প্যালেস্তিনীয়দের নিঃশেষ করে দিতে চায় ইজরায়েল
শংকর মুখার্জি
ইজরায়েলি হানায় প্যালেস্তাইনের ধ্বংস চিত্র।
গত বছরে একেবারে শেষের দিকে ২৯ ডিসেম্বর ইজরায়েলে প্রধানমন্ত্রী হন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। তারপর থেকেই প্যালেস্তাইনের ওপর হামলাকে তীব্র করেছে ইজরায়েল। গত ৪৫ দিনে এই হামলায় ৫০ জন প্যালেস্তিনীয় প্রাণ হারিয়েছেন। এদের মধ্যে ১১ জন শিশু।
ইজরায়েলি সংসদের ১২০ জন সদস্যের ৬৩ জন নেতানিয়াহুকে প্রধানমন্ত্রী পদের নির্বাচনে সমর্থন জানান। এঁদের সিংহভাগই অতি দক্ষিণপন্থী দলের সাংসদ। সংবাদমাধ্যমেই আলোচিত হয়েছে, এযাবৎকালে যত সরকার ইজরায়েলে তৈরি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে অতি দক্ষিণপন্থী সরকার হলো নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এই বর্তমান সরকার। এমনিতেই গত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে প্যালেস্তাইনের ওপর আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইজরায়েল। নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে এই অতি দক্ষিণপন্থী সরকার গঠিত হওয়ায় আগ্রাসনের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই আগ্রাসনের মধ্যেই ১২ ফেব্রুয়ারি ইজরায়েলি মন্ত্রীসভা তাদের দখলীকৃত ওয়েস্টব্যাঙ্কে নয়টি ইজরায়েলি বসতিকে অনুমোদন দিয়েছে। ইজরায়েল ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা স্ট্রিপ দখল করে। তখন থেকেই সেখানে শুরু হয় বসতি। গত ৫০ বছরে এই দখলীকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক এবং পূর্ব জেরুজালেমে ২০০-র বেশি বসতি গড়ে উঠেছে। এই বসতিগুলিতে এখন প্রায় ৭ লক্ষ ইজরায়েলি থাকেন। প্যালেস্তাইনের ভূখণ্ড দখল এবং এই বসতি স্থাপন দুইই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি। আন্তর্জাতিক পরিসরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ইজরায়েলি বসতিগুলিকে বেআইনি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘেও এই বেআইনি ইজরায়েলি বসতি নিয়ে নিন্দাসূচক প্রস্তাব একাধিকবার ভোটাভুটিতেই গৃহীত হয়েছে। এই বেআইনি বসতির বইরেও আরও আবাসন তৈরি হবে বলেও প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে।
ইজরায়েলি সরকারের এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় প্যালেস্তাইনের বিদেশমন্ত্রী বলেছেনঃ সম্প্রতি এই সিদ্ধান্ত সমস্ত সীমাকে অতিক্রম করে গেছে। শান্তি প্রক্রিয়ার পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টাকে খর্ব করছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ইজরায়েলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সামরিক সহায়তা দেয়। এদের মদতেই প্যালেস্তাইনের ওপর বছরের পর বছর ধরে আগ্রাসন চালাচ্ছে, এবং জমি দখল করছে ইজরায়েল। তাই সাধারণত প্যালেস্তাইনের ওপর ইজরায়েলি আগ্রাসনের নিন্দা করে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবারেও যে এত মানুষ এখনো পর্যন্ত ইজরায়েলি হানায় মারা গেছে তাতেও কোনো নিন্দা করেনি তারা। তবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এই বসতি সম্প্রসারণে মৃদু সমালোচনা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এটা বলা যায় প্রায় বিরল ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ইজরায়েলের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মার্কিন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেনঃ ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ইজরায়েলের হাজারের বেশি বাড়ি তৈরির এই ঘোষণায় আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি। যদিও প্যালেস্তাইনের ওপর সাম্প্রতিক হামলার মাঝেই মার্কিন বিদেশ সচিব ইজরায়েল সফরে এসেছিলেন। তিনি নেতানিয়াহুর সাথে বৈঠকও করেন। তবে ইজরায়েলি হামলার ব্যাপারে কোনো বিবৃতি দেননি। রাষ্ট্রসঙ্ঘও ইজরায়েলের সম্প্রসারণবাদী নীতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে ইয়োরোপের বন্ধু দেশগুলিকেও পাশে পাচ্ছে না ইজরায়েল। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, ব্রিটেন এই অবৈধ সম্প্রসারণের তীব্র বিরোধিতা করে বলেছে, ইজরায়েলের এই পরিকল্পনা প্যালেস্তাইনের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়াবে।
একদিকে যেমন নতুন করে ওয়েস্টব্যাঙ্কে বসতি তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে নেতানিয়াহু প্রশাসন, ঠিক একই সময়ে পূর্ব জেরুজালেমে প্যালেস্তিনীয়দের ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে, ধ্বংস করছে। আসলে পূর্ব জেরুজালেমে প্যালেস্তিনীয়দের এই ঘরবাড়িগুলিকে কোনো কারণ ছাড়াই বেআইনি বলে চিহ্নিত করেছে ইজরায়েল। এই প্রচেষ্টা অনেকদিন ধরেই ছিল। তবে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় আসার পর এই বাড়ি ভাঙা আরও গতি পেয়েছে। ইজরায়েলি প্রশাসন বলেছে, তাদের অনুমতি ছাড়াই পূর্ব জেরুজালেমে এক তৃতীয়াংশ প্যালেস্তিনীয়র বাড়ি গড়ে উঠেছে। এবং সেই বাড়ি তারা ভাঙবে। এরফলে ১ লক্ষেরও বেশি প্যালেস্তিনীয় আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে। ইতিমধ্যে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ১ হাজার প্যালেস্তিনীয়কে উৎখাত করেছে তারা। ১৯৬৭ সালে ইজরায়েল যখন পূর্ব জেরুজালেম দখল করে তখন মাত্র ১৩ শতাংশ জমি প্যালেস্তিনীয়দের দেওয়া হয়েছিল। এখানে প্যালেস্তিনীয়দের বাড়ি করতে গেলে ইজরায়েলি মিউনিসিপ্যালিটির অনুমতি লাগে সেইভাবে বাড়ি বা ফ্ল্যাট করতে গেলে প্রচুর অর্থ লাগে। সে অর্থ স্বাভাবিকভাবেই প্যালেস্তিনীয়দের কাছে নেই। তাই স্বাভাবিকভাবে প্যালেস্তিনীয়দের বেশিরভাগ বাড়ি এখানে অনুমতি ছাড়া গড়ে উঠেছে। এখন তাকেই বেআইনি বলছে ইজরায়েলি প্রশাসন। বাকি ৮৭ শতাংশ জমিতে পূর্ব জেরুজালেমে ১৯৬৭ থেকে ১৯৯৫-র মধ্যে যে ইজরায়েলি বসতি গড়ে উঠেছে তা প্রকৃতঅর্থে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি। এখানেই ২ লক্ষ ইজরায়েলি থাকে। প্যালেস্তিনীয়দের জোরজবরদস্তি ঘরছাড়া করে এখন এই ১৩ শতাংশ জমিকেও দখল করতে চাইছে ইজরায়েল।
প্রসঙ্গত,গত বছরেও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে মারত্মক হামলা চালিয়েছিল ইজরায়েল। ২০০৫ সালের পর সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল ওই হামলায়। ইউনাইটেড নেশনসের হিসেবে ২০২২ সালে ২২৪ জন প্যালেস্তিনীয় খুন হয় ইজরায়েলের আক্রমণে। যার মধ্যে ৫৩ জন শিশু, ১৭ জন মহিলা।
প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রের অস্তিত্বকেই ইজরায়েল কখনও স্বীকার করেনি। মাইলের পর মাইল জমি তার বেআইনিভবে দখল করে বর্তমান প্যালেস্তাইন রাষ্ট্রকে একটা ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ করে ফেলেছে। কিন্তু যতই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পাক ইজরায়েল, সময়ের সাথে সাথে প্যালেস্তাইনের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত শক্তিশালী হচ্ছে। তাতে ভীত ইজরায়েল। তাই হিংসা, খুন, আক্রমণ, বসতি ধ্বংসের মধ্যদিয়ে একটা পুরো জাতিকে নিঃশেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইজরায়েল। তাই ইজরায়েলি জায়নবাদীদের মূল লক্ষ্য শিশুদের খুন করা। যদি এভাবে একটা জাতিকে, একটা জনপদকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া যায় তাহলে সমস্ত অঞ্চল দখলে কোনো বাধা থাকবে না। তবে প্যালেস্তিনীয়রা এর বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।