সার্বিক সংকট থেকে পরিত্রাণ চাইছেন শ্রীলঙ্কার জনগণ
বিশেষ সংবাদদাতাঃ গণবিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। সিংহলি জাতীয়তাবাদকে উসকে পরিত্রাণ পেল না সংখ্যাগুরুবাদ। বেশ কিছুদিন ধরেই জীবন ধারণের সবরকম সামগ্রীর কমতে থাকা জোগান তীব্র অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের। বৈদেশিক আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানসমুহের সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের দেনা শুধতে গিয়ে দ্বীপভূমির কার্যত দেউলিয়ার দশা। সার্বিক সংকটের কালো ছবি গত মাসচারেক ধরেই শ্রীলঙ্কার মানুষের সামনে যত স্পষ্টতর হয়েছে, তত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে তাঁদের, গাঢ় হয়েছে এমন নৈরাজ্যের আবহ। খাদ্য থেকে জ্বালানি তেল-গ্যাস, বিদ্যুৎ থেকে ওষুধ, নিত্যব্যবহার্য সবকিছুই এখন তাঁদের নাগালের বাইরে। খাদ্যশস্য সহ আমদানি নির্ভর শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রা থেকে মজুদ খাদ্যের ভাঁড়ার প্রায় নিঃশেষ। কোথায় গেল আমাদের টাকা? প্রশ্ন তুলছেন বিক্ষুব্ধ মানুষ। নানা দুর্নীতির প্রশ্নেও তোলপাড় চলছে। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের রোষ থেকে ছাড় পাচ্ছেন না কেউই। জবাবদিহি চেয়ে জনতা নেতা-মন্ত্রীদের ধাওয়া করছেন নিয়মিত। তারই জেরে ৯ জুলাই থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের দখল অর্ধাহার-অনাহারে থাকা আমজনতার হাতে। পিঠ বাঁচানোর চেষ্টায় রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাক্ষে জরুরি অবস্থা জারি করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
পর্যবেক্ষকদের মত, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির অতি দ্রুত অবনতির পেছনে অন্যতম কারণ দিশাহীন অর্থনীতি। বেসরকারিকরণ করা হয়েছে ঢালাওভাবে। তাই সংকটের সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের পরিষেবা মেলেনি। অর্থনীতির মৌল ক্ষেত্র নড়বড়ে হয়ে গেছে। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি ঋণ নিলেও তা খরচ করা হয়েছে অনউৎপাদনশীল ক্ষেত্রে।
সংকট আঁচ করে করোনাকালের পরবর্তীতে জীবিকার খোঁজে অসহায় শ্রীলঙ্কাবাসীর একাংশ শরণার্থী হিসেবে অপর অংশ পাসপোর্ট নিয়ে দ্বীপভূমি ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন, দিচ্ছেন নিয়মিত। তামিলনাড়ুর থুথুকুরি বন্দর সহ লাগোয়া বেশ কিছু দ্বীপে আশ্রয় নিচ্ছেন শ্রীলঙ্কা থেকে আসা অসহায় শরণার্থীরা। আর ভারতের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ২০২০-২১ বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে ২০২১ সালের ১জানুয়ারি পর্যন্ত ১০৮ টি শরণার্থী শিবিরে ৫৮ হাজার ৮৪৩ জন শরণার্থী শ্রীলঙ্কা থেকে এসে আশ্রয় নিয়েছে। বলাবাহুল্য সংখ্যাটা বাড়ছে।
শোনা যাচ্ছে, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। দক্ষিণপন্থী অর্থনৈতিক নীতির সঙ্গে সংখ্যাগুরুবাদের মিশেল ঘটিয়েছিল শ্রীলঙ্কার গোতাবায়া রাজাপাক্ষের সরকার। অর্থনৈতিক সংকট চরমে পৌঁছানোর পরে এই সংখ্যাগুরুবাদের আবেগ গোতাবায়া সরকারকে রক্ষা করতে পারল না - শ্রীলংকার ঘটনাবলী দেখে প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষকদের। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের সংযোজন, ২০০৯ সালের তামিল জাতি দাঙ্গার পরিস্থিতি পেরিয়ে আসা শ্রীলঙ্কার গণতন্ত্র ২০২২-এ জনগণের মৌলিক দাবিসমূহ মেটানোর চ্যালেঞ্জের মুখে খুঁজছে ভিন্নতর বিকল্প। শ্রীলঙ্কা সরকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ স্থগিত করে এ বছরের এপ্রিল মাস থেকে।
এই সার্বিক ব্যর্থতা কেন - জনতার এহেন প্রশ্নে নিরুত্তর প্রশাসন। দেশের প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন আগেই। আক্রান্ত অন্যান্য নানা মাপের জনপ্রতিনিধি। রাষ্ট্রপতি ভবনের মতো আক্রান্ত তাঁদের বাসভবন, অফিস। ভারতের এই প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের সর্বত্র সরকারি বাহিনীর সতর্ক সংযমী আনাগোনা ছাড়া রাষ্ট্রের উপস্থিতির চিহ্ন প্রায় নেই। দেশজুড়ে মানুষের হাহাকারের ঢেউ সুনামি হয়ে আছড়ে পড়েছে গলের কাছেই সমুদ্রের ধারে থাকা রাষ্ট্রপতির আবাসে। রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজা খোলা। সেখানে যে কেউ ঢুকে ঘুরে আসছেন। সব ঘরই বিক্ষোভকারীদের দখলে। বিক্ষোভকারীরা দাবি করেছেন দেড় কোটির বেশি টাকা পাওয়া গেছে রাষ্ট্রপতি ভবনে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে টাকা গুনতেও দেখা গেছে বিক্ষোভকারীদের। সেই টাকা স্থানীয় পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কোনও অশান্তির ঘটনা ঘটেনি। কলম্বোর রাস্তাঘাটও ফাঁকা। দোকানপাট খুললেও মানুষের চলাচল খুবই কম। ৯ জুলাই সকাল থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন ঘিরে ফেলেছিলেন হাজার হাজার মানুষ। পুলিশের সঙ্গে প্রাথমিক সংঘর্ষের পরে ব্যারিকেড ভেঙে তাঁরা রাষ্ট্রপতি ভবনে ঢুকে যান। তার আগেই গোতাবায়া রাজাপাক্ষে পালিয়ে যান। এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কায় পরিবহণ ব্যবস্থা অচল। বিদ্যুৎ থাকছে না ১২-১৩ ঘণ্টা। বৃষ্টির অভাবে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। বিমসটেক গোষ্ঠীভুক্ত শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে কার্যকরী উদ্যোগ সেভাবে চোখে পড়ছে না।
এদিকে স্বাস্থ্য পরিষেবা যা শ্রীলঙ্কার গর্বের বিষয় ছিল সেখানে এই মুহূর্তে ছবিটা করুণ। চিকিৎসা পরিকাঠামো বিপর্যস্ত। শ্রীলঙ্কার ডাক্তাররা সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন জানাচ্ছেন চলতি সংকট মুক্তির জন্য ওষুধ এবং মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠানোর। এই মুহূর্তে অবশ্য সেনাবাহিনীকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের খাদ্যপণ্য বাজেয়াপ্ত করে ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তাতে বিক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধী দলগুলি বৈঠকে বসে ১০ জুলাই। একদিকে বিরোধী দল এসজেবি এবং জোটশরিকরা বৈঠকে বসে অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ফ্রিডম ফ্রন্ট সহ ন’টি দল বৈঠকে বসে। সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে আলোচনা হলেও তা সময়সাপেক্ষ বলেই বিরোধীদের ধারণা।
শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির মুখ্য কারণ হলো বিদেশি মুদ্রার ভাড়ারে টান। খাবারের মূল জোগান আমদানি নির্ভর এখানে। যেহেতু ডলার বাড়ন্ত তাই তার প্রভাবেই ঘটেছে যাবতীয় অঘটন, যার দায় এড়াতে পারে না সরকার। শ্রীলঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার জোগান আসে মূলত পর্যটন শিল্প, চা ও রবার রপ্তানি এবং প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রা থেকে। পর্যটন থেকে বার্ষিক আয় ছিল বারো বিলিয়ন ডলার। কোভিড পরবর্তী সময়ে প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের পাঠানো টাকায় ঘাটতি পড়ে। অতিমারীর কোপে তাঁদের অনেকেই চাকরি খোয়ান এবং বেতন সংকোচনের কোপে পড়েন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো বিদেশি মুদ্রাতেও ঘাটতি দেখা যায়। করোনার প্রকোপে গত বছর দুয়েক ধরে এমনিতেই কমেছে বিদেশি পর্যটকদের আসা। ২০১৯ সালে কলম্বোর একটি চার্চে আত্মঘাতী বোমা হামলা এবং বিস্ফোরণে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এই ঘটনা শ্রীলঙ্কার আইন শৃঙ্খলা এবং জঙ্গি কার্যকলাপ সম্পর্কে ভিনদেশি পর্যটন প্রিয় মানুষের মনে ভীতি তৈরি করে দেয়। যার নিট ফল পর্যটকের সংখ্যায় ব্যাপক হ্রাস। প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৭.৫ বিলিয়ন ডলার। যা এ বছরের জুলাই মাসে কমে দাঁড়িয়েছে ২.৮ বিলিয়ন। শ্রীলঙ্কার সরকার এই পরিস্থিতিতে আমদানিতে লাগাম পরিয়েছেন। এর জেরে প্রত্যাশিতভাবেই শ্রীলঙ্কার টাকার দাম ভয়াবহ ভাবে পড়ে গেছে, যা সংকটকে গভীরতর করেছে- ঘটেছে মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি।
আবার ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কা সরকার করকাঠামোর ব্যাপক সংস্কার করে কর্পোরেট এবং ধনীদের ওপর চাপানো কর ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। কর হ্রাসের জেরে রাজস্ব খাতে সরকারি আয় ব্যাপকভাবে কমে যায়। একইসঙ্গে আয়কর এবং ভ্যাট কমানো হয় ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে। পরিসংখ্যান বলছে রাষ্ট্র হারিয়েছে ১.৪ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছরে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচেও আয় করার কথা উঠছে বেশ কিছুদিন ধরেই। টিমটিম করে চলা সরকারের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে বেচে দেওয়া হতে পারে রাষ্ট্রায়ত্ত শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্স। বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ২০০ শ্রীলঙ্কার টাকা দর চলছে ডলার পিছু। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ট্রেডিং এর সঙ্গে যুক্ত ব্যবসায়ীদের মুদ্রা বিনিময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকার। বিশ্ব ব্যাংক ঋণ দিতে গড়িমসি করছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভান্ডার (আইএমএফ) বলেছে সংকট মুক্তির জন্য এই মুহূর্তে সুদের হার এবং কর বসানো হোক চড়াহারে।
এরমধ্যে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় ২০২১ সাল থেকে অধুনা পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষে জৈব চাষের উপর জোর দেওয়ায়। কোনো পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই রাজাপাক্ষে রাসায়নিক সারের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেন সব ধরনের চাষের ক্ষেত্রে। কৃষি ক্ষেত্রে এর ভয়ংকর প্রভাব পড়ে। ফসলের উৎপাদন পড়তে থাকে। জোগান কম থাকায় ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার জেরে আরও বাড়তে থাকে খাদ্যশস্য সহ সমস্ত পণ্যের দাম। এই চাপ সামলানো দ্বীপ রাষ্ট্রের ৮১ বিলিয়ন ডলারের মাপের অর্থনীতির পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষত বিপুল আন্তর্জাতিক দেনা যা ২০২৬ সালের মধ্যে শোধ করার কথা সেই চাপও দিশেহারা করে দেয় শ্রীলঙ্কাকে।
দ্বীপভূমিতে রাষ্ট্র সংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম পরিচালিত এক সমীক্ষায় ভয়াবহ ফলাফল উঠে এসেছে। ওই সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে শ্রীলঙ্কার প্রতি দশটি পরিবারের মধ্যে ন’টি প্রতিদিন একবেলা খেতে পাচ্ছে না। মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৪.৬ শতাংশ। যা বেড়ে পৌঁছতে পারে ৭০ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম প্রথম সরকারপক্ষ বলতে আরম্ভ করে খাদ্য পণ্যের ফাটকা ব্যবসা এবং কালোবাজারি মজুতদারি এই মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। কিন্তু জনমানসে তা দাগ কাটতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার মানুষের ক্ষোভ রুখতে এ বছর তিন-দফায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। প্রথমবার ১ এপ্রিল দ্বিতীয়বার ৬ মে। দুটি ক্ষেত্রে কয়েকদিন পরেই তা প্রত্যাহার করতে হয় সরকারকে। পরবর্তীতে টালমাটাল পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে হয় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাক্ষেকে। তারপর এক বছর মেয়াদে রনিল বিক্রম সিঙ্ঘে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এবছর এপ্রিল মাসের ৩ তারিখে গোটা মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে, সেই সঙ্গে সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নর পদত্যাগ করেন। অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করেন ৫ এপ্রিল। এর জেরে সংসদে গরিষ্ঠতা খোয়ান রাষ্ট্রপতি।
ঘটনা পরম্পরার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে, সিংহলি জাতীয়তাবাদকে উসকে দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও সিংহলিরা বিপন্ন এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছে। একদিকে তামিল ও অন্যদিকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই ধারণাকে ব্যবহার করা হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট থেকে নজর ঘোরানোর জন্য। কিন্তু জাতীয়তাবাদ দিয়ে জনতার ক্ষোভকে তাই শেষ পর্যন্ত সামলানো যায়নি।