ব্রিকস-এর সম্প্রসারণের নেপথ্যে
প্রভাত পট্টনায়ক
ব্রিকস-এর দেশগুলোর যে শীর্ষ বৈঠক সম্প্রতি জোহানেসবার্গে হলো, সেখানে ঠিক হয়েছে যে, প্রথম থেকে অন্তর্ভুক্ত পাঁচটি দেশ - ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও আরও ছয়টি দেশকে যুক্ত করা হবে। এরা যথাক্রমে আর্জেন্টিনা, ইজিপ্ট, ইরান, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব এবং আরব আমিরশাহি। এই ছ’টি দেশকে, যে বাইশটি দেশ ব্রিকস-এ যোগ দিতে আগ্রহী ছিল, তাদের থেকে বাছাই করা হয়েছে। তদুপরি, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার, যিনি ব্রিকস-এর চেয়ারম্যান পদে আছেন, জানিয়েছেন যে, কমবেশি চল্লিশটি দেশ ব্রিকস-এ যোগ দিতে আগ্রহী। স্বভাবতই, প্রশ্ন হলো, ব্রিকস এত জনপ্রিয় হলো কেমন করে?
অনেকেই ব্রিকস-কে মনে করেন এটি বেশ কিছু বড়ো দেশের পক্ষ থেকে গৃহীত উদ্যোগ, যাদের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির বৈঠক থেকে বাদ দেওয়া হয় বলে তারা তাদের নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাদের মতে যা প্রাপ্য সেই ভূমিকা পালন করবার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু ব্রিকস খুবই ভিন্ন ধরনের শক্তির সমাহারঃ রাশিয়া ও চীন ইউএন সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য যাদের ভেটো দেওয়ার অধিকার আছে; এদের মধ্যে একটি দেশ বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে থাকা একটি দেশের সাথে যুদ্ধরত, অন্যটিকে সাম্রাজ্যবাদী শিবির প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে; ফলে এদেরকে সেই ‘‘বাদ পড়া’’ দেশ বলে গণ্য করা যায় না। বাকি সদস্যদের ক্ষেত্রে বলা যায় যে, ব্রিকস্ জন্মলগ্ন থেকে বিশ্ব পরিস্থিতিতে কখনো গুরুত্ববহ কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। যেকারণে বাকি সদস্যদেরকে বলা চলেনা যে, তারা সকলেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে উন্নতিসন্ধানী (কারণ, যদি তারা তা চাইতেন, তাহলে তাদের আরও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যেত)। সেকারণে কিছু বাড়তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবার আকাঙ্ক্ষায় এতগুলো দেশ ব্রিকস-এ যোগ দিতে চান, একথা মনে করার কোনো যথাযথ কারণ নেই।
ব্রিকস-এর জনপ্রিয়তার এই ব্যাখ্যার আরও সমস্যা আছে। এরা বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক অর্থনীতি ভুলে যাচ্ছেন, যেখানে পুঁজিবাদের বিশ্বজোড়া সংকট এমন আকার ধারণ করেছে যে, রক্ষণশীল এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষাবলম্বী অর্থনীতিবিদরাও একে ‘দীর্ঘকালীন মন্দা’ বলে চিহ্নিত করছেন।
লক্ষণীয় যে, এই সংকটাপন্ন অবস্থায় পুরোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করতে অক্ষম। সাম্রাজ্যবাদী শিবিরও সেগুলোকে প্রয়োজন মতো ব্যবহার করতে পারছে না, বা বদলাতে পারছে না, কিংবা পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্মও দিতে পারছে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিকস নতুন এক সম্ভাবনা হিসেবে উঠে এসেছে। ব্রিকস-এর জনপ্রিয়তার কারণ সেজন্য সংকটের গহনে নিহিত, রয়েছে যেখানে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর ভরসা কমেছে। তার মানে এই নয় যে, ব্রিকস সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দেশগুলোর একটি গোষ্ঠী। তবে কয়েকটি দেশ যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু একথা কোনোভাবেই বলা যাবে না যে, মিশর, ইথিওপিয়া, সৌদিআরব, আরব আমিরশাহি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ব্রিকস-এ যোগ দিয়েছে। আসলে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী না হলেও তারা একটি বিকল্প আয়োজনের দিকে চেয়ে রয়েছেন এই প্রত্যাশায় যে, সামনের দিনগুলোতে কিছু প্রয়োজনীয় সাহায্য পাওয়া যাবে।
ব্রিকস-এর বর্ধিত বর্তমান অবস্থায় তিন ধরনের দেশ যুক্ত রয়েছে। প্রথম ধরনের দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদ একতরফা কিছু শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেছে, দ্বিতীয়, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনকারী দেশসমূহ। তাছাড়া এমন কিছু দেশ আছে যারা ইতিমধ্যেই বিশ্ব পুঁজিবাদের সংকট হেতু যথেষ্ট দুর্গতির শিকার হয়েছে অথবা অদূর ভবিষ্যতে হবে। চীন, রাশিয়া, ও ইরান প্রথম শ্রেণিভুক্ত। রাশিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও আরব আমিরশাহি দ্বিতীয় শ্রেণিভুক্ত। মিশর, ইথিওপিয়া, ও আর্জেন্টিনা তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত( ব্রাজিল ও ভারত ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাই এর থেকে পরিত্রাণ পেতে বিকল্প ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহী।)
যেসব দেশের উপর একতরফাভাবে সাম্রাজ্যবাদের নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছে যা এমনকী সিকিউরিটি কাউন্সিলের অনুমোদনও পায়নি, ব্রিকস তাদের এসব নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে চলার একটা কার্যকর ব্যবস্থা করেছে। সেই হিসেবে, ব্রিকস-এ ইরানকে যুক্ত করাই জোহানেসবার্গ শীর্ষ বৈঠকে গৃহীত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। ইরান কেবল ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে তাই নয়, এটি প্রথম সেই দেশ যাকে নিজের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার যা প্রথম বিশ্বের দেশগুলির ব্যাঙ্কগুলিতে রাখা আছে তা স্পর্শ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এই কাজ পুঁজিবাদের দ্বারা স্থিরীকৃত আইনেরও পরিপন্থী, যা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিই ঠিক করেছিল। যেহেতু এরকম যথেচ্ছাচার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে, রাশিয়াও ইউক্রেন যুদ্ধের সময় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তাদেরকেও বিদেশি ব্যাঙ্কে সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। ব্রিকস-এ যুক্ত হওয়ার ফলে এসমস্ত শাস্তিপ্রাপ্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদের পাতা ফাঁদ থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনকারী দেশসমূহ লক্ষ করেছে যে, উত্তোলিত খনিজের দাম বিশ্বজোড়া মন্দার কারণে কমছে। তাই তারাও চেষ্টা করছে কমতে থাকা চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন কিছুটা হ্রাস করার, যাতে এসব খনিজের মূল্য কিছুটা বাড়ে। এসব পদক্ষেপ আমেরিকার ইচ্ছার সরাসরি বিরুদ্ধে। এরমধ্যে তারা একটি প্রতিনিধি দলও সৌদি আরবে পাঠিয়েছিল, বাইডেন স্বয়ং অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন যাতে তারা ওপেকভুক্ত দেশগুলির বৈঠকে উৎপাদন কমানোর বিরুদ্ধে সওয়াল করে, কিন্তু মার্কিন চাপে কাজ হয়নি। তারপর থেকে ওপেক ক্রমান্বয়ে উৎপাদন কমিয়েছে। যদি তেল উত্তোলনকারী দেশসমূহকে উৎপাদনের বিষয়ে যথেষ্ট স্বাধিকার মার্কিনিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে অর্জন করতে হয়, তাহলে তাদের তিক্ততা সৃষ্টি না করেও সম্পূর্ণরূপে মার্কিন নির্ভরশীলতা থেকে ক্রমশ নিজেদের মুক্ত করতে হবে। ব্রিকসে যুক্ত হওয়া সেই মার্কিন প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার একটি পদক্ষেপ।
তৃতীয় শ্রেণির দেশগুলো, অর্থাৎ, মিশর, আর্জেন্টিনা, ইথিওপিয়া, যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই দুর্বল, এবং ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা, যারা ততটা ভঙ্গুর না হলেও সুবিধাজনক অবস্থানে নেই, তাদের জন্য ব্রিকস-এ যোগদানের অন্য সুবিধা আছে। ডলার এড়িয়ে দেশীয় মুদ্রায় বিনিময় চালানো তার মধ্যে একটি সুবিধা। ব্রাজিল ও চীন, ভারত এবং আরব আমিরশাহি ইতিমধ্যে সেই চুক্তি করেছে এবং বাকি দেশগুলোও এই সুবিধা ভবিষ্যতে পাওয়ার জন্য আশাবাদী আছে। এই ব্যবস্থাপনা তাদের ব্রিকস-এ যোগদানের অন্যতম কারণ।
যারা এই ব্যবস্থায় যুক্ত হবেন আপেক্ষিক মুদ্রার মূল্য তাদের জন্য স্থির, এবং ডলার কোনো একক হিসেবে কিংবা বিনিময়ের মাধ্যমে হিসাবে অপ্রয়োজনীয় হয়ে গিয়েছে। এরকম বন্দোবস্ত, যাতে বিনিময় মুদ্রার লভ্যতা তুলনায় প্রসারিত হচ্ছে, এবং যা উল্লেখিত দেশগুলোর মিলিত সিদ্ধান্তেই হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে, সর্বোপরি, ডলারের ঘাটতির কারণে তা বাধাপ্রাপ্ত হবে না।
এ পর্যন্ত, সমস্যার অর্ধেক বলা গেল। এর সাথে বলা দরকার যে, এই বাণিজ্যিক ভারসাম্যের মীমাংসা করবে উদ্বৃত্ত দেশ, যারা ঘাটতি দেশ থেকে দ্রব্যাদি ও পরিষেবা কিনছে। যদি তৎক্ষণাৎ লেনদেন না’ও শেষ হয়, নিদেনপক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করা হবে। অন্যভাবে বললে, দেশীয় মুদ্রায় বাণিজ্য, বিশ্ব অর্থনীতিতে যত দ্রুত নগদ অর্থের জোগানের বিস্তার ঘটায়, কিন্তু বাইরের ধার, যা বাণিজ্যিক সম্পর্কযুক্ত দেশগুলোর বাণিজ্যিক বিনিময়ের ফলে সৃষ্টি হয়, তার সমাধান করে না।
ব্রিকস এরকম দ্বিমুখী বাণিজ্য সম্পর্কের সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করে। যেখানে বাণিজ্যিক ঘাটতি মেটানোর উপায় হিসেবে কেবল ঘাটতি দেশের ঋণ বাড়িয়ে যাওয়া হয় না, তাদের থেকে বেশিমাত্রায় পণ্য কিনে সেই ঘাটতি মেটানো হয়। এতে বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়ছে, সেকারণেই ব্রিকস সাম্রাজ্যবাদের কবলে থাকা বিশ্ববাজারের একটি সত্যিকার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে।
দিলমা রুসেফ, যিনি ব্রাজিলের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন, এখন ব্রিকস ব্যাঙ্কের নতুন ডাইরেক্টর। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে, তৃতীয় বিশ্বের বা ব্রিকসভুক্ত দেশসমূহের ঘাটতি মেটানোর জন্য ঋণ দেওয়ায় এই ব্যাঙ্কের কোনো আগ্রহ নেই। তাই ব্রিকস ব্যাঙ্ক আইএমএফ-এর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন কমানোয় কিংবা বেশ কিছু দেশের উপর ব্যয়সংকোচনের কঠোরতা কমানোয় কোনো ভূমিকা নিতে পারবে না। কিন্তু তিনি দেশীয় মুদ্রাভিত্তিক বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে পরিকাঠামোগত ঋণ প্রদানে সহায়তা করবেন। এর ফলে সাম্রাজ্যবাদীদের দখলে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নির্ভরশীলতা কমবে।
সদস্য দেশগুলোর অভ্যন্তরে বামপন্থী বৃত্তে খুবই আলোচনা চলছে যে, ব্রিকস সাম্রাজ্যবাদের কাছে কী অর্থ বহন করে। কেউ কেউ বলছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে হলেও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে ব্রিকস নয়। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে তো নয়ই, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বললেও অতিরঞ্জনই হবে। মোদি, সৌদি আরবের রাজা, এবং মিশরের সিসির মতো রাষ্ট্রনেতাদের জোটের পক্ষে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী হওয়া সম্ভব না। তবে, এ পর্যন্ত ব্রিকস সাম্রাজ্যবাদের একচেটিয়া অধিকারকে অন্তত কিছুটা খর্ব করেছে, যা অবশ্যই ইতিবাচক। তাই, নিজে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও, ব্রিকস আসলে এমন একটি ব্যবস্থাকে হাজির করছে যা মেহনতি মানুষের জন্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
ভাষান্তরঃ সৈনিক শূর