প্যারি কমিউনের গান
কঙ্কণ ভট্টাচার্য
বিপ্লবের দেশ ফ্রান্স। পৃথিবীর সমাজ ব্যবস্থাকে আধুনিক করে তোলার প্রয়াসে যে দু'টি বিপ্লবের অবদান সবচেয়ে বেশি, সে দুটিই ঘটেছিল ফ্রান্সে। প্রথমটি ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ থেকে ১৭৯৯ অবধি ঘটা এই বিপ্লব আধুনিক পৃথিবীর গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিল। আর ১৮৭১ সালে ঘটা প্যারি কমিউন শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রয়াস। সীমাহীন রক্তপাতের মধ্য দিয়ে পরাজয়ে এই বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটেছিল। কিন্তু ৭২ দিনের এই কমিউন ৪৬ বছর বাদে ঘটা রুশ বিপ্লবের রাস্তা তৈরি করেছিল।
প্যারি কমিউনের অব্যবহিত পূর্বে ফ্রান্স প্রুশিয়ার সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। এই যুদ্ধ চলেছিল ১৮৭০ সালের ১৯ জুলাই থেকে ১৮৭১ সালের ২৮ জানুয়ারি। ফ্রান্সের নিয়মিত সেনা বাহিনী প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল থাকার কারণে রাজধানী প্যারিসকে রক্ষা করার জন্য ন্যাশনাল গার্ডস গঠন করা হয়েছিল। প্রয়োজনে গড়ে ওঠা এই সেনাদলে মূল অংশীদার ছিলেন ফ্রান্সের বিভিন্ন অংশের শ্রমিক কর্মচারীরা। তাদের সকলের মিলিটারি অভিজ্ঞতা বা যুদ্ধ শিক্ষা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু প্যারিসকে রক্ষার কাজে তাদের নিজেদের মধ্যে এক বন্ধুত্ব, সমঝোতা ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে। বামপন্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণে তাদের মধ্যে এক বিপ্লবী রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি হয়।
এই সময়ে ফ্রান্সের সামাজিক বৈষম্য ছিল অতি প্রকট। ধনী সামন্তপ্রভুরা সমস্ত সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন, কিন্তু তাদের কোনো ট্যাক্স দিতে হতো না। ব্যবসায়ী ও কল মালিকদেরও ট্যাক্স দিতে হতোনা। কিন্তু বাকি শতকরা ৮০ ভাগ খেটে খাওয়া মানুষকে সমস্ত ট্যাক্সের বোঝা বহন করতে হতো। বাজারের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অপরদিকে চার্চের স্বেচ্ছাচারিতা ও ফরমানে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল।
যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় ঘটে। এতে দেশে প্রবল গণবিক্ষেভের ঢেউ ওঠে। ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় রিপাবলিক-এর পতন হয় এবং মার্চ মাসে এডলফ থিয়েরস’এর নেতৃত্বে তৃতীয় রিপাবলিক গঠিত হয়। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যে শক্তিশালী ন্যাশনাল গার্ডস ১৮ মার্চ ১৮৭১ ফ্রান্সের সরকারকে মান্যতা না দিয়ে প্যারিসের ক্ষমতা দখল করে। একই সঙ্গে প্যারী কমিউনের স্বাধীন সরকার ঘোষিত হয়। ২৬ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় কমিউনের সাধারণ কাউন্সিল নির্বাচন। এটিই প্যারি কমিউনের সূচনা পর্ব।
প্যারি কমিউন মাত্র ৭২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু বিপ্লবী চরিত্রের কারণে বিগত ১৫২ বছরে সারা পৃথিবীর শিল্প সাহিত্যের সব বিভাগে প্যারি কমিউন অজস্র শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, ফিল্ম, চিত্র শিল্প, পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গ সংগীত, কমিকস এমনকী হালফিলের টিভি সিরিজেও প্যারি কমিউন তার উজ্জ্বল উপস্থিতি রেখেছে।
কিন্তু গানে প্যারি কমিউনের প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। কিছু গান কমিউনার্ডদের মধ্যে উন্মাদনা করার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষকে জাগানোর ভূমিকা পালন করেছিল। কিছু গানে কমিউন চলাকালীন তার ঘটনাবলি ব্যক্ত হয়েছিল। আর কমিউনের পতন হবার পর থেকে দীর্ঘদিন অজস্র গানে প্যারি কমিউনের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ও আবেগ প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা এই রচনায় মূলত কমিউনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট কিছু গানের কথা উল্লেখ করবো।
প্যারি কমিউনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বেশ কিছু অত্যন্ত শক্তিশালী স্রষ্টা যুক্ত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ইউজিন পঁতিয়ের-এর নাম সবচেয়ে আগে উল্লেখ করতে হয়। তাঁর রচিত বহু গান-কবিতার মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক সংগীত’ আজ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত সংগীত হিসাবে স্বীকৃত। শতাধিক ভাষায় অনুদিত হয়ে এই গান আজ সব দেশে মেহনতি মানুষের গানে পরিণত হয়েছে।
ইউজিন পঁতিয়ের-এর ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে লেনিন বলেছিলেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে থাকা একজন মেহনতি মানুষ এই গানের মধ্য দিয়ে সারা পৃথিবীময় সমস্ত সর্বহারা মেহনতি মানুষের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপন করতে পারবেন। বস্তুত সর্বহারা আন্তর্জাতিকতার ভাবধারার এত ভাল শিল্পরূপ আর দেখা যায় না।
পঁতিয়ের ১৮১৬ সালের ৪ অক্টোবর জন্মেছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি জীবনের প্রথম গান সৃষ্টি করেছিলেন যার নাম ছিলঃ স্বাধীনতা দীর্ঘজীবী হোক! ১৮৪৮ সালে তিনি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ব্যারিকেডে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অত্যন্ত গরিব ছিলেন। সারা জীবনে তিনি বহু গান নিয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। প্যারি কমিউনের কাউন্সিলে তিনি ৩৬০০ ভোটের মধ্যে ৩৩৫২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমিউনের পরাজয়ের পর তিনি প্রথমে ইংল্যান্ড এবং পরে আমেরিকায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। প্যারি কমিউনের পতনের নয় বছর পর উনি দেশে ফিরে এসে ওয়ার্কার্স পার্টিতে যোগ দেন। ১৮৮৭ সালের ৮ নভেম্বর তিনি প্রয়াত হন। মেহনতি মানুষের এক বিরাট জনতা তাঁর দেহ বহন করে ‘পেরে লাছাইসে’ সমাধিক্ষেত্রে নিয়ে যান যেখানে মৃত্যু দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত অসংখ্য কমিউনার্ড চিরতরে ঘুমিয়ে আছেন। পুলিশ এই অনুষ্ঠানে নৃশংস আক্রমণ করে লাল পতাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। সমবেত বিশাল জনতা স্লোগান দিতে থাকে ‘‘পঁতিয়ের দীর্ঘজীবী হউন’’।
সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে প্যারি কমিউনের সবচেয়ে বড়ো অবদান ‘গণসংগীত’ নামে এক নতুন জাতের সংগীতের জন্ম দেওয়া। লক্ষ করলে দেখা যাবে এই গানের এমন কিছু গুণাবলি আছে যা ইতিপূর্বে সৃষ্ট অন্যান্য সব গান থেকে আলাদা। প্রতিবাদ বিদ্রোহের গান আগেও বহু সৃষ্টি হয়েছে, আজও হচ্ছে। কিন্তু গণসংগীত এমন এক গান যা বেশ কাল ভূগোলের কোনো সীমারেখা মানেনা। এ গান কোনো জাত ধর্ম ভাষা বা সম্প্রদায়েরও গান নয়। গণসংগীত সারা পৃথিবীর যে কোনো জায়গার মেহনতি মানুষের গান। এই গান অতীতের সমস্ত সামাজিক অধীনতাকে অস্বীকার করে এক নতুন মুক্ত স্বাধীন সমাজের জন্ম দেওযার অঙ্গীকার করে। তাই যে কোনো ভাষায় অনুদিত হলেও সেটি সে দেশের গান হয়ে ওঠে। আমরা সেই ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি।
প্যারি কমিউনের জন্ম কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। আগে থেকেই বঞ্চিত নিপীড়িতরা এমন কিছুর স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু সেই সময়ের কিছু গানে দু'টো মানে থাকতো। চট করে শুনলে তাকে একটি নিরপরাধ প্রেমের গান বলে মনে হতে পারে। খতিয়ে শুনে হদয়ঙ্গম করলে দেখা যাবে তা অন্য কিছু। ১৮৭০ সালেই ইউজিন পঁতিয়ের একটি গান রচনা করেছিলেন। তা শুনলে বিষয়টি পরিস্কার হবে।
সে কখন আসবে
কথাঃ ইউজিন পঁতিয়ের, ১৮৭০
সুরঃ ম্যাক্স রঙ্গিয়ার, ১৮৭১
বলো সে কখন আসবে
কখন আবার ভালবাসবে
আমি যে বসে আছি তারই আশাতে
যত মানুষ দেখতে পাই
সবার কাছে জানতে চাই
দেখেছ কি তাকে এই রাস্তাতে।
সে অতি সুন্দর এক সন্তান
সে যে সময়ের ভালবাসার দান
আমি খুঁজি খুঁজি খুঁজে বেড়াই তারই ঠিকানা
আমি যে আছি তারই আশাতে।
তাকে ছাড়া আমি যে মৃত
সেই দিতে পারতো অমৃত
খাদ্য নেই বস্ত্র নেই তীব্র শীতে জমে যাই
কত যুগ কেটে গেল তারই প্রতীক্ষায়।
এই শিশুটির নাম বিপ্লব
আমি স্বপ্নে দেখি তার অবয়ব
সে নাচে গায়, বার বার ডাক দিয়ে যায়
আর কতদিন থাকবো বল তার প্রতীক্ষায়।
সত্যিকারের লাল পতাকা উড়িয়ে প্রথম বিপ্লবের নাম অবশ্যই প্যারি কমিউন। শুনুন সেই সময়ের লাল পতাকার গান।
লাল পতাকার গান
কথাঃ পল ব্রাউজে, ১৮৭৭ ও এছিলে লে রয়, ১৮৮৫
সুরঃ অজানা
জনতার পতাকাটা গভীর লাল
তার গায়ে মাখা শহিদের রক্ত
তার ডান্ডাটা দীর্ঘ বজ্রকঠিন
দিনে দিনে হয় আরো শক্ত।
জনতার পতাকাটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরো
তার ছায়াতেই আমরা বাঁচি মরি
দালাল আর কাপুরুষ যত পিছে টানে
আরো তাকে উঁচু করে ধরি।
চেয়ে দেখ ফরাসিরা ভালবাসে তাকে
জার্মান শ্রমিকেরা গায় তার গান
মস্কোতে শুরু হলো তার বন্দনা
শিকাগো যোগ দেয় নিয়ে মন প্রাণ।
এরই নিচে শিশুদের স্বপ্ন দেখা
দিন কেটে নেমে আসে রাত
এ পতাকা দেখেছে বহু ওঠাপড়া
লাল রঙই পৃথিবীর আনবে প্রভাত।
এটি বিজয়ের অতীতকে স্মরণ করায়
মনে প্রাণে শান্তির আশা যে জাগায়
এই উজ্জ্বল ঝকঝকে নিশান আমার
অধিকার চেতনার গান শোনায়।
এ পতাকা দুর্বলের বুক চেরা ধন
তারা জানে এ নিশান শক্তি আর বল
ধনী খুনী হত্যাকারী যা বলে বলুক
এ পতাকা ছিঁড়বেই তাদের ছল।
মাথা উঁচু করে তাই সকলে বলি
যতক্ষণ দেহে আছে এতটুকু প্রাণ
ফাঁসি কি গিলোটিন যা বরাদ্দ থাক
গেয়ে যাব লাল পতাকার এই গান।
আগেই জানিয়েছি ২৬ মার্চ, ১৮৭১ কমিউনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে ২০,০০০ অধিবাসীর বিপরীতে একজন হিসাবে ৯২ সদস্যের একটি কমিউন কাউন্সিল নির্বাচিত করা হয়। এরপরই তারা কমিউনের কর্মপদ্ধতি রচনা করেন। কমিউনের প্রধান কয়েকটি শর্ত ছিল, যেমনঃ
১. রাষ্ট্র থেকে গির্জা এবং গির্জা থেকে স্কুলকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।
২. কোনো প্রকার স্থায়ী সেনাবাহিনী থাকবে না বরং সাধারণ জনগণের দ্বারাই তৈরি হবে সশস্ত্র বাহিনী। ‘কমিউনের প্রথম ডিক্রিই ছিল স্থায়ী সৈন্যবাহিনীর বিলোপ ও সশস্ত্র জনগণ দিয়ে তার স্থান পূরণ’।
৩. একজন দক্ষ শ্রমিকের চেয়ে কোনো অবস্থাতেই কোনো সরকারি কর্মকর্তা বেশি বেতন পাবেন না। ‘রাষ্ট্রের বড়ো চাকুরেদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সমস্ত বিশেষ সুবিধা ও প্রতিনিধিত্ব ভাতাও দূর’ করা হয়েছিল। ‘রাষ্ট্রের সমস্ত পদাধিকারীর বেতন হবে মজুরের বেতনের সমান’।
৪. সরকারের সকল স্তরের কর্মকর্তাগণ অবশ্যই জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন এবং প্রয়োজনে তাদেরকে অপসারণের অধিকারও থাকবে। ‘কমিউন গঠিত হয় প্যারিসের বিভিন্ন পল্লিতে সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত পৌর পরিষদ সভ্যদের নিয়ে। তারা ছিল জবাবদিহিতে বাধ্য এবং যে কোনো সময়ে অপসারণীয়। স্বভাবতই তাদের অধিকাংশই ছিল শ্রমিক, অথবা শ্রমিক শ্রেণির স্বীকৃত প্রতিনিধি।
৫. নির্ধারিত সময়ান্তে প্রত্যেক ব্যক্তিই অর্থনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করবেন। লেনিনের কথায়, ‘যদি প্রত্যেকেই আমলা হয়ে যান, তবে আর কেহই আমলা থাকবেন না’। ‘রাষ্ট্রক্ষমতার কাজগুলো যত চালাবে সর্বজনগণ, ততই হ্রাস পাচ্ছে সে ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা’। মার্কস লেখেন, ‘কমিউনের অস্তিত্বটাই ছিল স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে, স্থানীয় আত্মশাসনের সঙ্গে জড়িত’।
প্যারি কমিউন ছিল শ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতা দখলের প্রথম নিদর্শন। একটা নতুন সমাজ ব্যাবস্থা চালু করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলনা। প্রতিদিন কাজের মধ্য দিয়ে তাদের নতুন রাস্তা তৈরি করতে হত। প্যারি কমিউনের বিপ্লবীদের বলা হতো কমিউনার্ড। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরাট সংখ্যায় হত্যা করা হয়েছিল। ওদের আত্মদানের কথা স্মরণীয় হয়ে থাকবে গানে। একটি গানের অংশ শুনুন -
ওরা কমিউনার্ড
কথাঃ জিন ব্যাপটিস্ট ক্লিমেন্ট, ১৮৮৩
সুরঃ অজ্ঞাত, ১৮৯২
ইঁদুরের মত ওরা আমাদের নিল ধরে
আমাদের রক্তপাতে সব রাস্তা গেল ভরে
সে রক্ত আজও মোছেনি, মৃত্যু আজও ঘোচেনি
তবু স্বপ্ন আজও বেঁচে আছে আমাদের ছাড়েনি।
(সমবেত)
এসো আজ সবে মিলে এক হয়ে
পতাকাটা তুলে ধরি নির্ভয়
নৃত্যের ছন্দে মুক্তির আনন্দে
হেঁকে বলি জয় হবে আমাদের জয়।
নরকিট যত পুঁজির দালাল
বিপ্লবীদের হত্যা করে চলে
কিন্তু প্রুসিয়ানদের সামনে
সাহস লুকায় অতলে।
থিয়ার্স-এর অনুচর, ম্যাক মোহনের দল
রক্তে স্নান করতে চাইল
কিন্তু ছিটকে গিয়ে নিজেরাই
ইতিহাসের কবরে ঠাঁই পেল।
অনেক সময় পুরনো সৃষ্টিও সময়ের প্রয়োজনে নতুন করে ফিরে আসে। পরবর্তী গানটিও এমনই একটি সৃষ্টি। এটি আসলে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিতীয় এনথেম ছিল। বাস্তিল দুর্গ পতন উপলক্ষে রচিত এই গান ১৮৭১ সালে প্যারিস কমিউনে আবার ফিরে আসে এবং কমিউনের অন্যতম প্রধান গান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিদায়বেলার গান
কথাঃ মেরি জোসেফ চেনিয়ার, ১৭৯৪
সুরঃ ইটিয়েনে নিকোলাস মেহুল, ১৭৯৪
বিজয়ের মন্ত্র দরজা খুলে দেয়
মুক্তির শ্লোগান রাস্তা দেখায়
উত্তর থেকে শুরু দক্ষিণ দিকে
যুদ্ধের দামামা বেজে যায়।
সুতীক্ষ্ণ বিউগিল জানান দিল
এই শুরু যুদ্ধের দ্রিম দ্রিম
ফ্রান্সের শত্রুরা কাঁপছে ভয়ে
রাজা খায় রক্ত হাড় হিম।
বিপ্লবী বন্ধুরা এগিয়ে চলে
অত্যাচারী খোঁজে কফিন
প্রজাতন্ত্র হাঁক পেরে ডাক দেয়
আগে চলো বিজয়ের আসে দিন।
একজন ফরাসিকে বেঁচে থাকতেই হবে
প্রয়োজন হলে তাকে মরতেও হবে
সব কান্না দূরে ঠেলে দিয়ে
বিজয়কে কাছে টেনে আনতেই হবে।
এখনকার গানটি প্যারি কমিউনের প্রস্তুতির সঙ্গে জড়িত অন্যতম রাজনৈতিক নেতৃত্ব অগাস্টে ব্ল্যাঙ্কি'র প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ। তিনি অবশ্য প্যারিস কমিউনের সংগ্রামে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। কারণ ক্ষমতা দখলের আগের দিন ১৭ মার্চ উনি গ্রেপ্তার হন।
সেই বিদ্রোহী
কথাঃ ইউজেন পঁতিয়ের, ১৮৮০
সুরঃ পিয়েরে দেগেতার, ১৮৮৫
বিদ্রোহী সে, নাম তার কেউ জানেনা
সে পশু নয় বোঝা বইবার
করো আজ্ঞা মেনে সে চলেনা
যুক্তি ছাড়া মানেনা সে আর কিছু
সে জানে কেন পৃথিবীটা ঘুরছে
কোন নিয়মে রাত শেষে লাল সূর্য উঠছে।
(সমবেত)
সামনে তার বর্বর দুর্দশা
সামনে তার ভারি দাসত্ব
তবু বিদ্রোহী দাঁড়িয়ে অটল
হতে তার বুলেট বোঝাই রাইফেল।
আমরা তাকে ব্যারিকেডে নিত্য দেখি
কমরেডদের সাথে হাতে হাত
হাসি ঠাট্টার মাঝে লড়াইযের ঝুঁকি
চিনিয়ে দেয় বিদ্রোহীর জাত
তার ভাবনার রঙ দিয়ে অন্যকে রাঙায়।
প্যারি কমিউনে যে গানটি সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং পরবর্তী কালেও কমিউন বললেই যে গানের কথা মনে আসে সেটি হল 'চেরি ফুলের মরসুম'। আর সে গানটি রচিত হয়েছিল বিপ্লবের পাঁচ বছর আগেই। এ গানটি শুনলে প্রথমে প্রেমের গান বলেই মনে হবে। কিন্তু যারা কমিউনকে অনুভব করেন তারা জানেন এতে লুকিয়ে আছে কমিউনের প্রতি ভালবাসা আর বেদনার অনুভূতি।
চেরি ফুলের মরসুম
রচনাঃ জিন ব্যাপটিস্ট ক্লিমেন্ট, ১৮৬৬
সুরঃ এন্টয়িন রেনার্ড, ১৮৬৮
যখন চেরির সময় আমরা গান গাইতে আরম্ভ করি
পুরুষ নাইটিঙ্গেল আর কালো মকিংবার্ড নাচ ধরে
সুন্দরী মেয়েরা বসন্তের উষ্ণ সাজে
প্রেমিকের হৃদয়ে ডাক পাঠায়
আমরা যখন চেরির মরসুমে গান গাই।
তবে চেরির মরসুম খুব কম সময়ের জন্য
যখন যুবকেরা ভালবাসার স্বপ্ন দেখে
আর তারা যুবতীর কানে লাল দুল পরায়
আর দুজনে যুগলে ঘুরে বেড়ায়
তখন পাতার ফাঁক দিয়ে রক্তের ফোঁটার মতন
চেরি ফল খসে খসে পড়ে
যদিও চেরির মরসুম খুব কম সময়ের।
যখন তুমি চেরির মরসুমে আছ
তুমি যদি প্রেমের আঘাতকে ভয় পাও
তবে সুন্দরীদের এড়িয়ে চলো
আমি কিন্তু ভয় পাইনা নিষ্ঠুরতম বেদনাকে
আমি একদিনও দুঃখ যন্ত্রণা ছাড়া থাকিনা
যখন তুমি চেরির মরসুমে থাকবে
তুমিও সে বেদনা অনুভব করবে।
আমি সবসময় চেরি মরসুম পছন্দ করি
এই সময়কে বুকে আগলে রাখি
কিন্তু আমি জানি সে এক উন্মুক্ত ক্ষত
ঐশ্বর্যের দেবীও আমাকে এমন কিছু দিতে পারেন না
যাতে যন্ত্রণা সেরে যায়
তবু আমি সব সময় চেরির মরসুমকে স্বাগত জানাবো
আর সেই স্মৃতি আগলে রাখবো।
১৮৭১ সালের ২১ মে থিয়েরের প্রতিবিপ্লবী সৈন্য বাহিনী প্যারিস শহরে প্রবেশ করে ও শ্রমিকদের ওপর নিষ্ঠুর দমননীতি চালায়। প্রায় ৩০,০০০ জন নিহত, ৫০,০০০ জন ধৃত ও হাজার হাজার লোক কারাদণ্ডিত হয়। বুর্জোয়া সেনাপতিবৃন্দের ঘোষিত নীতি ছিল 'কোনো দয়ামায়া দেখানো চলবে না'। কমিউনার্ড বা কমিউনের সেনানীদের দমন করতে তারা যে ভয়াবহ অত্যাচার ও বর্বরতার পরিচয় দিয়েছিল তা বর্ণনাতীত। যত্রতত্র গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, আগুন দিয়ে ইত্যাকার উপায়ে ভার্সাই সেনারা হত্যা করে সাধারণ মানুষদের। এমনকী এই গণহত্যা থেকে নারী, শিশু, বৃদ্ধরাও ছাড় পায়নি।
সরকারি সেনাবাহিনীর এই আক্রমণের প্রতিফলন ঘটেছে তৎকালীন গানেও। তার একটি নিদর্শন শুনুন -
রক্তাক্ত সপ্তাহ
কথাঃ জিন ব্যাপটিস্ট ক্লিমেন্ট, ১৮৭১
সুরঃ পিয়েরে ডুপন্ট, ১৮৪৯
যেদিকে তাকাও জহ্লাদেরা অস্ত্র হাতে ঘুরছে
সাথে দালাল আর গুপ্তচর
কতজনার ভাঙলো ঘর
কত বাবা মা পুত্র হারা
কত বিধবা আর অনাথেরা
অশ্রু চোখে দেখছে চেয়ে
রক্ত নদী চলছে বেয়ে
সুখী শুধু যুদ্ধবাজ হত্যাকারী দল।
(সমবেত)
সব সত্যি তবু কেটে যাবে ঝড়
ওদের মসনদ করছে নড়বড়
যখন গরিবেরা উঠে দাঁড়াবে
আর প্রতিশোধে উঠে দাঁড়াবে
খুনেদের দল পালাবার পথ পাবেনা।
ওদের পেটোয়া স্তাবক কাগজওয়ালা
মিথ্যে কথার গাঁথে মালা
গরিব মরে অনাহারে
আর ধনীদের বাক্স ভরে
মদ মাংস আর সুন্দরী নারী
ওরা ভোগী অত্যাচারী
নেশার ঘোরে নৃত্য করে
কমিউনার্ডদের লাশের উপরে।
(সমবেত)
এবারে আমরা চালাব গুলি
পারোতো বাঁচাও মাথার খুলি
শিশু কোলে মায়ের কসম
এবার তোমার শাস্তি সশ্রম
সময় হলেই আসব আমরা আসছি।
কাল আবার পুলিশ আসবে
বীর দর্পে তারা নাচবে
ঘুরিয়ে পিস্তল মারবে তারা
শ্রমিক যত কর্মহারা
অন্নহীন বস্ত্রহীন অস্ত্রহীন
তবু প্রাণে আমরা নইতো দীন
জেনো গির্জার ফতোয়া শেষ কথা বলবেনা।
(সমবেত)
বঞ্চিত মানুষেরা চিরকাল
টানবেনা পাপের এ জোয়াল
গণযুদ্ধ তাই শুরু আজ
তারা খালিপেটেই পরছে রণসাজ
ন্যায় বিচার আমরা চাই
রক্ত দিয়েই আদায় করে নেব তাই।
প্যারিস শহরে আজও কমিউনের রক্তাক্ত স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশেষ দেওয়াল। এই গানটি সেই বিপ্লবী শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য, যাদের কুখ্যাত 'মুর দেস ফেডরেস' নামে দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতি বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে আজও বহু মানুষ সেখানে শ্রদ্ধা জানাতে সমবেত হন।
যে দেওয়ালে ওদের হত্যা করা হয়েছিল
কথাঃ জুলেস জোয়ি, ১৮৮৭
সুরঃ ক্যামিলে সাওবিসে ও ফ্রেডরিক ডোরিয়া, ১৮৮৭
ওই দেওয়ালটার দিকে তাকাও
কুড়িটি লাল পতাকা দিয়ে গুলির গর্তগুলি লুকানো
এখানেই বীরেরা মাটিতে লুটিয়ে পরেছিল।
ভাস্কর্যের চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর
গর্ব দিয়ে গড়ে ওঠা এই সমাধি
যেখানে সবুজ ঘাসে নিচে
কফিন ছাড়াই মৃত বীরেরা সমাহিত।
প্রতি বছর যখন মে মাস আসে
সবুজ ঘাস দেওয়ালটিকে সাজায়
সেখানে এখনো চলছে রক্তপাত
এখানেই বীরেরা মাটিতে লুটিয়ে পরেছিল।
সেই রক্তাক্ত সপ্তাহের নেকড়েরা
সব মানুষকে ভেড়া মনে করেছিল
ভেবেছিল ন্যায়ের কোন দাম নেই
আজও জানেনা তারা কি ভুল করেছিল।
আজ কিন্তু প্যারির সন্তানেরা জাগছে
তারা প্যারি পিতার রক্তঋণ শোধ করবে
তখন কবরের নিচে ঘুমানো বীরেরা
আবার জেগে উঠবে পুত্রের গরবে।
দেখ জনতার সিংহ জেগে উঠছে
এবার তারা গর্জন করে ঝাঁপ দেবে
কবরের ঘাসে লাল গোলাপেরা ফুটছে
তারাই কিন্তু শেষ কথাটি বলবে।
কমিউন হেরে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সে যে আশা জাগিয়েছিল তা আজও উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে আছে। তাই আজ ১৫০ বছর পরেও পৃথিবীর মেহনতি মানুষ তাকে যথোপযুক্ত সম্মান জানায়। না, কমিউনের মত্যু হয়নি, হবেও না।
সে কিন্তু মারা যায়নি
কথাঃ ইউজেন পঁতিয়ের, ১৮৮৬
সুরঃ ভিক্টর পারিজোট, ১৮৮৬
সে কিন্তু মারা যায়নি
আমরা তাকে তাড়িয়ে ঝেটিয়ে ঘিরেছি
মেসিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করেছি
শক্ত মাটিতে তারই পতাকায় মুড়ে
অনেক গভীরে পুঁতে দিয়েছি।
কিন্তু তার মানে এই নয় নিকোলাস
যে কমিউন সত্যিই মারা গেছে।
যেমন করে মেসিনে ঘাস ছাঁটা হয়
যেমন করে ধারালো ছুরিতে কাটা হয় আপেল
ভার্সাইলিস খুন করেছে এক লক্ষ মানুষ
কিন্তু তার মানে এই নয় নিকোলাস
যে কমিউন সত্যিই মারা গেছে।
পুলিশ আর ব্যবসায়ী সঙ্গে সাংবাদিক
যারা মেরুদন্ড বিক্রি করেছে নামমাত্র মূল্যে
তার কমিউনের কবরে ঘেন্নার বমি ছড়িয়েছে
কিন্তু তার মানে এই নয় নিকোলাস
যে কমিউন সত্যিই মারা গেছে।
এত কিছুর পরেও যখন নিশ্চিত হওয়া গেলনা
চিৎকার করে বলো কমিউন দীর্ঘজীবি হোক
যত সব জুডাস তারা শীঘ্র জানবে
যে কমিউন আজও দিব্যি বেঁচে আছে।
এই লেখা শেষ করছি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংগীত দিয়ে, কারণ এটি একটি এমন গান যা সরাসরি প্যারি কমিউনের সঙ্গে আজকের সময়ের যোগসাধন করে। ইউজিন এই গানটি রচনা করেছিলেন প্যারিস কমিউনের পতনের ঠিক পরে ১৮৭১এর জুন মাসে। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় অনেক পরে। ১৮৮৮সালে পিয়েরে দেগেতার গানটিতে যে সুরারোপ করেন তা ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সভায় গীত হয়ে এনথেম হিসাবে অনুমোদিত হয়। আজ তা সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশের কমিউনিষ্ট পার্টির গান। সম্পূর্ণ গানটির ছটি অংশ আছে। কিন্তু সর্বত্র তার প্রথম অংশটিই গাওয়া হয়। এখানে সেটিই দিচ্ছি। এটির অনুবাদ করেছিলেন মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়।
আন্তর্জাতিক সঙ্গীত
কথাঃ ইউজিন পঁতিয়ের, ১৮৭১
সুরঃ পিয়েরে দেগেতার, ১৮৮৮
বঙ্গানুবাদঃ মোহিত বন্দ্যোপাধ্যায়
জাগো জাগো জাগো সর্বহারা
অনশন বন্দি ক্রীতদাস
শ্রমিক দিয়াছে আজি সারা
উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস
সনাতন জীর্ণ কুআচার
চূর্ণ করি জাগো জনগন
ঘুচাও এ দৈন্য হাহাকার
জীবন মরণ করি পণ।
শেষ যুদ্ধ শুরু আজ কমরেড
এসো মোরা মিলি এক সাথ
গাও ইনটারন্যাশনাল
মিলাবে মানব জাত।