E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

কলম্বিয়ায় বামপন্থীদের জয় (২)

লালন ফকির


(পূর্ববর্তী সংখ্যার পর)

দক্ষিণ আমেরিকার উত্তর পূর্বে অবস্থিত কলম্বিয়ায় এই প্রথম বামপন্থী প্রার্থী রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হলেন। দীর্ঘকাল একটা দক্ষিণপন্থী শক্তি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার পর বামপন্থী প্রার্থীর জয় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বি‍‌শেষত পেরু, চিলি এবং হন্ডুরাসের পর কলম্বিয়ায় বামপন্থী প্রার্থীর জয় বি‍‌শেষ অর্থবহ। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার পূর্ববর্তী সময়ে কলম্বিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন। বিশেষত ঔপনিবেশিক শাসন পর্বের পর কলম্বিয়ার আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলোচনা জরুরি।

কলম্বিয়ার সাম্প্রতিক ইতিহাসের গতিধারায় ১৮৮৪ সালে রাফা এল ন্যুনেজ নামে এক কট্টর রক্ষণশীল ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি পদে জয়ী হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে ১৮৮৬ সালে দেশের নতুন সংবিধান তৈরি হয়। এই সংবিধান মোতাবেক কলম্বিয়া হয়ে ওঠে একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র। এই সংবিধান কার্যকর করতে চার্চের কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়। এমনকী দেশের সমগ্র শিক্ষা ব্যিবস্থাকে চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন করে দেওয়া হয়। রাফা এল ন্যুনেজ ছিলেন একজন স্বৈরতন্ত্রী শাসক, তিনি তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের জেলে পাঠিয়ে দেন অথবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। এইভাবে আমৃত্যু দেশ শাসন করে গেছেন তিনি। দেশজুড়ে তিনি এক স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরই শুরু হয় জনগণের তুমুল বিক্ষোভ। লিবারেলরা এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন। ১৮৯১ সাল থেকে কনজারভেটিভ লিবারেলদের সংঘর্ষ গৃহযুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করে। সরকারি বাহিনী লিবারেল কর্মীদের বিক্ষোভ দমনে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই গৃহযুদ্ধে প্রায় এক লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। কলম্বিয়ায় সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে।

১৯০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে কলম্বিয়া থেকে পানামা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর পূর্ব পর্যন্ত পানামা কলম্বিয়ায় অবস্থিত ছিল। এর ফলে স্বভাবতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর কলম্বিয়া বেশ কিছুটা বিক্ষুব্ধ হয়েছে। এই বিক্ষোভ কোনো বিপ্লব বা সংগ্রামের জন্ম দেয়নি। কলম্বিয়াকে শান্ত করতে ১৯২৭ সাল থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত ২.৫ কোটি ডলার ঋণ নেওয়া হয়। মার্কিন তৈল কোম্পানি পূর্ব কলম্বিয়ায় ৪.৫ কোটি ডলার খরচ করে এবং মার্কিন ব্যাঙ্কগুলির কাছ থেকে ভাল পরিমাণ ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা হয়।

মার্কিন ঋণ ও আর্থিক সাহায্যে কলম্বিয়ার উন্নতি ঘটানো হয়। ১৯৭৯ সালে সমগ্র বিশ্বের সাথে কলম্বিয়াও অথনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়। এর ফলে কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী রাষ্ট্রপতি হন আলফানসো লোপেজ (১৯৩৪-৩৮), এডওয়ার্ড সান্তোষ (১৯৩৮-৪২), আলফানসো লোপেজ (দ্বিতীয়বার ১৯৪২-৪৫), অ্যালিসেরাল কাসোরনো (১৯৪৫-৪৬)। কিন্তু লিবারেল রাষ্ট্রপতির আমলে কলম্বিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব যেমন স্থায়ী হয়েছে, চিরাচরিতভাবে মার্কিন ঋণ ও সাহায্য কলম্বিয়া পেয়েছিল। দেশের প্রধান রপ্তানী পণ্যের মধ্যে ছিল কফি। তখনও পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল প্রধান রপ্তানিকারক। মহামারী রোগ ইয়েলো ফিভার মহামারীর মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলি উদ্যোগ গ্রহণ করে। বলা চলে এদের এই উদ্দেশ্য যে মহামারী প্রতিরোধ ছিল না তা বলাই বাহুল্য।

লিবারেলদের মধ্যে যারা বামপন্থী তারা এসব ভাল চোখে দেখেনি। পরবর্তীকালে এর সুযোগে বামপন্থী লিবারেল নেতা ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রপতি হন মারিয়ানো পিরেজ (১৯৪৬-৫০)। পিরেজের আমলে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো জনপ্রিয় নেতা গের্দে গাইতানের হত্যাকাণ্ড। ১৯৪৮ সালের ৯ এপ্রিল রাজধানী শহর বোগোটার কেন্দ্রস্থলে গাইতান নিহত হন। শহরে তখন ইন্টার আমেরিকান কনফারেন্স চলছিল। ফলে এই ঘটনা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ জনতা রাস্তায় নেমে পড়ে। শুরু হয় সংঘর্ষ। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কলম্বিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়, কারণ মার্কিন প্রশাসন থেকে প্রচার করা হয় এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কমিউনিস্টরা দায়ী।

বোগোটার রাজপথে গাইতানের মৃত্যুর পর থেকে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় পরবর্তী কয়েক দশকে তা নানাভাবে কলম্বিয়ার রাজনৈতিক ঘটনাগুলিকে প্রভাবিত করে। এই সংঘটিত গৃহযুদ্ধের নাম লা ভায়োলেনশিয়া।

কনজারভেটিভ-লিবারেল দ্বন্দ্ব থেকেই লা ভাগোলেনশিয়ার উদ্ভব। কিন্তু একে ইন্ধন জুগিয়েছিল দেশের অর্থনৈতিক সংকট, জনজীবনের স্থবিরতা, দারিদ্র্য, ক্ষুধা আর বেকারির উপজাত সমাজবিরোধীরা। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ হয়ে ওঠে যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।

এই অবস্থায় নির্বাচন এগিয়ে আনা হয়। কিন্তু খুনোখুনি আরও বেড়ে যায়। এর সুযোগ নিয়ে সামরিক আইন জারি করা হয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। ১৯৫০ সালের নির্বাচনে জয়যুক্ত হন লারিয়ানো কামারগো। ইনি ছিলেন হিটলার ভক্ত এবং ফ্রাঙ্কো অনুগামী।

দেশের অথনৈতিক অবস্থা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের পরে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়ার অভ্যন্তরীণ বাজারে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে বিদেশি ঋণও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে সর্বাধিক ছিল মার্কিন ঋণ বৃদ্ধি।

এই সময় ভায়োলেনশিয়া কিছুটা স্তিমিত হয়েছিল। জনগণও নতুন করে আবার আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। তাদের ধারণা হলো কনজারভেটিভ এবং লিবারেল যৌথভাবে ওদের সমস্ত যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারে।

পরবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হন আলাবার্তো লিয়ারেন কামারগো, যিনি এর পূর্বে একবার রাষ্ট্রপতি ছিলেন। উভয় দলের একটা দিক যে উভয় দলই নির্বাচনের পূর্বে একটি জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল। এই জাতীয় ফ্রন্ট গড়ে উঠেছিল তিনটি প্রধান ভিত্তির উপর। এই ভিত্তির মধ্যে ছিল (১) ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত এই ১৬ বছরে একবার লিবারেল আর একবার কনজারভেটিভ এইভাবে পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রপতি হবেন। (২) সরকারি কাজগুলি উভয় দলের মধ্যে বণ্টিত হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, কোনও উচ্চতর পদে একজন লিবারেল প্রার্থী নিযুক্ত হলে তার নিচের পদটি পাবেন একজন কনজারভেটিভ প্রার্থী। তারপর আবার লিবারেল নিযুক্ত হবেন। (৩) সংসদে আইন প্রণয়ন করতে গেলে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে।


(পরবর্তী সংখ্যায়)