E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

বোলসোনারোর মদতেই অবাধে ধ্বংস হচ্ছে আমাজন

শংকর মুখার্জি


আমাজন বর্ষাবন।

পৃথিবীর বৃহত্তম বর্ষাবন দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সারা বিশ্বের পরিবেশবিদরা চিন্তিত। আসলে বৃহৎ করপোরেট সংস্থা এবং একশ্রেণির মাফিয়াদের লোভ লালসায় যেভাবে আমাজনের অরণ্য নিধন চলছে সেটাই আজ বিশ্বের পরিবেশ আন্দোলনের চিন্তার বিষয়। যদিও আমাজনের অরণ্য ধ্বংস সাম্প্রতিক বিষয় একেবারেই নয়। বেশ কয়েকযুগ ধরেই এটা হয়ে চলেছে। সময়বিশেষে হ্রাসবৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমান সময় যে ভয়াবহভাবে অরণ্য ধ্বংস চলছে তা আগে কখনও হয় নি। আমাজনের অরণ্য ধ্বংস এই ভয়াবহ আকার নিয়েছে জাইরে বোলসোনারো ব্রাজিলে ক্ষমতায় আসার পর । সম্প্রতি একটি তথ্য সামনে এসেছে যা এই বর্ষাবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ওই তথ্য বলছে, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে আমাজন বর্ষাবন ৩ হাজার ৯৮৭ বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলের বনভূমি হারিয়েছে।

এই তথ্যকে একেবারেই অবজ্ঞা করা যাবে না, কেননা তা সংগৃহীত হয়েছে ব্রাজিলের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্পেস রিসার্চের উপগ্রহ-চিত্রের মাধ্যমে। এই সংস্থা এই তথ্য সরবরাহ করে ‘ লিগাল আমাজন ডিফরেস্টেশন ডিটেকশন সিস্টেম ইন রিয়েল টাইম’কে। যারা নিয়মিতভাবে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে আমাজনের বনভূমি নষ্টের ব্যাপারে। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে এই বনভূমি নষ্টের পরিমাণ ২০২১ সালের প্রথম ছয়মাসের তুলনায় ১০.৬ শতাংশ বেশি। প্রতিবছর আমাজন বর্ষাবনের কতটা অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে তার তথ্য সংগ্রহের কাজ সংস্থাটি শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। এর পরবর্তী সময়ে যে সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে প্রথম ছয় মাসে আমাজনের যতোটা অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস হয়েছে তা এর আগে কোনোদিন হয়নি। শুধুমাত্র এবছরের জুন মাসেই এই বর্ষাবন বনভূমি হারিয়েছে ১১২০ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ ছয় মাসে যে বনভূমি কেটে সাফ করা হয়েছে তার প্রায় ২৯ শতাংশই ঘটেছে এই জুন মাসে। এটা একটা ভয়ংকর বিপদের দিক ইঙ্গিত করছে; তা হলো, করপোরেট ও মাফিয়ারা বনভূমি কাটায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা কোনো আইনকানুন নিষেধাজ্ঞা মানতে চাইছে না। এই সময় তাদের যদি আটকানো না যায়, তা হলে আমাজনের জন্য আরও বড়ো বিপদ অপেক্ষা করছে।



দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক জাইরে বোলসোনারো ব্রাজিলে ক্ষমতায় আসেন ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে। ক্ষমতায় এসেই তিনি প্রকাশ্যেই আমাজন বর্ষাবন কেটে খনিজ পদার্থ উত্তোলন, কাট সংগ্রহ, চাষবাসের পক্ষে ওকালতি করতে শুরু করেন। ব্রাজিলের আর্থিক প্রগতির ক্ষেত্রে এটা জরুরি বলেও মন্তব্য করেন। বোলসোনারোর এই মনোভাব বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়। কার্যক্ষেত্রেও বোলসোনারো ঠিক এই পথেই এগিয়েছেন। দেশ-বিদেশের শক্তিশালী এগ্রিবিজনেস ও মাইনিং লবির স্বার্থেই তিনি সমস্ত নীতি প্রণয়ন করেছেন। দেশের সংসদে পিএল ৪৯০ নামে একটা কালাকানুন পাশ করেছেন যা অরণ্যের মধ্যে বসবাসকারী আদি উপজাতি মানুষদের সমস্ত অধিকারকে খর্ব করেছে। যথেচ্ছভাবে অরণ্য ধ্বংস করার অধিকার দিয়েছে বেসরকারি পুঁজিকে। আমাজনকে সংরক্ষণ এবং এখানে বসবাসকারী উপজাতি মানুষদের অধিকার যাতে বজায় থাকে তার জন্য ১৯৮৮ সালে ব্রাজিলে যখন নতুন সংবিধান তৈরি হয় তখন বিভিন্ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।এই সব ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই হয়েছে ওই কালাআইন।

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আন্দোলন হয়নি যে তা নয়, কিন্তু সব কিছুকেই বোলসোনারো সেনা-পুলিশ দিয়ে দমন করার পথেই হেঁটেছেন। এমনকী ওই মাফিয়াদের হাতে আমাজন বাঁচানোর আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের খুনের ঘটনাও ঘটছে। এই জুন মাসেই ওদের হাতে খুন হয়েছেন, ব্রিটিশ সাংবাদিক ডম ফিলিপ্স এবং ব্রাজিলীয় পরিবেশবিদ ব্রুনো পেরেইরা। এঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল আমাজন। এছাড়া বহু উপজাতি নেতা যাঁরা উপজাতিদের অধিকার ও আমাজন বাঁচানোর আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন তাঁরাও খুন হয়েছেন এই মাফিয়াদের হাতে। করোনা মহামারীর আগে পর্যন্ত এরকম খুনের সংখ্যা গত ১০ বছরে প্রায় ৩০০।

এই ধরনের খুন বোলসোনারো ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই হচ্ছে। তবে এই সময়ে বেশি হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর পক্ষে বোলসোনারোর সক্রিয় রাজনৈতিক সমর্থন থাকায় ব্রাজিলের প্রশাসন এর বিরুদ্ধে খুব একটা কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে পারেনি। এর পরিণতিতে অবাধে আমাজন বর্ষাবনের ধ্বংস চলেছে। বোলসোনারোর ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে আমাজনের ১৩ হাজার ৩৮ বর্গকিলোমিটার বনভূমি ধ্বংস হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত,অর্থাৎ ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমাজনের মোট বনভূমি ধ্বংসের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটার। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বোলসোনারোর মাত্র তিন বছরের শাসনেই ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট যে বনভূমি ধ্বংস হয়েছিল তাকে ছাপিয়ে গেছে শুধু নয়, ৭৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এমনিতে আমাজনে প্রায় প্রতিবছরই দাবানল হয়। প্রাকৃতিক নিয়মেই তা নিভেও যায়। কিন্তু গত তিন বছরে, আমাজনে দাবানলের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে এটা একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। দাবানলের বেশিরভাগটাই মনুষ্যসৃষ্ট। ব্রাজিলের শক্তিশালী এগ্রিবিজনেস এবং মাইনিং লবিই এইসব করাচ্ছে বলে তাঁদের ধারণা।



অরণ্য সাফ করে মাঠ করে ফেলা হচ্ছে।

পৃথিবীর এই সর্ববৃহৎ বর্ষাবন আমাজন ৬২ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। আমাজন নদীর দুধারে রয়েছে এই বনভূমি। এই বর্ষাবনের বাইরেও রয়েছে আমাজন নদীর অববাহিকা। আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যেতে পারে, প্রায় দুটো ভারত (ভারতের আয়তন ৩২ লক্ষ ৮৭ হাজার বর্গকিলোমিটার) আমাজনের অরণ্যের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ৪০ শতাংশ স্থানই দখল করে রয়েছে এই বর্ষাবন। এই মহাদেশের নয়টি দেশে - বলিভিয়া, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইক্যুয়েডর, ফরাসি গায়না, গায়না, পেরু, সুরিনাম এবং ভেনেজুয়েলায় আমাজন বর্ষাবন বিস্তৃত। এই বর্ষাবনের সবচেয়ে বড়ো অংশটাই রয়েছে ব্রাজিলে, প্রায় ৫৯ শতাংশ। এরপর পেরুতে ১২ শতাংশ। এই আমাজন অববাহিকাতেই রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী। যদিও এনিয়ে কিছু বির্তক আছে। আমাজন নদী সারা বছর যে পরিমাণ জল বহন করে তা কঙ্গোর থেকে পাঁচগুণ এবং মিসিসিপির তুলনায় বারোগুণ বেশি।

আমাজন বর্ষাবনেই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় অরণ্য উপজাতি মানুষের বাস। এখানে এত বৈচিত্র্যময় অরণ্য উপজাতি মানুষ বাস করেন তা পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। এদের মধ্যে অনেকগুলি উপজাতি গোষ্ঠী আছে যারা আধুনিক জনজীবন থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন। এই বর্ষাবনের এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখানে এখনো মানুষ পৌঁছতে পারেনি। এছাড়াও উদ্ভিদ এবং প্রাণিদের মধ্যে পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, উভচর, মাছ ও পতঙ্গের একটা বিরাট সংখ্যক প্রজাতির বাসস্থান হলো আমাজন। এত বিশাল জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণেও এই বর্ষাবনের অপরিসীম ভূমিকা রয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ সহ প্রাণিজগতের অস্তিত্ব বজায় রাখার পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এই সুবিশাল প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করেই চলছে খনিজ পদার্থ উত্তোলন ও কাঠ সংগ্রহ। ব্রাজিলে যা মোট খনিজ উত্তোলন হয় তার ৭২ শতাংশই হয় আমাজন থেকে। আর দেশে বিক্রিত কাঠের ৯৯ শতাংশই বেআইনিভাবে সংগ্রহ করা হয় এই অরণ্য থেকে।



যখন ব্রাজিলে ওয়ার্কার্স পার্টির সরকার ছিল এবং রাষ্ট্রপতি ছিলেন লুলা তখন কিন্ত ছবিটা এরকম হতাশাজনক ছিল না। আমাজন বর্ষাবন যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয় তার জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল ওয়ার্কার্স পার্টির সরকার। তারফলে লুলার রাষ্ট্রপতির সময় ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমাজনে অরণ্য ধ্বংস প্রায় ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। লুলা প্রশাসন যে ব্যবস্থাগুলি গ্রহণ করেছিল, বোলসোনারো ক্ষমতায় এসেই ওই ব্যবস্থাগুলিকে প্রথমে ভেঙে দেয়। বর্তমান সরকার যা কিছু করছে তা সবই বেআইনিভাবে অরণ্য ধ্বংসকে মোকাবিলা করার ব্যবস্থাকে খর্ব করার লক্ষ্যে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আমাজন বিশেষজ্ঞ এরিকা বেরেনগুয়ের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছেনঃ “এই বর্ষাবনকে বাঁচানোর জন্য যা করার দরকার তার ঠিক বিপরীত কাজ করছে এই সরকার। বোলসোনারো তাঁর নীতিসমূহের দ্বারাই সক্রিয়ভাবে অরণ্য ধ্বংসের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছেন।”

আর কয়েক মাস পরেই ব্রাজিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। সমস্ত সম্ভাব্য প্রার্থীই আমাজনের অরণ্য ধ্বংস শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। যদিও এব্যাপারে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে রয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী লুলা। তবে একটা বিষয় ব্রাজিলবাসীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, যদি আমাজনকে বাঁচাতে হয় তবে বোলসোনারোকে হঠাতে হবে।৫০ টি নাগরিক সংগঠনের নেটওয়ার্ক ব্রাজিলিয়ান ক্লাইমেট অবজারভেটরি’র এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি মার্সিও অ্যাসট্রিনির বক্তব্য এপ্রসঙ্গে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেনঃ “যদি বোলসোনারো পুনর্নির্বাচিত হন তাহলে আমাজনের ভবিষ্যৎ গভীর বিপদে। বোলসোনারোও নির্বচিত হবেন আবার আমাজনও বাঁচবে - দুটো একসঙ্গে কখনই সম্ভব নয়।”