদের। হামলার ঘটনা ছেলে দীর্ঘক্ষণ। পরিস্থিতি সামলাতে গুলি চালায় নিরাপত্তা রক্ষীরা। ঘটনায় নিহত হন ৪ জন। যদিও পুিলশ সেনা বাহিনী সংসদ থেকে দুষ্কৃতীদের সরিয়ে নিয়ন্ত্রণ নেবার পর মার্কিন সময় ভোর রাতে গণনার পর প্রথা মাফিক ঘোষিত হয় জো বাইডেনই মার্কিন রাষ্ট্রপতি। ভিডিও ফুটেজ সহ অন্যান্য প্রমাণ থেকে দেখা গেছে ঘটনায় জড়িত অতি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ত গোষ্ঠীগুলি। ঘটনার জেরে ১৩ জানুয়ারি মার্কিন সংসদের প্রতিনিধি সভা ইম্পিচ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে।
নির্বাচনের পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁকে অবৈধভাবে হারানো হয়েছে বলে ক্রমাগত তাঁর সমর্থকদের তাতিয়ে বলেছিলেন লড়াই করে জয় ছিনিয়ে নিয়ে আসতে হবে। এই ঘটনা তাঁর পরিনতিতেই ঘটােনার সময়। ওই ট্রাম্প সমর্থকদের দাবি ছিল তারা ট্রাম্পের পরাজয় স্বীকার করবেন না। সংসদে চড়াও হয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে তারা। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল। মুখে ছিল বাইডেন বিরোধী স্লোগান। ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য আগেই উস্কানি দিয়েছিলেন ওদের। ১২৭ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত সংসদ সশস্ত্র ট্রাম্প ভক্তরা তছনছ করেছেন। ঘটনায় সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন উপস্থিত সাংসদরা, গণতন্ত্রের অনুশীলনের নামে বিশ্বজোড়া দাদাগিরির ইতিহাস পেরিয়ে যা এখন মার্কিন শাসকদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়লেও ট্রাম্পবাদ এবং ফ্যাসিজমের বিপদ দূর হয়ে যাবে এমন নয় বলেই আশঙ্কা মার্কিন সমাজের। ট্রাম্পের সময়ই ফ্যাসিবাদের ভিত্তি তৈরীর উৎস রয়েছে বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। তাই আগামী চার বছর দেশে অনিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক সংঘাতের পর্ব শুরু হতে চলেছে বলে আশঙ্কা সর্বস্তরে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হবে বলেও মনে করা হচ্ছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নামে সেনা হস্তক্ষেপ যাদের কাছে চিন্তার অতীত বলে এখন মনে হচ্ছে তাদের দেখতে হবে গণসমর্থনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ট্রাম্প ক্রমাগত এমন বহু কাজ করে গেছেন। যে মার্কিন সংসদ আক্রান্ত হয়েছে নব্য ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা, চরম দক্ষিণপন্থীদের পরিচালনায় সেই মার্কিন সংসদ অতীতে বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় হুকুম দখলের মতো অগণতান্ত্রিক সামরিক পদক্ষেপের সিদ্ধান্তের পক্ষে হইহই করে রবার স্টাম্প হিসেবে কাজ করেছে।
মার্কিন সংসদ ভবনে হামলার ঘটনায় স্বাভাবিকভাবেই নিন্দায় সরব হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। অবশ্য মোটের ওপর সব দেশই এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার নিন্দা করতে কসুর করেনি। বস্তুত, সবসময় গণতন্ত্রের বড়াই করলেও গণতন্ত্র বিরোধী সবচেয়ে বড় ঘটনার সাক্ষী থাকতে হলো সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই। রাষ্ট্রপ্রধানরা এমন ঘটনায় ‘স্তম্ভিত’, ‘অবিশ্বাস্য’, ‘ভয়ঙ্কর’ এবং ‘নজিরবিহীন’ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে ট্রাম্প বাহিনীর এই হামলায় উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেনি ভেনেজুয়েলা সরকার। বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে যা আগ্রাসনের নীতি নিয়ে অন্যান্য দেশে হরবখত ঘটিয়েছে তারা। তেমনই ২০১৯সালে হংকং-য়ে বিক্ষোভকারীদের হামলা সম্পর্কে মার্কিন সংসদের অধ্যক্ষের ‘নয়নাভিরাম দৃশ্য’ মন্তব্যের সঙ্গে দু’টি ঘটনার তুলনা টেনে কটাক্ষ ভরে গিয়েছে চীনের সোশ্যাল মিডিয়া।
ভোটে হারলেও বহুদিন ধরে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে হুমকি দিয়ে আসছিলেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন ঘটনা মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম। একারণেই সব রাষ্ট্রনায়কই এমন নজিরবিহীন হিংসাত্মক ঘটনার কড়া সমালোচনা করেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মার্কিন কংগ্রেসে এমন বেইজ্জতির ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, যে দেশ গণতন্ত্রের পক্ষে এত কথা বলে আজ সেখানেই এমন ঘটনা ঘটল। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুল ম্যাক্রোঁ টুইটারে ভিডিও পোস্ট করে বলেছেন, ‘‘কয়েকজনের হামলার বিষয় নয়, এটা গণতন্ত্রকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। ওয়াশিংটনে যা ঘটেছে তা মোটেই আমেরিকান নয়।’’ প্রতিবেশী কানাডার প্রধানমন্ত্রীও জাস্টিন ট্রডো মনে করেন হিংসা কখনোই মানুষের মতামতকে উলটে দিতে সক্ষম হয়নি আজ পর্যন্ত। তাই এই ঘটনায় তাঁরা বিরক্ত এবং দুঃখিত হয়েছেন।
একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতি নেতৃত্বে এই ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করার বিষয়টি নিয়ে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মার্কিনিরা শিহরিত হলেও গোটা পরিস্থিতিতে এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারণ মার্কিন সংসদ ভবনে বেনজির হামলার পরে রিপাবলিকান সমর্থকদের মধ্যে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৪৫ শতাংশ এই হামলাকে সমর্থন করছেন। বিশ্বজুড়ে নিন্দার পরেও এখনো ৮৫ শতাংশ রিপাবলিকান সমর্থক মনে করছেন ট্রাম্পকে তার বাকি সময়ের জন্য (১২ দিন) সরানো অনুচিত হবে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনারেল আন্তেনিও গুতেরস মার্কিন ক্যাপিটল ভবনে হামলার ঘটনায় ‘ব্যথিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফানে দুজারিকের মন্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন, ‘‘এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমর্থকদের হিংসাত্মক আচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া উচিত তাঁদের। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং আইন মেনে চলায় বিশ্বাস থাকা জরুরি তাঁদের।’’ জার্মান বিদেশ মন্ত্রী হেইকো মাস ট্রাম্প ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রকে পদদলিত করা বন্ধ হোক।’’ ন্যাটো প্রধান জেনস স্টোলেনবার্গ টুইট করে বলেছেন, ‘‘ ওয়াশিংটনের ঘটনা দেখে স্তম্ভিত। গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ফলাফলকে মর্যাদা দেওয়া উচিত।’’ ইয়োরোপীয় ইউনিয়নের বিদেশনীতি নির্ধারক প্রধান যোশেফ বোরেল মনে করেন, ‘‘ওই ঘটনা গোটা বিশ্বের কাছে মাথা নত করে দিয়েছে মার্কিন গণতন্ত্রকে।’’ তিনিও মার্কিন নির্বাচনের ফলাফলকে মর্যাদা দেওয়া উচিত মন্তব্য করেছেন।