E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত তুরস্ক

জনগণের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ এরদোগান সরকার

সর্বশক্তি নিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি

শংকর মুখার্জি


এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত তুরস্ক এবং সিরিয়া। ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর ৪টে ১৭ মিনিটে হয় এই ভূমিকম্প। ভূমিকম্পের এপিসেন্টার ছিল কাহরামানমারাস/পাজারকাক। তীব্রতা ছিল রিখটার স্কেলে ৭.৭। এখনও পর্যন্ত তুরস্কে ২৫ হাজারের বেশি মানুষ এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মারা গেছেন। যখন জনগণ ঘুমিয়ে তার মধ্যে এই উচ্চ কম্পাঙ্কে ভূমি কেঁপে ওঠায় মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হয়েছে। এখনও ভূমিকম্পের রেশ কাটেনি, আফটার শক্ হয়েই চলেছে। সম্প্রতি এপিসেন্টারের কাছে একটা আফটার শকে্র তীব্রতা ছিল ৭.৬। ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তুরস্ক। এই দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলি হলো - কাহরামানমারাস, গাজিয়ানটেপ, দিয়ারবাকির, সানলিউরফা, মালাট্য, হাতয় এবং ওসমানিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে ধ্বংসের ব্যাপকতা বিরাট। মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে।

তুরস্কে যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার, উদ্ধার সরঞ্জাম, তাঁবু, জ্বালানি এবং বিমান আছে। তবুও এরদোগান প্রশাসন সময়মতো বিপর্যস্ত এলাকায় পৌঁছতে পারেনি। বহু জায়গায় ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জীবিত মানুষকে উদ্ধার করার খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রশাসন যথেষ্ট সংখ্যায় উদ্ধারকারী দলের ব্যবস্থা করতে পারলে আরও অনেক মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হতো। যত দিন যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে জীবিত মানুষ উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হচ্ছে। ভূমিকম্প হয়েছে দশ-বারো দিন হয়ে গেল, এখনও বহু বিপর্যয় কবলিত এলাকায় যথেষ্ট ত্রাণ পৌঁছাতে পারেনি প্রশাসন। মানুষের এই চরম দুর্দশার মধ্যেও ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছনোয় প্রচণ্ড দেরি হচ্ছে, কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হচ্ছে মানুষকে। বাড়ি-ঘরদোরের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজও ধীরগতিতে চলছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হাসপাতালগুলোর। আহত মানুষের চাপে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পীড়িত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সর্বাঙ্গীণ উদ্যোগ নেই এরদোগান সরকারের। এনিয়ে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।মন্ত্রীদের ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনাও ঘটছে। ত্রাণ, উদ্ধারকাজ এবং চিকিৎসার ঘাটতিগুলোকে দূর করার কোনো উদ্যোগ না নিয়ে টিভিতে জনগণের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি এরদোগান বলেছেনঃ ধৈর্য রাখতে, সংযত থাকতে। মহামারী হোক কিংবা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় - পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এ-এক কুৎসিত দিক। সেখানে মানবিকতার কোনো স্থান নেই, নেই মানুষের জীবনের কোনো মূল্য।

দুর্গতদের ত্রাণ দিচ্ছেন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা।

তুরস্কের কমিউনিস্ট পার্টি (টিকেপি) ছোটো পার্টি। ক্ষমতা সীমিত। সেই সীমিত ক্ষমতার সবটাকে নিয়েই বিপর্যয়-পীড়িত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছেন টিকেপি’র কর্মীরা, নেতারা। তাঁরা যেমন ধ্বংসস্তূপ সরানো, উদ্ধারের কাজে যুক্ত হয়েছেন তেমনি সমানতালে ত্রাণ সরবরাহ করছেন, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং লঙ্গরখানা চালাচ্ছেন। ভারত হোক কিংবা তুরস্ক ভৌগোলিক অঞ্চলভেদে মহামারী-প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পীড়িত-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই কমিউনিস্ট-সংস্কৃতিতে কোনো তফাত দেখা যায় না।

এই মহাবিপর্যয়ের সময়ে তুরস্কে কমিউনিস্ট পার্টি ঠিক কীভাবে কাজ পরিচালনা করছে সে বিবরণে প্রবেশের আগে বর্তমানে সেদেশের কীরকম অবস্থা তার একটা ক্ষুদ্র ছবি দেওয়া দরকার। আগেই বলা হয়েছে, দেশের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলির মধ্যে অন্যতম হলো হাতয়। এই অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়ে যাওয়ার চার-পাঁচ দিন পরেও কোনো সরকারি উদ্ধারকারী দল পৌঁছায়নি। সামানডাগ আরেকটা প্রদেশ, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত। এখানকার স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে আহত মানুষ রাখার আর কোনো জায়গা নেই। এখানে অস্ত্রোপচার চলছে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের জীবাণুমুক্ত করার দরকারি সামগ্রী ছাড়াই। হাসপাতালে বেওয়ারিশ লাশ স্তূপীকৃত হয়ে উঠছে। অনাথ শিশুদের সংখ্যাও বাড়ছে। আদিয়ামানে যথেষ্ট সংখ্যক ডাক্তার নেই। সেখানে আহত মানুষের সংখ্যা এতো বেশি যে, রোগীদের নাম রেজিস্ট্রি করার ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। আদানা এবং মার্সিন শহরের হাসপাতালগুলি কোনো খবর দিতে পারছে না, কারা আহত হয়ে ভরতি আছে কিংবা কারা ইতিমধ্যে মারা গেছে। যাঁদের ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা গেছে, ঠান্ডায় সঠিক আশ্রয়ের অভাবে তাঁরাও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। সামানডাগ ও ইসকেনডেরানে বিভিন্ন ধরনের আপৎকালীন সাহায্যের বেশি দরকার, কেন না এখানেই মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত এলাকার জনগণের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ায়ও সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। জনগণকে নিজেদেরকেই এই ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।

এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে মানুষকে বাঁচাতে, মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নিয়েছে টিকেপি। কমিউনিস্ট পার্টি তার সমস্ত শাখাকে এই কাজে নামিয়েছে। ভূমিকম্পের আকস্মিক ধাক্কাকে কাটিয়ে উঠেই টিকেপি প্রায় সমস্ত বিপর্যয় কবলিত এলাকায় হেল্প-ডেক্স খোলে। উদ্ধারকাজের জন্য পার্টির টিমকে ভূমিকম্পে সবচেয়ে বিপর্যস্ত হাতয় আনতাকয়া, হাতয় ইসকেনডেরাম, কাহরামানমারাস নুরহাক এবং মালত্য এলাকায় পাঠানো হয়। এই টিমগুলিতে ৪০০-রও বেশি পার্টিকর্মী ছিলেন। এই টিমে পার্টির ডাক্তার ও স্থাস্থ্যকর্মীরাও ছিলেন। পার্টির সাধারণ সম্পাদক কেমাল ওকুয়ান এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের প্রতিনিধিদলও ভূমিকম্প বিপর্যস্ত এলাকায় যায়। পরবর্তী সময়ে দুর্গত এলাকায় খাবার ও ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হয় পার্টির উদ্যোগে। প্রথম চারদিনেই ৭ ট্রাক ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া হয় পীড়িত মানুষদের কাছে। একটা মোবাইল কিচেন ভ্যান করা হয়েছে পার্টির উদ্যোগে, যারা প্রতিদিন ৩ হাজার মানুষকে খাবার সরবরাহ করছে। এছাড়াও অনেকগুলি স্থায়ী লঙ্গরখানা তৈরি করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, কয়েকটি শহরে এমনকী সরকারি উদ্ধারকারী দল পৌঁছানোর আগেই পার্টির উদ্ধারকারী দল পৌঁছে যায় উদ্ধার সরঞ্জাম এবং ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে।

ত্রাণকার্য পরিচালনার সাথেই টিকেপি’র সমস্ত পার্টি অফিসে ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করা হচ্ছে। পার্টি সূত্রে জানানো হয়েছে, এই সব সংগৃহীত ত্রাণসামগ্রী নিয়ে শেষ কয়েক দিনে আঙ্কারা, ইস্তানবুল, ইজমির, বারসা প্রভৃতি স্থান থেকে আরও ১৩টি ট্রাক বিভিন্ন দুর্গত এলাকায় পৌঁছেছে।

ত্রাণ ও উদ্ধারকার্যে এরদোগান সরকারের চরম অবহেলায় জনগণের ক্ষোভের পারদ ক্রমশ চড়ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার বহিঃপ্রকাশও ঘটছে। সম্প্রতি এক বিপর্যস্ত এলাকায় রাজধানী আঙ্কারা থেকে পরিবহণ মন্ত্রী এবং তার অফিসাররা পরিদর্শনে গেলে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। দুর্গত-পীড়িত মানুষ মন্ত্রী ও অফিসারদের ওপর চড়াও হয়, তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে। আগেই বলা হয়েছে, এরদোগান জনগণকে ধৈর্য রাখতে এবং সংযত থাকতে বলেছেন। সম্প্রতি জনগণের এই প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি সব কিছুর জন্য ভাগ্যকে দায়ী করেছেন। ভূমিকম্প কবলিত এলাকায় জনগণের দুর্দশার ছবি যাতে দেশের অন্য অংশের জনগণ না জানতে পারে তার জন্য এরদোগান সরকার ইন্টারনেট পরিষেবার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তবে সেদেশের মিডিয়া ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে এরদোগান সরকারের এই ব্যর্থতাকে ঢাকতে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। মিথ্যা খবর, মিথ্যা ছবি তুলে ধরা হচ্ছে তাঁবেদার সংবাদমাধ্যমগুলিতে। আর এটা আরও বেশি করে তাদের করতে হচ্ছে এই কারণে কেন না, আগামী ১৪ মে তুরস্কে সাধারণ নির্বাচন।